শুক্রবার ● ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » নোনা ঝিরি একটি ঝর্ণা দেখার গল্প
নোনা ঝিরি একটি ঝর্ণা দেখার গল্প
হাসান মাহমুদ, আলীকদম (বান্দরবান) প্রতিনিধি ::(১ অাশ্বিন ১৪২৩ বাংলা : বাংলাদেশ সময় রাত ৯.০৮মি.) দিগন্তজোড়া বিস্তৃত গ্রন্থিল পাড়া আর অন্তবিহীন মৌন নিস্তব্দ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের একা আধার “নোনা ঝিরি ঝর্ণা”৷ সর্পিল পাহাড়ি পথ আর ভুতুড়ে পরিবেশ পার্বত্য বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা থেকে প্রায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত পাথরের গা ভিজিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে নেমেয় আসা কাঁচের ন্যয় স্বচ্চ জলরাশি এই “উসাক ঝিরি” বা “নোনা ঝিরি ঝর্ণা”৷
নামকরণ : স্থানীয় জুমিয়া মুরুং সম্প্রদায়ের ভাষায় উসাক শব্দের অর্থ নুন বা লবন৷ মূল রোয়াম্ভু খালটি মাতামুহুরী নদীর মোহনা থেকে কিছুদুর অর্থাত্ যোগেন্দ্র কারবারী পাড়া পর্যন্ত গিয়ে একটি শাখা মেলেছে৷ যার নাম গোয়াম ঝিরি৷ গোয়াম ঝিরিকে বাঁয়ে রেখে সাজো আরো কিছু দুর যাওয়ার পার দুটি প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছে৷ একটি কেয়াং ঝিরি৷ আর অন্যটি উসাক ঝিরি বা নোনা ঝিরি৷ উসাক ঝিরির শেষ প্রান্তে অবস্থিত বলেই এর নাম “উসাক ঝিরি ঝর্ণা” বা “নোনা ঝিরি ঝর্ণা৷
ভ্রমন : সকাল নটা ছুঁই ছুঁই করছে৷ ঠিক তখনই সহকর্মী আলীকদম প্রেস ক্লাবের সভাপতি মমতাজের নম্বর থেকে একটি রিং বেজে উঠলে৷ তড়িগড়ি করে বের হয়ে পড়লাম৷ উদ্যেশ্য তখনো অজানা৷ পাঁচটি মটর সাইকেলে ১১ জন চড়ে বসলাম৷ মটর সাইকেলগুলো উদ্দ্যাম বেগে ছুটতে শুরু করলো৷ উদ্যেশ্য “নোনা ঝিরি ঝর্ণা”৷
পার্বত্য বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার বেশ কয়েকটি পাড়া অতিক্রম করলাম ভালোয় ভালোয়৷ তারপরই শুরু হল মটর সাইকেল নিয়ে পানি পথে চলার অভিজ্ঞতা৷ শুনতে কিছুটা কল্পকাহিনীর মত শুনাচ্ছে হয়ত৷ কিন্তু এটাই সত্যি৷ কোথাও হাটু পানি আবার কোথাও আরো কম৷ ছোট ছোট প্রাকৃতিক পাথরের বিছানাই যেন পিচ ঢালা পথ৷ কিছুটা পাথরের উপর দিয়ে চললেও কিছুটা আবার পানি পথে৷ দক্ষিন-পশ্চিম দিক থেকে উত্তর-পূর্ব দিকের পাহাড় ঢাল বিশিষ্ঠ সর্পিল পাহাড় ছড়া বেয়ে মটর সাইকেল গুলো হরিত্ কান্ডে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগলো৷ বিকৃত অীভজ্ঞতা অর্জনের আনন্দটা যেমন, তেমনি আবার খানেক অসতর্কতায় ছোটখাট দুর্ঘটনার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায়না৷
