মঙ্গলবার ● ৮ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » শহীদ বুদ্ধিজীবি অনুদ্বৈপায়নের আর বিদেশ যাওয়া হয়নি
শহীদ বুদ্ধিজীবি অনুদ্বৈপায়নের আর বিদেশ যাওয়া হয়নি
উত্তম কুমার পাল হিমেল :: (২৪ কার্তিক ১৪২৩ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.০৩মি.) হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার করগাঁও ইউনিয়নের জন্তরী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাম্মন মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৪৫ সালের ৩১শে জানুয়ারী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য জন্ম গ্রহন করেন৷ পিতা স্কুল শিক্ষক দিগেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য্য এই অঞ্চলের একজন নামকরা আয়ুবের্দিক চিকিত্সক এবং মাতা রাজলক্ষী ভট্টচার্য্য একজন আদর্শ গৃহিনী ছিলেন৷ ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনিই বড় ছিলেন৷ ছোট ভাই বোনেরা হচ্ছেন শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য,দিবাকর ভট্টাচার্য্য,কল্যানী ভট্টা্চার্য্য,যুথী ভট্টাচার্য্য এবং বাংলাদেশে একমাত্র উত্তরাধিকারী প্রীতিলতা ভট্টাচার্য্য৷
পরিবারের বড়ছেলে হিসাবে অনুদ্বৈপায়নের ওপর অনেক আশা নিয়ে তাকিয়েছিল তাঁর পরিবারের লোকজন৷ ১৯৫৬ সালে নবীগঞ্জ যোগল কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হন অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য৷ একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে আজও তার সুখ্যাতি রয়েছে৷ তাঁর সঙ্গে একই ক্লাশে পড়তেন নবীগঞ্জ যোগলকিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন আহমেদ, কানু বনিক,মকসুদ আলী,অনিলবনিক,আব্দুল হাই,কৃষ্ণ দেবনাথ,অনিমা রানী দাশ,আশালতা দে,ভাগ্য রানী বনিক প্রমূখ৷ আলা উদ্দিন আহমদ সহপাঠী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য সম্পর্কে বলেন, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য চলাচলে ছিল খুবই সাদাসিধে ৷ সব সময় একটু অগোছলো ভাবে থাকতো৷ নানা বিষয়ে যুক্তি দেখিয়ে স্যারদের সাথে তর্কে লেগে যেত৷ তখন ছিল ফাউন্টেন পেনের যুগ৷ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের শার্টের পকেট সব সময় কলমের কালিতে ভরা থাকত৷ এ নিয়ে তাকে আমরা কথাও শোনাতাম৷ আমরা সবাই যখন স্কুলের টিউবওয়েলে পানি খেতে যেতাম,তখন অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য পানি খেত না৷ ওর ধারনা ছিল অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে পানি পান করা ঠিক না৷ আমি পুলতিক হই ওর খোলাস পাল্টানো দেখে৷ ভার্সিটি বন্ধ বাড়িতে এসেছে৷ আমার বাড়িতে এসে আমাকে বলছিল, তোরা ভাল মাংশ রাধতে জানিস,আজ তোদের বাড়ীতে খাব৷ ওর পরিবর্তনের কথা জানতে চাইলে অনুদ্বৈপায়ন আমাকে হেসে হেসে বলেছিল,”আলাউদ্দিন আগে ছিলাম ব্রাম্মন,এখন হয়েছি মানুষ৷” তিনি বলেন আমিখুবই ভাগ্যবান যে একজন পুর্নাঙ্গ মানুষ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের বন্ধু ছিলাম৷ ১৯৬১সালে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য গণিত এবং সংস্কৃত বিষয়ে লেটার মার্কসহ ম্যাট্রিকুলেশন(এসএসসি) পাস করেন৷ পরে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে ভর্তি হন৷ থাকতেন মুরারী চাঁদকলেজের শ্রীকান্ত ছাত্রাবাসে৷ সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন তপন কান্তি ধর,রনবীর দত্ত,অনিক বনিক,সুভাস চন্দ্র,আদিত্য,দিপ্তেন্দু চক্রবর্তী,শক্তিপদ ঘোষ, মকলুকুর চৌধুরী৷ সেই সময়ে ছাত্রবাসে ছিলেন এমসি কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ শ্রীনিবাস দে৷ স্মৃতি