বৃহস্পতিবার ● ২২ অক্টোবর ২০১৫
প্রথম পাতা » অপরাধ » বহুল আলোচিত প্রবাসীর স্ত্রী সুজিনা হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেফতার
বহুল আলোচিত প্রবাসীর স্ত্রী সুজিনা হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেফতার
বিশ্বনাথ (সিলেট ) প্রতিনিধি::সিলেটের বিশ্বনাথে আলোচিত যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুরাদ আহমদের ২য় স্ত্রী সুজিনা হত্যা মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ৷ বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেট শহরের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ ৷ গ্রেফতারকৃত নাম জুনাব আলী (৪০)৷ সে জগন্নাথপুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সুন্দর আলীর ছেলে ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুরাদ আহমদের ১ম স্ত্রী ছাবিনা বেগমের সত্ ভাই ৷
পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে হত্যা মামলার অপর গ্রেফতারকৃত আসামি গয়াছ মিয়ার সিলেট নগরীস্থ বাসা থেকে জুনাব আলীকে গ্রেফতার করা হয় ৷ তার বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা রয়েছেন ৷ কিছুদিন পূর্বে পৃথক অভিযান চালিয়ে ওই হত্যা মামলার আরও দুই আসামিকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করা হয় ৷ গ্রেফতারকৃত অপর আসামি গয়াছ মিয়া চলিত বছরের ২৫ জুলাই সিলেট জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট জেরিন আক্তারের আদালতে কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে ৷ জবানবন্দিতে ঘাতক গয়াছ জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুরাদ আহমদের ১ম স্ত্রী সাবিনা বেগমের পরিকল্পনায় ও ৬ লক্ষ টাকার চুক্তিতে প্রবাসীর ২য় স্ত্রী সুজিনা বেগমকে হত্যা করা হয়েছে ৷
সুজিনার পরিচয় - বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর (পশ্চিমপাড়া খালপাড়) গ্রামের মৃত হাজী আব্দুর রউফের মেয়ে ও জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি (সাতহাল) গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুরাদ আহমদের ২য় স্ত্রী সুজিনা বেগম (১৯)৷ নিহতের প্রায় সাড়ে ৩মাস পূর্বে মুরাদের সঙ্গে বিয়ে হয় সুজিনার ৷ বিয়ের পর থেকে সুজিনা তার মায়ের সঙ্গে পিত্রালয়ে বসবাস করে আসছিলেন ৷
যেভাবে হত্যা করা হয় সুজিনাকে - চলিত বছরের ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পরপরই অতিথির পরিচয়ে হাতে বনফুলের মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সুজিনার পিতার বাড়িতে আসে অজ্ঞাতনামা চার ঘাতক ৷ ঘাতকরা দরজায় নক করলে সুজিনার মা তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা জানায় সুজিনার স্বামী মুরাদের পূর্ব পরিচিত ৷ এরপর তাদেরকে বসতে দেয়া হয় এবং তাদের জন্য সুজিনা ও তার মা রেজিয়া বেগম নাস্তা তৈরি করেন ৷ কিন্তু আপ্যায়নের পূর্বেই ঘাতকরা ঝাপটে ধরে সুজিনাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে থাকে ৷ এসময় সুজিনার মা এগিয়ে এলে তাকেও আঘাত করে ঘাতকরা ৷ এক পর্যায়ে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত সুজিনা ও তার মা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ঘাতকরা পালিয়ে