বৃহস্পতিবার ● ১৩ অক্টোবর ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » মানব পাচারকারীর নাম ঠিকানা র্যাবের হাতে
মানব পাচারকারীর নাম ঠিকানা র্যাবের হাতে
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :: (২৮ অশ্বিন ১৪২৩ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় রাত ১১.০১মি.) গরীব, নিম্ন আয়ের লোকজনকে অবৈধভাবে লিবিয়া পাচারের সঙ্গে জড়িত দেশের বিভিন্ন এলাকার ৩০ মানব পাচারকারীর নাম-ঠিকানা পেয়েছে র্যাব। এদের মধ্যে দুজন লিবিয়ায় বসবাসরত।
এছাড়া মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত সিলেটের দুটি ট্রাভেল এজেন্সির নামও পেয়েছে র্যাব। জরুরি ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতারের অভিযান চালানোর জন্য সকল জোনে তালিকা পাঠিয়েছে র্যাব-৭।
১৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে.কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন বলেন, লিবিয়া পাচারের সময় উদ্ধার হওয়া ৩৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ৩০ জন দালালের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করেছি। সিলেটের আল মামুন ট্রাভেলস এবং শামিম ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এই পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। মানব পাচারকারীদের গ্রেফতারের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। এর আগে বুধবার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে অভিযান চালায় র্যাব।
এসময় ভূয়া ভিসায় অবৈধভাবে লিবিয়াগামী ৩৯ জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় র্যাব।
রাতভর জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে যে ৩০ জনের নাম পাওয়া গেছে তারা হল, সিলেটের মো.লিলু, মতিউর রহমান, মো.সাইদুর, তফুর আলী, মো.ইউছুপ, আজিজুল হক শাহীন, মো.শাজিন, মো.নাসির, আজাদ তালুকদার, মো.আলমগীর, তুহিন, মো.খোকা, মো.রুমেন, মো.শাহিন, ঢাকার রাজীব, এসডি রহমান, মো.কামাল, মো.সিরাজ, মো.ফারুক, মো.হারুন, বতুল মেম্বার, মো.কাদের, দ্বীন ইসলাম, মো.স্বপন, আল আমিন মাতব্বর, কুদ্দুস সরদার এবং লিবিয়ায় বসবাসরত সাদিক ও মোজাম্মেল। এছাড়া সিলেটের আল মামুন ট্রাভেলসের মালিক মো.মামুন এবং শামীম ট্যুর এন্ড ট্রাভেলসের মালিক আদনান আনসারীর নাম তালিকায় রেখেছে র্যাব।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে.কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন প্রতিনিধিকে বলেন, চট্টগ্রামের কোন ট্রাভেল এজেন্সি কিংবা দালাল এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে কিনা সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি। উদ্ধার হওয়া ৩৯ জনের অধিকাংশই সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। কয়েকজন মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আছেন। ৩৯ জনের মধ্যে প্রায় সবার বয়স ৩০ এর নীচে।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে.কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন জানান, সিলেটের যারা বাসিন্দা তাদের অধিকাংশকে লিবিয়া হয়ে ইতালি নিয়ে যাবার কথা বলা হয়েছিল। বাকিদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য জড়ো করা হয়েছিল। ৩৯ জনের মধ্যে ১৯ জন ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর ত্যাগের অনুমতি পেয়েছিলেন। কিন্তু গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভূয়া ভিসার বিষয়টি জানতে পেরে তাদের বিমানে উঠার আগে আটকাতে সক্ষম হন র্যাব কর্মকর্তারা। ২০ জনকে বিমাবন্দরে প্রবেশের আগে আটকানো হয়। তবে ২১ জন ভূয়া ভিসা নিয়ে লিবিয়া চলে যেতে সক্ষম হয়েছে।
মিফতাহ বলেন, আমরা অভিযান শুরুর সময়ই ২১ জন বিমানে উঠে যেতে সক্ষম হয়। পাইলটের অনুমতি না পাওয়ায় তাদের নামানো সম্ভব হয়নি। তবে ২১ জনের বিষয়ে আমরা লিবিয়া দূতাবাসকে অবহিত করেছি। লিবিয়া একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সেখানে কাজের জন্য গিয়ে কোন লাভ নেই। যাদের লিবিয়া নেয়ার কথা বলা হচ্ছে তাদের সঙ্গে আসলে প্রতারণা করা হচ্ছিল। তাদের চট্টগ্রাম থেকে দুবাই হয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল অথবা আঙ্কারায় নিয়ে যাওয়া হত। তারপর সেখান থেকে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে নিয়ে যাওয়া হত। লিবিয়া বিমানবন্দর থেকে দালাল সাদিক ও মোজাম্মেল তাদের নিজের জিম্মায় নিয়ে যেত। এরপর চলত টাকা আদায়ের জন্য নির্যাতন। বলেন মিফতাহ।