এখানে একটু করে না বললেই নয় যে, গোটা আলীকদম উপজেলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভুমি সমতল৷ যা আলীকদমের মূল প্রশাসনিক অবকাঠামোকেই ঘিরে আছে৷ অবশিষ্ঠত তিন চতুর্থাংশ ভুমি গোটা উপজেলার চার পাশে বহুবর্ষ পূর্বে নিযুক্ত কোন প্রহরীর ন্যায় দাড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল পাহাড়গুলো৷ এখানকার মূল ভৌগলিক অবস্থান দেখলে বুঝা যায় যে, মূলত আলীকদমের ভুমিঢাল দৰিন-পূর্ব থেকে উত্তর পাশ্চিম দিকে৷ কিন্তু ছোট ছোট ছড়া, খাল বা ঝিরিতে প্রবেশ করলে এই ভুমিঢালের কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা য়ায়৷
সর্পিল পাথুরে পথে প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর আমরা পৌছলাম ছাইয়া কারবারী পাড়া৷ ১০ মিনিটের যাত্রা বিরতী৷ পাড়া কারবারী দিমওয়াই ম্রো তার গাছের জাম্বুরা খাইয়ে আমাদেরকে আথিতেয়তা করলেন৷ ব্যাস ইঞ্জিন চালিত যান এপর্যন্তই৷ এর পর শুরু হবে পাঁয়ে হাঁটা পথ৷ ছাইয়া কারবারী পাড়ার পাড়া কারবারী দিমওয়াই ম্রো স্বেচ্চায় আমাদের গাইড় হতে আগ্রহ প্রকাশ করায় ঘাটে জল পেলাম৷ ১০ মিনিট যাত্রা বিরতির পর অবশেষে পথ চলা৷
এবারের অভিজ্ঞতা আরো আরো রোমাঞ্চকর৷ এতসময় দেখেছি পাথরের বিছানা আর এবার পাথরের দালান৷ তার মানে এই নয় যে, পাথর দিয়ে তৈরি দালান৷ পাথরের দালান বলতে দালানের মত বিশাল বিশাল পাথরকেই বুঝাবার চেষ্টা করেছি৷ একদিকে দিগনত্মজোড়া বিসত্মির্ণ গ্রন্থীল পাহাড়ের সারি৷ অন্য দিকে স্বচ্চ কাঁচের ন্যয় জলারাশি ছোট ছোট ঝর্ণা জলের কলকল শব্দ৷ দুর পাহাড়ে নাম না জানা হাজারো পাখির কলতান, কোথাও কোথাও পাহাড়ি ফুলে মৌ মৌ ঘ্রাণ আর মাঝে মাঝে শীতল বাতাসের ঝলকানি যেন যে গা ছুয়ে যায়৷ দুর দীগন্তের কোন এক রেখায় বিসত্মির্ণ পাহাড়ের সীমান্ত রেখায় আকাশের মিশে যাওয়া দেখে মনে পড়ে বিদ্রোহী কবির “আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, ওই পাহাড়ের ঝর্ণা আমি উধাও হয়ে বই”৷
এত আনন্দের মাঝেও তীব্র তাপদাহ কিছুটা ক্লান্ত করে তুলেছে দেহমনকে৷ এতো প্রাণ চাঞ্চল্যের অভিজ্ঞতা৷ কিন্তু ঘন্টা খানেক পাঁয়ে হাঁটার পর কিছুটা ভুতুড়ে আর থমথমে পরিবেশ কিছুটা বিচলিত করল৷ নির্জন পাহাড় আর ভুতুড়ে পরিবেশ থামিয়ে রাখতে পারেনি আমাদের অধম্য পথচলাকে৷ অধম্য নেশা প্রাণে গতি সঞ্চার করেছে শতগুন৷ অবশেষে আমাদের গন্তব্যে…………………
প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ফুটের উঁচু পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে অহর্ণিশ ঝরে পড়া কলকল জনধ্বনী দেহমনকে আরো চাঙ্গা করে দিল নিমিশেই৷ দীর্ঘ পথচলার গ্লানি যেন আমাদেরকে কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি৷ গাইডসহ ১২ জনের গোটা দলই নাইতে নেমে পড়লাম ঝর্ণার শীতল জালে৷ স্ববেগে ঝরে পড়া প্রতিটি জলকনা স্মৃতির পাতায় গাঁথা থাকবে আজীবন৷ আবেগাপ্লুত সফর সঙ্গীরা৷ এখানে সফর সঙ্গীদের নামগুলো আপনাদের জানিয়ে রাখি- মমতাজ উদ্দিন আহামেদ, ফোগ্য মার্মা, শুভরঞ্জন বড়ুয়া, উইলিয়াম, দীপু, মিনার, লিটন, জমির, মমরী ও বাপ্পী৷
