শুক্রবার ● ১১ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » বাঘাইছড়ি পৌরসভা মেয়র আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
বাঘাইছড়ি পৌরসভা মেয়র আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
চৌধুরী হারুনুর রশীদ :: (২৭ কার্তিক ১৪২৩ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭.০৭মি.) ভুয়া প্রকল্পে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, লুটপাট, পৌরসভার সরকারী তহবিল তছরুপসহ ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ স্বত্ত্বেও পার পেয়ে যাচ্ছেন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভার মেয়র সাবেক ছাত্র শিবিরের প্রভাবশালী নেতা মো.আলমগীর কবির।
বর্তমানে তিনি সরাসরি জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। কেবল গত এক বছরে মেয়র আলমগীর কবির অর্ধকোটির অধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন খোদ পৌর কাউন্সিলররা।
লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। মেয়রের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে অনাস্থার প্রস্তাবও। কিন্তু তিনি অধরা এবং বহাল তবিয়তে।
অভিযোগের ব্যাপারে সরাসরি কথা বলেন বাঘাইছড়ি পৌরসভার কাউন্সিলর (প্যানেল মেয়র-১) মো. আবদুল শুক্কুর মিয়া ও প্রভাত চাকমা সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, মেয়র আলমগীর কবির শুধু গত এক বছরে প্রায় ৬০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে ফেলেছেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দেয়া উন্নয়ন বরাদ্দের ৪৮ লাখ টাকার কোনো কাজ আজ পর্যন্ত করা হয়নি। পৌরসভার পরিচালিত সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বাঘাইছড়ি শাখায় হিসাবের তহবিলে টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়র ও সচিব টাকা কি করেছেন তাও আমরা কোনো কাউন্সিলর জানি না। কৃষি ব্যাংকের শাখায় বিভিন্ন সময়ে রাখা টেন্ডারের জামানতের জমা টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না।
তারা জানান, কিছুদিন আগে সোনালী ব্যাংক বাঘাইছড়ি শাখায় পরিচালিত (হিসাব নম্বর-৫৮৯) তহবিল তদন্ত করে মাত্র ২ লাখ ৭২ হাজার ৩৩২ টাকা পাওয়া যায়। অথচ ওই হিসাবে গচ্ছিত তহবিলে থাকার কথা ৪৫ লাখ টাকা। কিন্তু তার আগেই হিসাবে ৪২ লাখ ২৮ হাজার ৬৬৮ টাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন সময়ে মেয়র আলমগীর কবির ও পৌরসভার সচিব মো. নজরুল ইসলাম যৌথস্বাক্ষরে টাকাগুলো উত্তোলন করেছেন।
এ ব্যাপারে ফোনে যোগাযোগ করা হলে সোনালী ব্যাংক বাঘাইছড়ি শাখার ব্যবস্থাপক সাধন বিকাশ চাকমা সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানান, বাঘাইছড়ি পৌরসভার পরিচালিত উল্লিখিত ব্যাংক হিসাবে সর্বশেষ মঙ্গলবার পর্যন্ত জমা ছিল মাত্র ৬৪ হাজার ৫৩২ টাকা। হিসাবটিতে প্রায় সব সময় লেনদেন হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অংকের টাকা জমা এবং উত্তোলন করা হয়ে থাকে। ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করা হয় মেয়র ও সচিবের যৌথস্বাক্ষরে।
কাউন্সিলর আবদুল শুক্কুর মিয়া ও প্রভাত চাকমা এছাড়াও সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানান, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বাঘাইছড়ি শাখায় পরিচালিত পৌরসভা তহবিলে (হিসাব নম্বর ৫১৬২) বিভিন্ন সময়ে জমাকৃত টেন্ডারের জামানতের বাবদ ১৬ লাখ ৫১ হাজার টাকাও উত্তোলন করা হয়। অথচ তহবিলে ওই হিসাবে ১৮ লাখ টাকা থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে ওই হিসাবে আছে মাত্র ১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। অপরদিকে মেয়র এখন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ভূয়া ভাউচার সংগ্রহ করছেন এবং কাগজে ভুয়া নথি তৈরি করছেন। এছাড়া গত প্রায় পাঁচ বছরে উন্নয়ন বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ লুটপাট করেন মেয়র।
এ বিষয়ে জানতে ফোনে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বাঘাইছড়ি শাখার ব্যবস্থাপক আশুতোষ চাকমা হিসাবের বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, কেবল হিসাবধারী কর্তৃপক্ষ চাইলেই ওই হিসাবের বিস্তারিত জানানো যাবে।
