বুধবার ● ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » মাটি খুড়ে সন্ধান মেলে সাত’শ বছর পুরোনো মসজিদ
মাটি খুড়ে সন্ধান মেলে সাত’শ বছর পুরোনো মসজিদ
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :: (২৩ ভাদ্র ১৪২৩ বাংলা : বাংলাদেশ সময় রাত ৯.৩৩মিঃ) ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার একটি প্রাচিন জনপদ৷ এটাকে অনেকে বারো আউলিয়ার শহর বলে থাকেন৷ ইসলাম প্রচারের জন্য বারো আউলিয়া এসেছিলেন এই জনপদে৷ প্রায় তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখানে আছে পুরানো শহর মোহম্মদাবাদ৷
১৯৯৩ সালে এখানকার মাটি খুড়ে সন্ধান মেলে পনেরটিরও বেশি মসজিদ৷ এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই প্রাচীন৷ এসব মসজিদগুলো ৭০০ বছরেরও বেশি পুরানো৷ শহর মোহাম্মদাবাদের পুরানো ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, প্রাচীনকালে বারোবাজারের নাম ছিল ছাপাইনগর৷
এ নগর ছিল হিন্দু আর বৌদ্ধ শাসকদের রাজধানী৷ বারো আউলিয়া আসার আগে বৈরাট নগরের বাদশা শাহ সিকান্দার তার সংসর ত্যাগী সন্তানদের কর্মকান্ড ছিল এই জনপদে৷ পরবর্তীতে বারোজন সহচর নিয়ে হযরত খাজা খানজাহান আলী (রঃ) এখানে আসেন৷ সেখান থেকেই এর নাম হয় বারোবাজার৷
যুদ্ধ কিংবা মহামারিতে ছাপাইনগর ধ্বংস হয়ে যায়৷ থেকে যায় প্রাচীন ইতিহাস৷ বারোবাজারের মসজিদগুলোর সঙ্গে বাগেরহাটের কয়েকটি মসজিদের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷
ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বারোবাজার৷ মহাসড়ক ছেড়ে তাহেরপুর সড়ক ধরে পশ্চিম দিকে যেতে রেল লাইন পেরিয়ে হাতের ডানে শুরুতেই পাওয়া যাবে এক গম্বুজ বিশিষ্ট পাঠাগার মসজিদ৷ বারোবাজারের সবচেয়ে বড় সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ৷
৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এ মসজিদটির ভেতরে এখনো দেখা যায় ৪৮ টি পিলার৷ লাল ইটের তৈরি এই মসজিদ আকারে ছোট৷ দীর্ঘদিন মাটি চাপা পড়ে থাকার পর ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি সংস্কার করে৷
জনশ্রুতি আছে সুলতানী আমলে নির্মিত এই মসজিদ কেন্দ্রীক একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল৷ মসজিদের পাশেই বড় আকারের একটি দিঘি, নাম পিঠেগড়া পুকুর৷ আবারও তাহেরপুর সড়ক ধরে সামনে এগুতে হবে৷ দুটি বাঁক ঘুরলেই বিশাল দিঘি, নাম পীর পুকুর৷ পশ্চিম পাড়ের মাঝ বরাবর বেশ বড় আকৃতির মসজিদ পীর পুকুর মসজিদ৷ এই মসজিদও ছিল মাটির নিচে৷
১৯৯৪ সালে খনন করে বের করা হয়েছে৷ এই মসজিদে ছাদ নেই, শুধু দেয়াল আছে৷ মসজিদটি লাল ইটের তৈরি৷ তাহেরপুর সড়ক ধরে সামান্য পশ্চিম দিকে এগুলে হাতের বাঁয়ে একটু ভেতরের দিকে আরেকটি মসজিদের দেখা মিলবে৷ এর নাম গোড়া মসজিদ৷ এই মসজিদ চার গম্বুজ বিশিষ্ট৷
মসজিদের মিহরাব ও দেয়ালে পোড়ামাটির ফুল, লতাপাতা ফলের নকশাসহ নানান কারুকার্য মন্ডিত৷ বাইরের দেয়ালও লাল ইটে মোড়ানো৷ ১৯৮৩ সালে এই মসজিদের সন্ধান পায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর৷ এর পূর্ব পাশেও বড় আকৃতির একটি দিঘি আছে৷
মসজিদটি খননের সময় একটি কবরের সন্ধান মেলে৷ জনশ্রুতি আছে কবরটি গোড়াই নামে কোন এক দরবেশের৷ এ থেকেই এর নাম গোড়ার মসজিদ৷ গোড়ার মসজিদ থেকে আবারও তাহেরপুর সড়কে সামনের দিকে চলতে হবে৷ সামান্য গেলে সড়কটির উত্তর পাশে আরও একটি মসজিদ৷