রোমন্থনে শ্রীনিবাস দে বলেন,একই স্থানে বাড়ী হওয়ার সুবাদে আমার সঙ্গে অনুদ্বৈপায়নের ঘনিষ্টতা ছিল বেশী৷ কোন সমস্যা হলে আমার রুমে আসত৷ দাদা বলে সম্বোধন করত৷ বইয়ের প্রতি তার নেশা ছিল বেশী৷ ১৯৬৩ সালে তিনি ইন্টামিডিয়েটে প্রথম বিভাগে মেধা তালিকায় ১১ তম স্থান অধিকার করে৷ এরপর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন৷ থাকতেন জগন্নাথ হলে৷ ১৯৬৬ সালে পদার্থবিদ্যা ভিাগে প্রথম শ্রেণীতে ৩য় স্থান অধিকার করে বিএসসি সম্মান ডিগ্রী লাভ করেন৷ ১৯৬৭ সালে তিনি নবপ্রতিষ্টিত ফলিত পদার্থ বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করে এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন৷ এর পরের বছরই ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন৷ একই বছর তিনি জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক হিসাবেও নিযুক্তি পান৷ পদার্থবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা গ্রহনের তীব্রতা ছিল তাঁর বেশী৷ তাই বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে গবেষনায় যেতে চেয়েছিলেন৷ ১৯৭০ সালে বাড়ীতে মাকে চিঠিতে লেখেন,স্কলারশীপটা এবারও হলো না মা,অসুবিধা খুববেশী৷ যাক, চিন্তার কোন কারন নেই৷ তোমার আশীর্বাদ থাকলে যত দেরীই হোক বিদেশ আমি যাবই৷ কেই আটকাতে পারবে না৷ কারন পিএইচডি ডিগ্রীটা অনেকেই বেশী বয়সেও করে থাকে৷ কাজেই আমি নিজেও এজন্য চিন্তা করছি না৷ পরিবেশ যখন খারাপ কষ্ট তো করতেই হবে৷
অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য এর মেধা প্রজ্ঞার দরুন বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে ৷ কলম্বো প্লানের বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যাওয়ার জন্য তাঁর প্রস্তুতি প্রায় শেষ৷ ফ্লাইটের তারিখও সময় নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ রাতে৷ তাই ২০শে মার্চ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য নবীগঞ্জে বাড়ীতে এসেছিলেন মা-বাবা,ভাইবোন,বন্ধু-বান্ধবও আত্মীয় স্বজনকে বলে বিদায় নিতে৷ দুদিন থাকেন বাড়ীতে৷ ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ সকাল ৭ টার সময় মা-বাবাকে প্রণাম করে বাড়ী থেকে রওয়ানা হন অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য৷ বের হওয়ার সময় দেশের পরিস্থিতির জন্য তাঁর মা যখন যেতে মানা করেছিলেন৷
অনুদ্বৈপায়ন তখন বলেছিলেন, মাগো দেশের প্রধান বিদ্যাপীঠের শিক্ষক হয়েও কাপুরুষের মত বাড়ীতে থাকার জন্য তোমার অনুদ্বৈপায়নের জন্ম দাওনি৷ বাড়ী থেকে যাওয়ার প্রাক্কালে তার সঙ্গে শেষ দেখা হয় অনেকেরই প্রয়াত চারু চন্দ্র দাশের বাসায়৷ সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রয়াত উপাচার্য মো. হাবিবুর রহমান,কর্নেল(অবঃ) সি কে দাশ, প্রয়াত মিহির কুমার রায় মিন্টু, আলাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকের সঙ্গেই৷
২৫ শে মার্চ সকাল ৯ টার দিকে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য জগন্নাথ হলের ব্যাচেলর রুমে পৌছেন৷ ওই দিন বিকাল ৪ টার সময় বন্ধু নির্মল মন্ডল দেখা করতে আসেন তাঁর সাথে৷ অনেক সময় আলাপ হয় তাদের মধ্যে৷ রাতে আবার আসার কথা থাকলেও আর আসা হয়নি৷ সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গিয়েছিলেন বন্ধু ও সহকর্মীদের সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে যেতে৷ পরদিন রাতেই স্বপ্ন পূরনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর কথা ছিল৷ মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সব তছনছ হয়ে অনুদ্বৈপায়নকে পাড়ি দিতে হলো না ফেরার দেশে৷ ২৬মে মার্চ সকাল