মঙ্গলবার ● ১৫ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » গাইবান্ধা » আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহন মানে তো তাদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া
আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহন মানে তো তাদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: (১ অগ্রহায়ন ১৪২৩ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪.৩৩মি.) আমাদের সম্প্রীতির বন্ধন আবারো ছিড়েছে, অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে নাসির নগরের রেশ না কাটতেই আবার গোবিন্দগঞ্জে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উপর হামলা ৷ সিধু কানু রব ভৈরবদের নেতৃত্বে সাওতাল বিদ্রোহের ঐতিহ্য বহন করা সমতলের নৃ-গোষ্ঠী সাওতালরা আবারও প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে ভুমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে৷
সম্প্রতি ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জে নৃ-গোষ্ঠী সাওতাল জনগোষ্ঠীর গ্রামে হামলা লুটপাট ও হত্যাকান্ড নিয়ে ডিবিসি নিউজের শোভন আরেফ এর সঞ্চলনায় টকশোতে অংশ নিয়ে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দনাথ সরেন ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি মানবধিকার কর্মী ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া’র বক্তব্য সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো৷
তারা উভয়ে কথা বলেন, ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীদের বিভিন্ন বঞ্চনা বিশেষ করে ভুমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে৷ গোবিন্দগঞ্জের ঘটনা খুবই অনভিপ্রেত অনাকাঙ্খিত ৷ কিন্তু ঘটনার যে ধারাবাহিকতা এবং উভয় পক্ষের যে বক্তব্য তাতে মনে হয়না যে এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি ঘটনার বহিপ্রকাশ৷
সেদিনের ঘটনার মুল সমস্যাটি আসলে কি ছিলো ? বিভিন্ন গন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে এসেছে, সরকার,শিল্প মন্ত্রনালয় কিংবা মিল মালিকেরা একধরনের বক্তব্য আর সাওতালদের একধরনের বক্তব্য৷
রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন,
সাহেবগঞ্জ বাঘদাফার্ম রংপুর চিনিকল লিমিটেড স্থাপনের জন্য পাকিস্তান আমলে প্রায় দুই হাজার একরের কাছাকাছি জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছিলো৷ আদিবাসীদের বলা হয়েছিল এই জায়গা শুধুমাত্র ইক্ষু চাষ করা হবে৷ অধিগ্রহণকৃত জমির পাঁচটি মৌজাতে ১৫টি আদিবাসী গ্রাম আর বাঙ্গালীদের ৫টি গ্রাম গ্রাম ছিলো৷ পাকিস্তান আমলেও কিন্তু এই আদিবাসীদের জমিতে টার্গেট করে এই জমি অধিগ্রহন করে, তারপর দেশ স্বাধীন হলো, আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এটা সবাই জানে, কিন্তু স্বাধীনতার পর মিলটি কিছুদিন চলার পরে কিছুদিন চলে আবার কখনো থেমে যায়, কারণ লুটপাট হত, লুটপাটে কারণে চিনি কলটি ভালো উন্নয়নের দিকে যেতে পারেনি৷ যখন মিল আর চলছেনা ২০০৪ সালে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়, লে-অফ ঘোষণা করে সরকার৷
তখন মিল কতৃপক্ষ এবং তাদের সাথে যারা জড়িত বিভিন্ন সুবিধাবাদী তারা ঐ জমি লিজ দিতে থাকে এবং প্রভাশালীদের নিকট তারা লিজ দিতে থাকে, তারা আবার সাব-লিজ দেয় বিভিন্ন জনকে, হয়তো দুই হাজার টাকা একর তারা হয়তো ২৫ হাজার ৩০ হাজার টাকায় লিজ দেয় প্রতি একরে৷ এখন যারা জমি হারিয়েছে, যে আদিবাসী পরিবারগুলি জমি হারিয়েছে তাদের মনে আছে এই জমিতে যদি ইক্ষু চাষ না হয় তাহলে আমরা আমাদের জমি ফিরে পাবো৷
