শুক্রবার ● ১১ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » বিশ্বশান্তি কামনায় রাঙামাটি রাজবন বিহারে ৪৩তম দানোত্তম কঠিন চীবর দান উদযাপন
বিশ্বশান্তি কামনায় রাঙামাটি রাজবন বিহারে ৪৩তম দানোত্তম কঠিন চীবর দান উদযাপন
সুগত চাকমা, ষ্টাফ রিপোর্টার :: (২৭ কার্তিক ১৪২৩ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় বেলা ৩.৪০মি.) আজ ১১ নভেম্বর শুক্রবার তথাগত বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাপুণ্যবতী বিশাখা কর্তৃক প্রবর্তিত ঐতিহ্যবাহী দানোত্তম কঠিন চীবর দান রাঙামাটি রাজবন বিহারে মহাসমারোহে ও ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের সাথে উদযাপন করা হয়েছে ৷
এই দান কার্যের বিশেষ তাত্পর্য্যের দিক হল চবি্বশ ঘন্টার মধ্যে সুতাকাটা হতে আরম্ভ করে সুতা রং করা,তাঁতে কাপড় বুনা এবং সেলাই করে চীবর তৈরী করে ভিক্ষু সংঘের নিকট কর্মফল, ইহকাল পরকাল ও চতুরার্য সত্যের উপর গভীর শ্রদ্ধা রেখে দান করা ৷ বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, এ পদ্ধতিতে কায়িক ,বাচনিক, মানসিক পরিশ্রম অধিকতর হয় তাই কঠিন চীবর দান মহা ফল প্রদায়ক ৷
এ পূণ্য কর্মে সারা দেশ থেকে তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধ অনুসারীগণও অংশ গ্রহণ করেছেন ৷ শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নয় ধর্মীয় আনন্দে মাতোয়ারা দেশের সকল ধর্মের সকল সম্প্রদায়৷
শহরে রাজ বনবিহারের প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান, ফুলের দোকান,দানীয় বস্তু,নানান পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন ৷ এ এক সম্প্রীতির মিলনমেলা ৷ লোকে লোকারণ্য। দুর দুরান্ত থেকে আসা প্রায় কয়েক লক্ষ জনসমাগমের নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত আছে রাঙামাটি জেলার পুলিশ প্রশাসন। উর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা সিএইচটি মিডিয়াকে জানিয়েছেন, চীবর দানোত্সবের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন থেকে ৬টি ও পুলিশ প্রশাসনের ৪টি মোট ১০টি সিসিক্যামেরা বসানো হয়েছে ৷
বৌদ্ধাধর্মালম্বীদের বৃহত্ত এই দান উত্সব কঠিন চীবন দান সুস্থ ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার লক্ষে এবং আগত পূর্ণার্থীদের সুবিধার্থে আইন শৃংখলা বাহিনীকে সড়ক ও নৌ পথের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রয়োজন অনুযায়ী টহল ব্যবস্থা গ্রহণ ও মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেক করা, যানজট নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ট্রাফিক মোতায়েন, সমগ্র রাজবন বিহার এলাকায় আইনশৃংখলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, স্বাস্থ্য বিভাগকে মেডিকেল টিম ও এম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা, সুষ্ঠভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখা, পানি সরবরাহের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, সেনিটারী লেট্রিনসমূহের দ্বারা বায়ু দুষণ এর বিষয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের প্রধানকে বিহার পরিচালনা কমিটিকে সহযোগিতা প্রদান করেন ৷
বৃহত্তর এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি সুস্থ ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য রাঙামাটির রাজ বনবিহার পরিচালনা কমিটিকে রাঙামাটি পাবত্য জেলা পরিষদ হতে ১লক্ষ ৯০হাজার টাকার আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে ৷