সংবাদ সম্মেলনে মিফতাহ আরও জানান, লিবিয়া যাওয়ার জন্য ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য সাড়ে ৪ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল উদ্ধার হওয়া লোকজন। তবে ৩৯ জনের মধ্যে শুধু একজন এক লাখ টাকা এবং আরেকজন ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছে। বাকিদের লিবিয়া পৌঁছানোর পর টাকা দেওয়ার কথা ছিল। অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দেয়া সিলেটের কুলাউড়ার হাশিম দেশবিদেশকে জানান, স্থানীয় দালাল ওহাবের সঙ্গে ইতালি যাবার জন্য সাড়ে ৪ লাখ টাকা চূড়ান্ত করেছিল হাশিম। কিন্তু কয়েকদিন আগে হাশিম এসে জানায়, সরাসরি ইতালি যাওয়া যাবে না। লিবিয়া হয়ে যেতে হবে। এজন্য চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে যেতে হবে। ওহাবের ভাইও একইভাবে ইতালি গেছে জানতে পেরে হাশিম এই পথ বেছে নিয়েছিল বলে তিনি জানান।
অগ্রিম ১ লাখ টাকা দেয়া সিলেটের গোলাপগঞ্জের মুমিত আহমেদ প্রতিনিধিকে বলেন, প্রথমে সরাসরি ইতালি যেতে পারব জানার পর এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম। বাকি টাকা ইতালি গিয়ে কাজ করে দেয়ার কথা ছিল। তিনি জানান, শরীফ নামে লন্ডনে বসবাসরত এক দালালের মাধ্যমে সে ইতালি যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করে। দুই মাস আগে শরীফ লন্ডনে পাড়ি জমায়।
সাঈদ কাজী নামে মাদারীপুর থেকে আসা এক যুবক প্রতিনিধিকে বলেন, ঢাকার ফকিরাপুলের নাছির দালাল আমাকে বলেছিল, লিবিয়া যেতে পারলে কাজের অভাব হবে না। বেকার মানুষ, আমি তার কথায় রাজি হয়েছিলাম। আব্দুর রশিদ নামে একজন বলেন, আমরা লেখাপড়া বেশি জানি না। বাংলা লিখলে না হয় বানান কর পড়তে পারতাম। ইংলিশে লিখছে, সেগুলো তো পড়তে পারি নাই। ভিসা আসল নাকি নকল, আমরা ক্যামনে জানব ?
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার সাইদুল এবং সিলেটের বিশ্বনাথের মজিদের ভিসা ছিল ট্যুরিস্ট ভিসা। সময় ছিল এক মাস। মজিদ জানায়, সরাসরি ইতালি নেবার কথা বলে তার কাছ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা চেয়েছিল দালাল। আইপিএস বিক্রির ব্যবসায় লোকসান গুণে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখেছিল সিলেটের ছাতকের মো.লিটন। কিন্তু র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বুঝতে পেরেছে সে প্রতারিত। লিটন প্রতিনিধিকে বলেন, সুমন আর সাজিব (দালাল) আমাকে বলেছিল ইতালি যেতে পারলে মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করতে পারব। চট্টগ্রামে আসার পর তাদের আর খুঁজে পাইনি।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে.কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে ৮-১০ জন করে মাইক্রোবাসে করে এনে ঢাকার ফকিরাপুলে বিভিন্ন হোটেলে রাখা হয়েছিল। এরপর বাসে করে তাদের চট্টগ্রাম নগরীতে এনে অলংকার মোড়ে হোটেলে রাখা হয়। অপরিচিত কয়েকজন লোক এসে তাদের পাসপোর্ট-ভিসা দিয়ে যায়। রাতেই তাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। দুবাইগামী এয়ার এরাবিয়ার দুটি বিমানে করে বুধবার রাতে ৭০ জন করে ১৪০ জনের চট্টগ্রাম ত্যাগের কথা ছিল। কিন্তু অভিযানের খবর পেয়ে সবাই বিমানবন্দরে আসেনি। ভূয়া ভিসার বিষয়ে মিফতাহ বলেন, ৩৯ জনের মধ্যে যাদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়েছে তাদের প্রত্যেকের ভিসা ইস্যুর তারিখ ৫ অক্টোবর। প্রত্যেককে ৩০ দিনের ভিসা দেয়া হয়েছে। বাকি ২০ জনের মধ্যে ১০ জন শেষ হয়ে গেছে এমন ভিসা আছে দুটি। ১০ জুনের চারটি ভিসার ফটোকপি আছে। বাকি সব ভিসার মেয়াদ মাত্র একদিন। তদন্তে জেনেছি, সব ভিসাই ভূয়া। বলেন মিফতাহ। ভূয়া ভিসা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথাও জানিয়েছেন মিফতাহ।