এদিকে ৭ আগষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে পাঠানো এক লিখিত অভিযোগে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-১ আবদুল শুক্কুর মিয়া সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারি হতে চলতি বছর জুন পর্যন্ত বাঘাইছড়ি পৌরসভার কর্মকান্ড পরিচালনার কোনো রেজুলেশনেই সঠিক সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ না করে বইয়ের পাতাগুলো ফাঁকা রাখা হয়। পরে মেয়র ও সচিব ইচ্ছামাফিক লেখার উদ্দেশ্যেই এমনটার কৌশল বলে মনে করি আমরা।
এতে তিনি আরও বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে টেন্ডারের মাধ্যমে দেয়া কাজগুলো এখন শেষ হয়নি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এডিবির দেয়া উন্নয়ন বরাদ্দ বাবদ ৪৮ লাখ টাকার কোনো কাজ আজ পর্যন্ত করা হয়নি। আবার ফান্ডে টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। ইসলামি ব্যাংক রাঙামাটি শাখায় পরিচালিত বাঘাইছড়ি পৌরসভার হিসাব নম্বর ২৩৬৫ হতে নামে বেনামে টাকা তুলেন মেয়র ও সচিব।
এছাড়া পৌরসভার বিভিন্ন কাজের জন্য টেন্ডার কমিটি, ক্রয় কমিটি আলাদা থাকা স্বত্ত্বেও কমিটির মাধ্যমে কোনো দ্রব্য না কিনে নিজেই ভুয়া ভাউচারে সংগ্রহ করেন মেয়র। কিছুদিন আগে উন্নয়ন ফান্ড হতে কাউন্সিলরদের সাড়ে ৩ লাখ টাকা ভাতা দিয়েছেন তিনি। অথচ তা বিধিসম্মত নয়। আমরা ২৮ জুলাই বৈঠকে লিখিতভাবে মেয়রের দুর্নীতির প্রতিবাদ করি। কিন্তু বাঘাইছড়ি পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর বিগত সময়ে আজ পর্যন্ত কোনো অডিট পরিচালিত না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ কর্মকান্ড বেড়েই চলেছে।
অভিযোগে উল্লেখ করে বলা হয়, বাঘাইছড়ি পৌরসভার মেয়র মো. আলমগীর কবির স্কুলজীবন থেকেই ছাত্র শিবিরে জড়িত হন। কলেজ জীবনে শিবিরের রোকন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে ২০০৩-২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্র শিবিরের সভাপতি ছিলেন। ২০০৫-২০০৬ সালে খাগড়াছড়ি জেলার ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ২০১১ সালে পেশীশক্তির প্রভাব খাটিয়ে বাঘাইছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
অভিযোগের পর যেহেতু মো. আলমগীর কবির জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সে সুবাদে জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন রাঙামাটি সম্মলিত কার্যালয়ে তদবীর করতে দেখা গেছে ।
লিখিত অভিযোগের পাশাপাশি ২ আগষ্ট জেলা প্রশাসকের বরাবরে মেয়র আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব দিয়েছেন কাউন্সিলররা। এর আগে ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রথমবার অনাস্থা দেয়া হয় মেয়রের বিরুদ্ধে। কিন্তু মেয়র পরবর্তীতে সংশোধন হবেন মর্মে শর্ত দেয়ায় তা প্রত্যাহার করা হয় বলে জানান অনাস্থা প্রস্তাবকারী কাউন্সিলররা।
কাউন্সিলররা আরও জানান, সচিব মো. নজরুল ইসলামকে হাত করে গত বছর ৩০ এপ্রিল পৌরসভার হিসাব রক্ষক রাকিবুল ইসলামকে ফেনী বদলি করে দিয়ে কৌশলে সরিয়ে দেন তাকে। তারপর সচিব ও মেয়র যৌথস্বাক্ষরে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করার রেজুলেশন পাস করান। বাঘাইছড়ি পৌরসভা থেকে বদলির বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বাঘাইছড়ি পৌরসভার সাবেক হিসাব রক্ষক রাকিবুল ইসলাম বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ আমাকে বাইরে বদলি করে দেয়া হয়েছে। আমি যাবতীয় হিসাব গুছিয়ে রাখতে চাইতাম, সেটাই ছিল আমার দোষ।
যোগাযোগ করা হলে অভিযোগ অস্বীকার করে মেয়র মো. আলমগীর কবির সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, এসবই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কোনো অভিযোগেরই ভিত্তি নেই। এককালে ছাত্র রাজনীতিতে ছিলাম। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বাঘাইছড়ি পৌরসভার উন্নয়ন ও পৌরবাসীর সেবায় নি:স্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক বলেন, এ বিষয়ে সাবেক জেলা প্রশাসক সামশুল আরেফিন প্রাথমিকভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বাঘাইছড়ি পৌরসভা মেয়র মো. আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে কাউন্সিলরদের দেয়া অভিযোগ তদন্তের জন্য এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানান, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।