বুধবার ● ২ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম » সব অপমান ডাক্তারদের জন্য
সব অপমান ডাক্তারদের জন্য
ডা. শেরিন সাবিহা তন্নী :: একটা কথা আমি প্রায়ই বলি। সাধারণ মানুষের একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। তারা ডাক্তারদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সম্বলিত সাধারণ মানুষ ভাবে না। তারা ডাক্তারদের ভাবে কোন অলৌকিক মেশিন- যারা চব্বিশ ঘন্টা মানুষের সেবায় আত্মদান করবে। যা একটা মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব।
চাওয়া আর পাওয়ার বিস্তর ফারাকের কারণে আজ ধ্বংস প্রায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত। অথচ সঠিক চিত্রটা তাদের অজানা।
আজকাল ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের থেকে ডাক্তাররা কমিশন নেয়- খুব প্রচলিত একটা কথা। আপনারা কি জানেন সেটা কতটুকু ?
ডায়াগনষ্টিক সেন্টার রুগীর পরীক্ষা ফি. বাবদপ্রাপ্ত টাকাটার একটা অংশ রেফারেল ফি. হিসেবে দেন। কাদের দেন ? ডাক্তার হতেই হবে, এমন কথা নেই। যে রেফার করবে সেই এই ফিঃ পাবে। কিছু কিছু পরীক্ষা নীরীক্ষা চিকিৎসক নিজে করেন বলে উনি একটা অংশ ফিঃ হিসেবে পাবেন। আর বাকী পরীক্ষাগুলোতে চিকিৎসক রিপোর্ট করেন না বলে পুরো টাকাই ডায়াগনষ্টিক সেন্টার পায়।
একজন MBBS, MD (Radiology) রিপোর্টিং ডাক্তার….পাঁচ বছর এমবিবিএস, পাঁচ বছর ভয়ানক কঠিন এম ডি পাস করে রিপোর্ট করতে বসলেন। আর পাড়ার ফার্মেসী থেকে প্রেসক্রিপশন এলো UG of hole abdomen…! তখন ঐ এমডি করা ডাক্তার hole (গর্ত) কে whole (সম্পূর্ন) আলট্রাসনো পরীক্ষা করে যে টাকা পাবে আর এই hole ফার্মেসী দোকানদার রেফারেল ফিঃ হিসেবে সমান টাকা পাবে,, এই চরম সত্যটা কি সকলের জানা উচিত নয় ???
ঐ চিকিৎসকই সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট করতে বসলে আঠার বছর বয়সী প্রেগন্যান্ট রুগীর দুবার বমি হলো আর হেল্থ এসিস্যান্ট লিখে পাঠালেন,, সিটি এসকান - ব্রেইন্ট। এম ডি করা ডাক্তারের সাধ্য নাই ঐ প্রেগন্যান্ট মেয়েকে অকারণ এতটা রেডিয়েশন হ্যাজার্ড থেকে রক্ষা করার। কারণ, ফিল্ম যখন সে পায় রিপোর্ট করার জন্য তখন সিটি এসকান ব্রেইন্ট শেষ। আর ঐ ব্রেইন্ট লেখা হেল্থ এসিস্যান্ট তত টাকা পাবে- যত টাকা রেডিওলোজিষ্ট ডাক্তার ব্রেইন সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট করে পাবে !!
খুব সামান্য সংখ্যক ডাক্তার কমিশনের লোভে রুগীকে অতিরিক্ত পরীক্ষা দেয়। রুগী বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতারিত হয়। আর ব্যবসায়ীরা জানে চিকিৎসা বিষয়ক সব প্রতারণা, অন্যায়ের দ্বায়ভার ডাক্তারের উপরেই পড়বে। তাই দ্বিগুণ উদ্যমে অপকর্ম করে যায়।
চিকিৎসা পেশা আজ ব্যবসায়ী বেনিয়া চক্রের ঘৃণ্য শিকার।
একের পর এক গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ কয়েকজন ভাগ্যহত মোটামুটি মানের ছাত্রদের সাথে অতিরিক্ত মুনাফার আশায়,, বিপুল টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের হাতে তুলে দিচ্ছে ডাক্তারী বিদ্যা। যা আমাদের জন্য কামাই করছে চরম দুর্নাম। কোটি কোটি টাকা মুনাফা আদায় করা মালিকগণ দারোয়ানের সমান বেতন দিচ্ছে তাদের কলেজের এক একজন লেকচারারকে !!
কেউ ঐ মালিকদের চেনে না। গালি ও দেয় না। সব অপমান জমা ডাক্তারদের জন্য।
কোটি কোটি টাকার স্থাপনাতে গড়ে ওঠা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের মালিকগণ চেম্বারের ঐ কবুতরের খোপের মাঝে বন্দী করে ডাক্তারদের সব আলো মাখা বিকেল, বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা। ডাক্তাররা ততটাই জিম্মি যতটা রুগীরা।
ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের বাইরে জ্বলজ্বলে অক্ষরে ডাক্তারের নাম থাকে, মালিকের নয়। তাই হাজার কোটি টাকা হাতড়ে নিচ্ছে মালিকগণ। দোষ হচ্ছে প্রফেসরদের! ক এর পরে খ জানে না, এমন রুগীরাও তাদের মা বাপ তুলে গালি দেয়।
আর একটা মজার খেলা খেলছে ঔষধ কোম্পানীর মালিকগণ। ঔষধের নাম খোদাই করা দু’প্যাকেট টিস্যু, ফিরনী সেট, গ্লাস সেট, কফি মগ, প্যাড আর কলম। এর বিনিময়ে কোটি টাকার বদনাম কামাচ্ছে ডাক্তাররা। আর শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করছে মালিকগণ। যথাসময়ে মালিক হচ্ছে টিভি চ্যানেলের। হলুদ সাংবাদিকদের দিয়ে বাঁশ দিচ্ছে সেই ডাক্তারদের- যাদের কলমের খোঁচায় দু’টাকার ঔষধ ওরা পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। তবু আমরা নিরুপায়।
ডাক্তারদের মধ্যে একতা না থাকার কারণে যে যাকে যেখানে পাচ্ছে ভাংছে। সাধারণ জনগণ সত্যের ধারে কাছেও নেই। ঢালাও ভাবে এই চক্রাকারে আবর্তিত তাদের কষ্ট, দুর্ভোগের দ্বায়ভার ডাক্তারদের দিচ্ছে। আর আমরা মাথা পেতে এই অপবাদ মেনে নিচ্ছি।
আমি বলব না ডাক্তারদের মধ্যে মন্দ লোক নেই। আছে। তাদের সংখ্যা অতি নগন্য।
এই নগন্য সংখ্যক ডাক্তার আর অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের হীন স্বার্থের কারণে আমি চিকিৎসক আর চিকিৎসা পেশার চরম অপমান, অবমাননা মেনে নিব,, নাকি সত্যটাকে সকলের কাছে তুলে ধরব— সে সিদ্ধান্ত আজ আমাকেই নিতে হবে।
লেখক: ডা. শেরিন সাবিহা তন্নী,বিসিএস (স্বাস্থ্য), মেডিকেল অফিসার।
সূত্র : মেডিভয়েস