যায় ৷ এসময় সুজিনার একমাত্র ছোট ভাই জহির উদ্দিন (১২) ঘর থেকে বের হয়ে চিত্কার শুরু করলে আশপাশ বাড়ির লোকজন ছুটে আসেন এবং সুজিনা ও তার মাকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে প্রেরণ করেন ৷ কিন্তু হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই সুজিনার মৃত্যু হয় ৷ ময়নাতদন্ত শেষে গত ২০ জুলাই রাতে সুজিনার মামার বাড়ি উপজেলার বাহাড়া দুভাগ গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয় ৷
সেই স্বীকারোক্তিতে যা ছিল ঘাতক গয়াছ - গ্রেফতারের পর গত ২৫ জুলাই সিলেট জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট জেরিন আক্তারের আদালতে হাজির করা হয় ঘাতক গয়াছ মিয়াকে ৷ কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গয়াছ বলে, ৬ লক্ষ টাকা চুক্তির বিনিময়ে হত্যা করা হয়েছে সুজিনাকে ৷ প্রবাসী মুরাদের ১ম স্ত্রী যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাবিনা বেগম তার সত্ ভাই জুনাব আলীর মাধ্যমে গয়াছসহ অন্য ৫জনের সঙ্গে হত্যার এই চুক্তি করা হয় ৷ সাবিনার সত্ ভাই জুনাব আলী, চাচাতো ভাই আওলাদ, গ্রেফতারকৃত গয়াছ ও সজলু সহ আরো অজ্ঞাতনামা ৩জন এই হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত ছিলো ৷ গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় একটি মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে সুজিনার বাড়িতে যায় ঘাতকরা ৷ ওই সময় জুনাব আলী ও আরো অজ্ঞাতনামা ২জন বাড়ির বাইরে অবস্থান করে এবং আওলাদ, গয়াছ, সজলু ও অন্য অজ্ঞাতনামা আরো একজন সুজিনার ঘরে অতিথি পরিচয়ে প্রবেশ করে ৷
স্বীকারোক্তিতে গয়াছ জানায়, সুজিনাকে ধারালো ছুরি ও চাকু দিয়ে সুজিনাকে কুপাতে থাকে আওলাদ, সজলু ও অন্য আরেকজন এবং সুজিনার মা রেজিয়া বেগমের পেটে ছুরি দিয়ে কুপ দেয় সে (গয়াছ) নিজেই ৷ এরপর তারা পালিয়ে যায় ৷
গয়াছ জানায়, ৬ লক্ষ টাকার চুক্তির মধ্যে তার (গয়াছের) সাথে ২০ হাজার টাকার চুক্তি হয় ৷ এর মধ্যে ঘটনার পূর্বে তাত্ক্ষণিক তাকে ২ হাজার টাকা প্রদান করে সাবিনার ভাই ঘাতক জুনাব আলী ৷ গয়াছের পুরো জবানবন্দি থানার ওসি রফিকুল হোসেন স্থানীয় সাংবাদিকদের অবহিত করেন ৷
১৬৪ ধারায় স্বীকারুনক্তিতে ঘাতক গয়াছ জানায়, হত্যার ঘটনায় সে (গয়াছ)সহ মোট ৭জন ঘাতক সরাসরি জড়িত ছিলো ৷ তারা হলো- জগন্নাথপুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সুন্দর আলীর ছেলে ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুরাদ আহমদের ১ম স্ত্রী সাবিনা বেগমের সত্ ভাই কুখ্যাত ডাকাত জুনাব আলী, সাবিনার চাচাতো ভাই একাধিক ডাকাতি ও হত্যা মামলার সাঁজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী আওলাদ মিয়া, জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী গ্রামের মৃত জহির উল্লার পুত্র গয়াছ মিয়া, একই উপজেলার জহিরপুর গ্রামের মৃত মন্টু রাজা চৌধুরীর পুত্র কুখ্যাত ডাকাত সজলু রাজা চৌধুরী ৷ এছাড়া আরো অজ্ঞাতনামা ৩ ঘাতক হত্যায় জড়িত রয়েছে বলে আতালতে স্বীকারোক্তিতে গয়াছ জানায় ৷
