সোমবার ● ১৭ অক্টোবর ২০১৬
প্রথম পাতা » জাতীয় » মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদী আর নেই
মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার মাহবুবুর রব সাদী আর নেই
নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি :: (২ কার্তিক ১৪২৩ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় রাত ১০.১৬মি.) নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর এলাকার কৃতি সন্তান মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার ও নবীগঞ্জ-বাহুবল আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবুর রব সাদী আর নেই৷
১৬ অক্টোবর রবিবার দিবাগত রাত ২:৩০ মিনিটে চিকিত্সাধীন অবস্থায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন৷ (ইন্নালিল্লহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)৷ মৃত্যু সময় বাংলার সূর্যসন্তানের বয়স হয়ে ছিল ৭৫ বছর ৷ অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর রোববার হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়৷ রাতে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান৷
পরে তার লাশ নিয়ে আসা হয় জন্মস্থান নবীগঞ্জে৷ বেলা ৩ টায় নবীগঞ্জ জে কে সরকারী স্কুল মাঠে প্রথম এবং বিকাল সাড়ে ৪ টায় দিনারপুর সাতাইহাল ফুটবল মাঠে দ্বিতীয় জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়৷
এসময় জানাযার নামাজে হাজার হাজার মানুষে লোকারণ্যে পরিণত হয় পরে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেরাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়৷
পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায় মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় নিয়ে যাওয়া হবে পরে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে বলে জানা গেছে৷
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফনের কথা রয়েছে৷ শারিরিক সমস্যা নিয়ে ৩ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মাহবুবুর রব সাদী৷ রবিবার চিকিত্সাধীন অবস্থায় তার হার্ট অ্যাটাক হয়৷ এরপর চিকিত্সকরা তাকে আইসিইউতে নেয়ার পরামর্শ দেন৷ মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রব সাদীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে নবীগঞ্জ-বাহুবলে৷ এই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য সাদী ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে৷
১৯৪৫ সালের ১০ মে উপজেলার বনগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহন করেন দিনারপুর পরগণার এই উজ্জ্বল নক্ষত্র৷ তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন সহ আরো বিভিন্ন মহল৷
সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ ও নিহতের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন নবীগঞ্জ বাহুনলের সংসদ সদস্য এম এ মুনিম চৌধুরী বাবু, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাজিনা সারোয়ার, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জীতেন্দ্র কুমার নাথ, উপজেলা জাসদের সভাপতি আব্দুর রউফ, পৌরসভার সাবেক মেয়র ও নবীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ইমদাদুর রহমান মুকুল, সাধারন সম্পাদক সাইফুল জাহান চৌধুরী, পৌরসভার প্যানেল মেয়র এটিএম সালাম ও নবীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি প্রভাষক উত্তম কুমার পাল হিমেল প্রমুখ ৷
এছাড়াও বিভিন্ন মহলের লোকজন শোক প্রকাশ করেন৷
উল্লেখ্য, মাহবুবুর রব সাদী ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন৷ পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান৷ মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে তিনি (৪) নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন৷ তাঁর আওতাধীন এলাকা ছিল আটগ্রাম, জকিগঞ্জ ও লুবাছড়া৷ উল্লেখিত এলাকা ছাড়াও কানাইঘাট এলাকায়ও অপারেশন করেন৷ তাঁর নেতৃত্বে বা পরিচালনায় অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়৷
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য মাহবুবুর রব সাদীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়৷ ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৫১৷ কানাইঘাট থানা আক্রমণে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তিনি এ খেতাব পান৷ ১৯৯২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা ও পদক প্রদান করে তখন তাঁকেও আমন্ত্রণ জানানো হয় কিন্তু তিনি অংশগ্রহণ করেননি৷
তার কারন গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনে কোনো অংশে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কম ছিলেন না৷ গণবাহিনীর কাউকেই বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়া হয়নি কয়েকজন বীরশ্রেষ্ঠ ও আরও অনেকে বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক উপাধি পাওয়ার যোগ্য ছিলেন৷ কিন্তু দেওয়া হয়নি৷ এ কারণেই এই দেশ প্রেমিক খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ৷’
তার যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম ঘটনা হল ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে এক রাতে ছিল মেঘমুক্ত আকাশ অন্ধকার তেমন গাঢ় ছিল না৷ দূরের অনেক কিছু চোখে পড়ছিল তার৷ এমন রাতে বাংলাদেশের ভেতরে প্রাথমিক অবস্থান থেকে মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রওনা হয়েছিলেন লক্ষ্যস্থলে৷
তিনি ছিলেন সামনে তাঁর পেছনে ছিলেন সহযোদ্ধারা আর একদম আগে ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক৷
চা-বাগানের পথ দিয়ে তাঁরা কানাইঘাট যান৷ তখন চারদিক নিঃশব্দ এবং সবাই গভীর ঘুমে ছিল৷ পুলিশও জেগে ছিল না৷ শুধু দুজন সেন্ট্রি জেগে ছিল৷ আক্রমণের আগে সাদী চেষ্টা করেন সেন্ট্রিকে কৌশলে নিরস্ত্র করে পুলিশদের আত্মসমর্পণ করানোর৷ এ দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধেই নেন৷ একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে তিনি থানায় যান বাকি সবাই আড়ালে তাঁর সংকেতের অপেক্ষায় করছিলেন৷
সাদী থানার সামনে গিয়ে দেখেন, সেন্ট্রি দুজন ভেতরে চলে গেছে ফলে তিনি আড়ালে অপেক্ষায় থাকেন একসময় একজন সেন্ট্রি বেরিয়ে আসে এবং তাঁদের দেখে চমকে ওঠে; আচমকা ভূত দেখার মতো অবস্থা সাদী মনে করেছিলেন, সেন্ট্রি ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করবে কিন্তু সে তা করেনি৷
সেন্ট্রি তাঁর দিকে অস্ত্র তাক করে তখন সাদীও তাঁর অস্ত্র সেন্ট্রির দিকে তাক করেন৷ কিন্তু এর আগেই সেন্ট্রি গুলি করে ভাগ্যক্রমে রক্ষা পান তিনি কেবল তাঁর মাথার ঝাকড়া চুলের একগুচ্ছ চুল উড়ে যায় গুলির শব্দে ঘুমন্ত পুলিশরা জেগে ওঠে এবং দ্রুত তৈরি হয়ে গুলি শুরু করে৷
ওদিকে সাদীর সহযোদ্ধারাও সংকেতের অপেক্ষা না করে গুলি শুরু করেন৷ ফলে সাদী ও তাঁর সঙ্গে থাকা সহযোদ্ধা ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে যান৷ তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে যায় অসংখ্য গুলি৷ অনেক কষ্টে তাঁরা থানার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন৷ পরে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায় ৷ পুলিশরা পালিয়ে যায়৷ মাহবুবুর রব সাদী স্বাধীনতার পর ব্যবসার পাশাপাশি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ এছাড়া একবার হবিগঞ্জ এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