চার গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের নাম শুনলে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক৷ নাম ‘গলাকাটা মসজিদ’৷ প্রায় ২১ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া এই মসজিদ খনন করা হয় তোলা হয় ১৯৯৪ সালে৷ ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব আছে৷ এর দেয়ালগুলো প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া৷ মাঝখানে আছে লম্বা দুটি কালো পাথর৷
১৯৯৪ সালে মসজিদের পাশেই পুরো এলাকা্ত তথা শহর মোহাম্মদাবাদের প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনগুলোর নির্দেশনা সম্বলিত হাতে আঁকা একটি মানচিত্র৷ জনশ্রুতি আছে, বারোবাজারে এক অত্যাচারী রাজা ছিল৷ প্রজাদের বলি দিয়ে ওই দিঘির মধ্যে ফেলে দিত সে৷ এ কারণেই এর নাম হয় গলাকাটা৷ গলাকাটা মসজিদের সামনে শহর মোহাম্মদাবাদের মানচিত্র৷ বারোবাজারের সবগুলো প্রত্নস্থলের নির্দেশনা আছে এতে৷
গলাকাটা মসজিদ থেকে সামান্য পশ্চিম পাশে, সড়কের বিপরীত দিকে আরেকটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ৷ নাম জোড় বাংলা৷ মসজিদটি খনন করা হয় ১৯৯৩ সালে৷
খননের সময় এখানে একটি ইট পাওয়া যায়, তাতে আরবী অক্ষরে লেখা ছিল, ‘শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইন, আটশো হিজরী’৷ জনশ্রুতি আছে মসজিদের পাশে জোড়া কুড়েঘর ছিল বলেই এর নাম জোড় বাংলা মসজিদ৷
এবার পাশের সড়ক ধরে আরও কিছু দূরে এগুলে সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদের সাইন বোর্ড চোখে পড়বে৷ পাকা সড়ক ছেড়ে হাতের ডানে মেঠোপথে সামান্য সামনের দিকে চলতে হবে৷ এখানেও বড় একটি পুকুরের দক্ষিণ পাশে সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদের ধ্বংসাবশেষ৷
এটির শুধু দেয়াল আর নিচের অংশই অবশিষ্ট আছে৷ স্থানীয়দের মতে সর্বপ্রথম গ্রামের লোকজনই মাটিচাপা পড়ে থাকা এই মসজিদ উদ্ধার করে৷ আকারে এ এলাকার সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি৷ প্রায় ৭৭ ফুট লম্বা ও ৫৫ ফুট চওড়া মসজিদের ভেতরে আছে ৪৮টি পিলার৷ পশ্চিম দেয়ালে লতা-পাতার নকশা সমৃদ্ধ তিনটি মিহরাব আছে৷
সাতগাছিয়া মসজিদ থেকে এবার চলে আসা যাক পেছনের দিকে৷ বারোবাজার রেল লাইনের পশ্চিম দিকে বিশাল এক দিঘির পশ্চিম পাড় ধরে একটি সড়ক চলে গেছে হাসিলবাগ গ্রামে৷ এখানেও একটি বড় দিঘির পশ্চিম পাশে রয়েছে এক গম্বুজ বিশিষ্ট নুনগোলা মসজিদ৷ বর্গাকৃতির এ মসজিদে তিনটি অর্ধ বৃত্তকার মিহরাব আছে৷
এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এটি৷ স্থানীয়রা একে লবণগোলা মসজিদও বলে থাকেন৷ তবে এ নামকরণের কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না৷ নুনগোলা মসজিদের সামান্য পশ্চিমে হাসিলবাগ গ্রামে আরও একটি এক গম্বুজ মসজিদ আছে৷
হাসিলবাগ মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদের মূল নাম শুকুর মল্লিক মসজিদ৷ পোড়া মাটির তৈরি মসজিদটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ৷ এসব স্থাপনাগুলো ছাড়াও বারোবাজারে আছে আরও কিছু প্রসিদ্ধ স্থান৷
এসবের মধ্যে উল্লেখযাগ্য হল ঘোপের ঢিবি কবরস্থান, নামাজগাহ কবরস্থান, জাহাজঘাটা, মনোহর মসজিদ, দমদম প্রত্নস্থান, বাদেডিহি কবরস্থান, খড়ের দিঘি কবরস্থান ইত্যাদি ৷