সে কারণে জমি ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেছে, যে এই জমিগুলো আমাদেরকে ফেরত দিতে হবে৷ কারণ এই জমিতে তো ইক্ষুচাষ হচ্ছে না, জমি তো লিজ দেয়া হচ্ছে, প্রভাবশালীদের হাতে চলে যাচ্ছে জমিগুলো, ইক্ষু চাষের পরিবর্তে সেখানে আলু, গম ধান ইত্যাদি শশ্য তারা আবাদ করেছে, এমনকি তামাক পর্যন্ত চাষ হচ্ছে৷ প্রভাবশালীরা লিজ নিয়েছে তারা আবার কৃষকদের সাব-লিজ দিয়ে এ সমস্ত জমিতে আবাদ করছে৷ এখন সাওতাল আদিবাসীরা বলছে যে, মিল বন্ধ হওয়ার পরেও আমাদের নাকের ডগায় প্রভাবশালীরা লিজ সাব-লিজ দিয়ে জমি আমাদের কাছ থেকে আত্মসাত্ করছে৷ ইক্ষু চাষ হচ্ছেনা মিল বন্ধ কাজেই আমাদের জমি আমাদেরকে ফেরত দিতে হবে৷ সাওতালরা লিজ নিতে চাইলে তাদের লিজ না দিয়ে বাইরের লোকদের লিজ দিচ্ছে, সেকারণে ভুমি হারা শুধু আদিবাসী নয় ঐ এলাকার বাঙালীরাও যারা জমি হারিয়েছে, তারাও ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং একত্রিত হয়ে আদিবাসী এবং বাঙালীদের যৌথ সংগ্রাম করার কমিটি করেছে, ২০১৪ সালে সাহেবগঞ্জ ভুমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি নামে৷
তখন থেকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৬ নভেম্বর যে নির্মম ঘটনা ঘটলো, আপনারা জানেন আদিবাসীরা তীর ধনুক ব্যবহার করে তাদের ঐতিহ্যগত কারণে, তারা যদি কোথাও কোন কাজে যায় বা আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতেও যদি যায় তখনো তারা তীর ধনুক সাথে রাখে৷
সেদিন যে ঘটনা ঘটলো কারন পুলিশ তো তাদেরকে উস্কানী দিচ্ছে, পুলিশের পেছনে হলো সন্ত্রাসীরা, মজার ব্যাপার হলো সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যাকে ভুমি উদ্ধার কমিটির লোকরা তাকে নির্বাচিত করেছে, চেয়ারম্যান ভুমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাতমরা ইউনিয়নের সভাপতি, যিনি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, ভুমি হারাদের আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে, নির্বাচন হয়েছে, তাকে জয়ী করা হলো, জয়ের পর থেকে তিনি আর ভুমি হারাদের সঙ্গে নেই৷
টকশোর উপস্থাপক শোভন আরেফ ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়াকে প্রশ্ন করেন, কেন সাওতালরা বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিরা বারবার এই টার্গেটে পরিনত হচ্ছে, তাদের ভুমি হারাচ্ছে ?
আসলে এই ঘটনা থেকে সাওতালদের অধিগৃহিত জমি ফিরে পেতেন কিনা, সেবিষয়ে আইনগত দিকটা একটু বলবেন ?
ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বক্তব্য শুরু করার আগে সাওতালদের উপর অত্যাচার নির্যাতন এবং তাদের জমি হারানোর একটি ভিডিও প্রতিবেদন উপস্থাপন হয়৷ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের সাওতালদের গ্রামসহ ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে৷ অসহায় সাওতালরা খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছেন৷ অনেকের ছেলেমেয়ে আত্মীয় স্বজন প্রতিবাদ না করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন৷ সাওতালদের জন্য সংখ্যাগুরুর নির্যাতন শেষ নয় আর্থিক টানাটানির মধ্যে নদী মাতৃক বাংলাদেশে বাস করেও সুপেয় পানিরও সংকট৷ নেই সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা নেই কোন সামাজিক উন্নয়নমূলক তথ্য৷ ১৯৯৩ সালে তথ্য অনুযায়ী সাওতাল ওরাওসহ ৩৮টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠির প্রায় ১৫ লক্ষ আদিবাসীর বসবাস ছিলো কিন্তু তারপর থেকে তার সংখ্যা শুধুই কমটির দিকে৷ প্রায় সাড়ে পাঁচ’শ পরিবার দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, কারণ শুধু নির্যাতন নয় তাদেরকে চায়ের দোকানে পর্যন্ত চাকরী দেওয়া হয়না৷ সর্বোপরি আদিবাসীরা সবদিক থেকে বৈষম্যর শিকার৷
কেন সাওতালরা বা ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীরা বারবার এই টার্গেটে পরিনত হচ্ছে, তাদের ভুমি হারাচ্ছে ? আসলে এই ঘটনা থেকে সাওতালদের অধিগৃহিত জমি ফিরে পেতেন কিনা, প্রশাসনের দাবি অধিগৃহিত জমি সাওতালদের ফিরে পাওয়ার সুযোগ ছিলনা৷
আইনগত দিকটার বিষয়ে ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন,
প্রথমে কয়েকটা বিষয় এখানে পরিষ্কার করা দরকার, সেটা হচ্ছে,সরেন দা কিছু বিষয় পরিস্কার করে বলেছেন, তারা এখানে আন্দোলন করছে, কিসের আশায় এবং দাবি গুলোর ভিত্তি কি ?