বুলেটের আঘাতে রুমের দরজা ভেঙ্গে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যকে বের করে পাকবাহিনীর জোয়ানরা৷ অনুদ্বৈপায়নের হাত দুটো পেছন মোড়া করে বেধে উপুর করে বসিয়ে রেখেছিল এবং তার সারা শরীর রাইফেলের বাঁট-বুট দিয়ে আঘাত করতে করতে অজ্ঞানকরে ফেলেছিল৷ পরে জগন্নাথ হলের দক্ষিনবাড়ীর সামনে অন্যান্যদের সাথে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তাকে৷ একই সঙ্গে নিহত হন বিখ্যাত দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য৷ কিন্তু তাদের সঙ্গে থেকে ভাগ্যক্রমে বেচেঁ যান কালী রঞ্জন শীল৷ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন জগন্নাথ হল সংসদের সাধারন সম্পাদক পরিমল গুহ,শোভা পাল,পুস্তক বিক্রেতা ইদু মিয়া, বাসার জানালা দিয়ে দেখেছিলেন হলের গৃহশিক্ষক গোপাল কৃষ্ণ নাথ৷ পাক হানাদার বাহিনীর বলির পাত্র হলেন অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য৷ তাঁর অকাল মৃত্যুতে বাঙ্গালীর সংখ্যা থেকে শুধু একজন মানুষই কমে যায়নি,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হারায় একজন সম্ভাবনাময় মেধাবী শিক্ষা-গবেষক,হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জবাসী হারায় একজন বুদ্ধিজীবি কৃতিসন্তান৷ ১৯৭২ সালে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একখানা চিঠি আসে তাঁর বাবার কাছে৷ লোকমুখ থেকে জানাযায়,প্রধানমন্ত্রীর ত্রান ও কল্যান তহবিল থেকে সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছ থেকে ২ হাজার টাকার চেক উত্তোলনের জন্য এ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়৷ কিন্তু ঐ চিঠি কিংবা চেক উত্তোলন সংক্রান্ত কোন ও তথ্য তাঁর পরিবার থেকে জানা যায়নি৷ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড.রঙ্গ লাল সেন অনুদ্বৈপায়নের মা-বাবাকে চিঠি দেন৷ চিঠি পেয়ে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের পিতা দিগেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্যের সাথে দেখা করেন৷ উপাচার্য্য পান দোকানদার চন্দ্র শেখর চন্দের সাক্ষ্য মতে থানা থেকে ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেন৷ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের পিতা-মাতা জীবদ্দশা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাতা প্রদান করেন৷ স্বাধীনতার পর অন্যান্যের সঙ্গে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের নামেও বাংলাদেশ সরকার ২ টাকা মূল্যে ডাকটিকিট বের করেন৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জগন্নাথ হলের সংসদ ভবনের নাম রাখা হয়েছিল অনুদ্বৈপায়ন ভবন৷ ভবনটি আকস্মিকভাবে ভেঙ্গে পড়ায় অনেক ছাত্রের মৃত্যু হয়৷ সেই সঙ্গে অনুদ্বৈপায়ন নামটিও মুছে যায়৷ বর্তমানে আছে অনুদ্বৈপায়ন স্মৃতি পাঠকক্ষ ৷ শহীদ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের ছোটবোন প্রীতিলতার কাছে তার বড় ভাইয়ের একটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি দেখে মনে হলো বয়স তেমন বেশী ছিল না৷ অবিবাহিত এক সুদর্শন যুবকের ছবি৷ কোর্ট-শার্ট-টাই পরা অবস্থায় তোলা সাদকালো ছবি৷
শহীদ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নবীগঞ্জ থানা সদর পয়েন্ট থেকে নবীগঞ্জ-কলেজ রোডে জন্তরী গ্রাম পর্যন্ত রাস্তার নামকরন করা হয় “অনুদ্বৈপায়ন সড়ক”৷ যা শুধু ভেঙ্গে পড়া ফটকেই শোভা পাচ্ছে৷
তাই শহীদ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের নামে নবীগঞ্জে একটি স্মৃতি ফলক তৈরী ও একটি সড়কের নাম করন করার জন্য সরকারের নিকট দাবী জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ৷