অনুষ্ঠানমালা : ১০নভেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় বেইন কর্মীদের পঞ্চশীল গ্রহণ, ৩টা ১মিনিটে বেইন ঘর উদ্ধোধন, ৩টা ১১মিনিটে চর্কায় সুতা কাটা উদ্ধোধন, বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে সুতা লাগানো শুরু, সন্ধ্যা ৬টা ১মিনিটে সুতা সিদ্ধ ও রং করা শুরু, ৭টা ১মিনিটে সুতা টিয়ানো শুরু, রাত ৮টায় সুতা শুকানো শুরু, ৮টা ৩০মিনিটে সুতা তুম ও নীল করা শুরু এবং রাত ১০টা ১মিনিট থেকে ১১নভেম্বর শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত বেইন টানা ও বেইন বুনা হবে৷
আজ ১১নভেম্বর শুক্রবার সকাল ৬টায় বুদ্ধ পতাকা উত্তেলন, ৬টা ১মিনিট থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত কঠিন চীবর সেলাই, সকাল ৬টা ১০মিনিটে পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের প্রাতঃরাশ, সকাল ৯টায় পরম পূজ্য বনভান্তের প্রতিচ্ছবিসহ পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের মঞ্চে আগমন ও আসন গ্রহণ, ৯টা ১০মিনিটে ধর্মীয় সংগীত পরিবেশন, ৯টা ২০মিনিটে পঞ্চশীল গ্রহণসহ বুদ্ধমুত্তি দান, সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান, ১১টায় ভিক্ষুসংঘকে পিন্ডদান, দুপুর ১২টা ৩০মিনিটে শোভাযাত্রা সহকারে কঠিন চীবর ও কল্পতরু মঞ্চে আনায়ন, বেলা ২টায় অতিথিবৃন্দের অনুষ্ঠান মঞ্চে আসন গ্রহণ, ২টা ২০মিনিটে ভিক্ষুসংঘ মঞ্চে আগমন ও আসন গ্রহণ, ২টা ২৫মিনিটে ধর্মীয় সংগতি পরিবেশন, ২টা ৩০মিনিটে পঞ্চশীল গ্রহণ, ২টা ৫০মিনিটে বুদ্ধমূর্তিদান, অষ্টপরিস্কার দান, কল্পতরু দান, কঠিনচীবরদান ও দানোত্সর্গ, বিকাল ৩টায় বিশ্বশান্তি কামনায় বিশেষ প্রার্থনা, ৩টা ১০মিনিটে বনবিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকের স্বাগত বক্তব্য, ৩টা ২০মিনিটে অতিথিবৃন্দ ও প্রধান পৃষ্টপোষক (চাকমা রাজা)’র বক্তব্য, ৩টা ৪০মিনিটে পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের ধর্মদেশনা, বিকাল ৪টায় পরম পূজ্য শ্রাবকবুদ্ধ শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভন্তের ধর্মদেশনা (ক্যাসেট হতে) ও সন্ধ্যা ৬টায় প্রদীপ পূজা ইত্যাদি ৷
তথাগত বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাপুণ্যবতী বিশাখা কর্তৃক প্রবর্তিত ঐতিহ্যবাহী দানোত্তম কঠিন চীবর দান রাঙামাটি রাজবন বিহারে মহাসমারোহে ও ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যে মধ্যে দিয়ে শুরুতে পঞ্চশীল প্রদান করেন রাঙামাটি রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান ও অধ্যক্ষ শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির ভিক্ষু ।
পঞ্চশীল গ্রহণ, বুদ্ধমূর্তিদান, অষ্টপরিস্কার দান, কল্পতরু দান, কঠিনচীবরদান ও দানোত্সর্গ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পাবত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব ও পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, রাঙামাটি ২৯৯ আসনের সংসদ সদস্য পিসিজেএসএস নেতা ঊষাতন তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী রাঙামাটি জেলা আওয়ামীগ নেতা দীপংকর তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাবেক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ান, রাঙামাটি রাজবন বিহারের প্রধান পৃষ্টপোষক চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাবমা, সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান,রাঙামাটি পৌরসভা মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী, রাঙামাটি রাজবন বিহারের দায়ক – দায়িকা পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি গৌতম দেওয়ান ও রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুন কান্তি চাকমাসহ জেলার বৌদ্ধধর্মবলম্বী সর্বস্থরের হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ নারী- পুরুষ।
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে রাজবন বিহার প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছর দানশ্রেষ্ঠ “কঠিন চীবর দান” অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।