চট্টগ্রামের বহুল প্রচলিত একটি কথা “কেনে চলর”৷ একথাটি কিন্তু বাদ যায়নি৷ উল্লাসের এক পর্যায়ে “কেনে চলর” চিত্কার আর মোবাইল ভিডিওতে সাক্ষাত্কার৷ সব কিছুই পরিপূর্ণ রুপ দিয়েছে ভ্রমনকে৷ আমাদের সাথে ছিল কিছু শুকনা খাবার৷ এক অবাকাশে সকলেই পাউরুটি, কলা আর কোমল পানীয় দিয়ে দেহটাকে কিছুটা সতেজ করে তুললাম৷ এরই মধ্যে শুরুহল মেঘের গুঞ্জরণ৷ চারদিক অন্ধকার হেয় এলেও যতৰন বৃষ্টির ফোটা গায়ে পড়েনি ততৰন ঠিক বুঝা যায়নি যে আকাশের কি অবস্থা৷
যাই হোক অনেক হোই হুল্লোড় আর স্মৃতির ভান্ডার পরিপূর্ণ করে এবার ফেরার পালা৷ স্থানীয় ইউপি মেম্বার শুন্যধন এর বাড়িতে খাবারের আয়োজন৷ সেই পর্যন্ত আসতেই উইলিয়ামের উপর ভর করল বিষাদ৷ নিমেষেই পানির তলার অদৃশ্য খাদে আস্ত মটর সাইকেলসহ ডুবে উঠল সে৷ অনেক চেষ্টা করে আর ষ্ঠার্ট করা গেলনা মটর সাইকেল মহাশয়কে৷ তিনি এবার কারে ঘাড়ে চড়ার কথা ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে৷ অবশেষে তাই হল……..
প্রকৃতির ভালবাসায় আমরা সিক্ত হলাম৷ আমাদের সব ক্লান্তি এখন পরিপূর্ণ হল প্রাপ্তিতে৷ মনের মধ্যে অন্য কিছুর স্থান রইলনা৷ মনের অজান্তেই সবাই বলে উঠেলো “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে”৷
যেভাবে যাবেন : বাংলাদেশের যেকোন যায়গা থেকে ঢাকা-কক্সবাজারের গাড়িতে চকরিয়া নামতে হবে৷ তার পর চকরিয়া থেকে বাস অথবা জীপ যোগে আলীকদম আসতে হবে৷ তার পর বর্ষা কালে যদি হয় তাহলে গোটা পথ পাঁয়ে হাটার বিকল্প নেই৷ শুকনো মৌসুমে হলে অবশ্যই মটর সাইকেল যোগে ছাইয়া মুরুং পাড়া (৫ কিমিঃ) পর্যনত্ম যাওয়া যাবে৷ তার পর পায়ে হেঁটে যাবেন আরো ৫ কিমিঃ৷
সঙ্গে যা যা নিয়ে যাবেন : কিছু শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গামছা অথবা প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত কাপড়, একজন গাইড আবশ্যক৷ বর্ষায় আপনার মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ও ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর নিরাপত্তার জন্য পলিব্যাগ প্রয়োজন হতে পারে৷
থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা : দুর থেকে যারা আসবেন তাদের জন্য থাকার একমাত্র ব্যবস্থা জিয়া বোর্ডিং৷ এটি মাঝারি মানের একটি বোডিং৷ যোগাযোগঃ মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন (০১৫৫৩৬০৩৯১৫)৷ আলীকদমের খাবার হোটেল গুলো মাঝারি মানের৷ খুব বেশী কিছু আশা করা ভুল হবে৷ তবে মোটামুটি চালিয়ে নেয়া যাবে৷