কে এই সাবিনা - জগন্নাথপুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সুন্দর আলীর মেয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছাবিনা বেগম ৷ প্রায় ১৪ বছর পূর্বে পার্শবর্তি শ্রীরামসি সাতহাল গ্রামের মুরাদ হোসেনের সাথে বিয়ে হয় সাবিনার৷ বিয়ের পর তাদের পরিবারের জন্ম নেয় একে একে ৩টি সন্তান ৷ বিয়ের প্রায় ৫বছর পর থেকে সাবিনা-মুরাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় মনোমালিন্য ৷ একপর্যায়ে পৃথক বসবাস শুরু করেন সাবিনা ও মুরাদ ৷ কয়েক বছর ধরে এই বিরোধ আরো জটিল হয়ে পড়ে ৷ সুজিনা হত্যার প্রায় সাড়ে ৩মাস পূর্বে দেশে এসে সুজিনাকে বিয়ে করেন মুরাদ ৷ আর এই বিয়েটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি মুরাদের প্রথম স্ত্রী সাবিনা ৷ মুরাদ বিয়ে করে লন্ডন চলে যাবার পর দেশে আসেন সাবিনাও ৷ এসময় মুরাদ-সুজিনার বিয়ে ভেঙ্গে দিতে মুরাদের পরিবারকে চাপ সৃষ্টি করেন সাবিনা ৷ কিন্তু এই চাপের কাছে কিছুতেই রাজি হননি মুরাদের পরিবার ৷ এরপর প্রায় ১মাস দেশে অবস্থান করে লন্ডন চলে যান সাবিনা ৷
যেভাবে মামলা দায়ের - সুজিনাকে হত্যার ঘটনায় তার মামা ক্বারী আব্দুন নূর বাদি হয়ে গত ২৮ জুলাই সুজিনার সতিন সাবিনা বেগম, তার মা ও ২ভাই এর নাম উল্লেখ করে ও আরো ৪/৫ জন অজ্ঞাতনামা আসামী করে একটি হত্যা মামলা করেন ৷ মামলা নং ১৪৷
স্বপ্নের দেশে ব্রিটেনে যাওয়া হল ন।
সুজিনার - স্বামীর প্রথম স্ত্রী রয়েছে শুনেও স্বপ্নের দেশে ব্রিটেনে যাওয়ার জন্য বিয়ের পিড়িত বসেন তরুনী সুজিনা ৷ অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসীর কাছে বিয়েতে রাজি হন সুজিনা ৷ কিন্তু ঘাতকরা টাকার বিনিময়ে তার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয় ৷ সুজিনাকে চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে ৷ ভেঙ্গে যাওয়া তার সেই স্বপ্ন ৷ তার বৃদ্ধা মাকে কুপিয়ে আহত করে ঘাতকরা ৷ এখনও তিনি হাসপাতালে রয়েছেন ৷
পুলিশের বক্তব্য - বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইনচার্জ রফিকুল হোসেন জানান, সুজিনা হত্যা মামলা দায়েরের পরপরই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের অভিযানে পুলিশ নামে ৷ হত্যার ৪৮ ঘন্টায় মাথায় প্রবাসীর স্ত্রী সুজিনা হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত দুই ঘাকতকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৷
তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃত গয়াছ ওই সময় পুলিশের কাছে বলেছিল ছয় লক্ষ টাকার চুক্তিতে সুজিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় ৷ আর ওই পরিকল্পনা করা হয় প্রবাসীর ১ম স্ত্রী সাবিনার সঙ্গে দেশে থাকা তার ভাই জুনাব আলীর ৷ গয়াছকে ২০ হাজার টাকায় দেয়ার কথা হলেও ঘটনার পর দুই হাজার টাকা দেয়া হয়৷ চাকু দিয়ে সুজিনার মাকে গয়াছ কুপিয়েছে বলে সে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে ৷
তিনি আরও বলেন, প্রবাসীর প্রথম স্ত্রী সাবিনা বেগমের পরিকল্পনায় প্রবাসীর ২য় স্ত্রী সুজিনাকে ছয় লাখ টাকার চুক্তি হয়েছে বলে তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের জানান ৷
অবশেষে মামলার প্রধান আসামি জুনাব আলীকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয় ৷ শুক্রবার তাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে বলে তিনি জানান ৷
আপলোড : ২২ অক্টোবর ২০১৫ : বাংলাদেশ : সময় : রাত ৮.২৫ মিঃ