পাকিস্তানের যে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল কর্পোরেশনের সাথে চুক্তি হয়েছিল, সে চুক্তির ৫ নম্বর শর্তটা আমি একটু করে বলি, শর্তটা এরকম ছিলো যে, পাকিস্তান ইন্ডাষ্ট্রিয়াল কর্পোরেশন যদি তাদের যে উদ্যেশ্যে জমি নিচ্ছে সে উদেশ্যে ব্যবহার না করে তাহলে সে জমি প্রভেনসিয়াল গভরম্যানস ইষ্ট পাকিস্তানের (প্রাদেশিক সরকার) কাছে ফেরত দিবে৷ তার পরের লাইনটা উনারা বুঝেও বোধ হয় বুঝছেন না৷ পরের শব্দগুলোয় হুবহু এই কথাগুলো আছে “দ্যান প্রভেনসিয়াল গভরম্যানস উইল রিলিজ এন্ড রিষ্টোর দ্যা ল্যান্ড টু দ্যা অরিজিনাল ওনার” অর্থাত্ তারপর প্রাদেশিক সরকার জমির আসল মালিকের কাছে ফেরত দিবে৷
এই রিলিজ এন্ড রিষ্টোরেশন কথাটি বর্তমান সরকারের প্রশাসনের কাছে কি বুঝাবো ? শুধু ইক্ষু চাষ না করলে কি আদিবাসীরা আপনা আপনি ভুমি পেয়ে যাবে ? না এর ইঙ্গিতটাও কিন্তু চুক্তিতে রয়েছে, ভুমি প্রাদেশিক সরকার ভুমির মালিকদের কাছে মালিকানা হস্তান্তর করবে৷ এখনতো প্রাদেশিক সরকার নাই, এখন তো স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধিনে এখন চিনিকল আছে, অর্থাত্ সরকারের অধিনে আছে, তাহলে এই চুক্তিটা যদি সম্মান করতে হয়, যে চুক্তির প্রেক্ষিতে আমার বাপ দাদার ভিটেমাটি আপনারা অধিগ্রহণ করলেন, সরকার যদি চুক্তিতে সম্মান দেখাতে হয় তাহলে এই জমির পুর্বের মালিকদের কাছে ফেরত দিতে হবে৷ এই জায়গাতেই হচ্ছে বড় রকমের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে৷
রবীন্দ্রনাথ সরেনের কথার উদৃতি দিয়ে ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন,
২০০৪ সাল থেকে এখানে মিলটি লে অফ ঘোষনা করা হয়েছে, তারপর থেকে মিল তো আসলে চালু নেই, তারা লোক দেখানো স্বার্থে মিলটাকে বছরে ১০ দিন মতো চালু রাখেন, মিল ঘুরে যদি আপনি দেখেন মিলের কর্মকর্তাদের থাকার কোয়াটার সেগুলোতে শেয়াল পর্যন্ত থাকবেনা৷ সেগুলো ভঙ্গুর অবস্থা, জড়াজীর্ণ, পরিত্যক্ত৷
আমি আপনাকে দেখাতে পারবো আমি নিজে গিয়ে সচিত্র ছবি তুলে এনেছি এবছরের মে জুন মাসে৷ তাহলে মিল খোলা থাকে বিষয়টা দেখানোর প্রয়োজন কি ? সেটার ও উদেশ্য হচ্ছে এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে বর্গা দেওয়া৷ সরেন দা মুখের কথা বলেন নাই, সাব - লিজ দিয়েছেন এবং ঐ এলাকার জেলা প্রশাসক বাতিল করেছেন সে আদেশের কপিও আমাদের কাছে আছে৷ মিলের ম্যানেজার তো শুধুমাত্র চাকর, তিনি সাব - লিজ দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন কোথা থেকে ? এবং প্রভাবশালীরা সেই জমিগুলো ভোগ দখল করে আসছে সেটা বুঝতে গেলে আপনাকে বুঝতে হবে জমির আয়তন কত ? ১৮৪২.৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, বিশাল জায়গা৷ এর পাশাপাশি আরেকটি কথা যেটি মিডিয়াতে আসছেনা, সেটি হচ্ছে কোন রকমের অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ছাড়াই এই ১৮৪২.৩০একর জমি পাশে আরো ৬০০ একর জমি আছে, যেগুলো তারা জবর দখল করে রেখেছে৷ মিল মালিক হচ্ছেন একটা গুটি মাত্র৷ স্থানীয় যদি কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার থাকেন তিনি হচ্ছেন স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ, অন্যথাই আপনি চিন্তা করেন, এই যে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হলো এই উচ্ছেদ কার্যক্রম কে পরিচালনা করলেন, কার নির্দেশে ?
জেলা প্রশাসক গণমাধ্যমে পরিষ্কার করেছেন যে তিনি নির্দেশ দেননি, তাহলে কে নির্দেশ দিল ? তাহলে নিশ্চয় কোর্টের অর্ডার আছে, তারা পহেলা জুলাই থেকে এখানে এই লোকগুলো আড়াইশ লোক ৬শ ঘরবাড়ি স্কুল, স্কুলের অনুমোদনের জন্য ইতিমধ্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছে৷ এই অবস্থা জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তারা সেখানে আছে তাদেরকে তুলতে গেলে তো আপনি গুলি করে মেরে তুলতে পারবেন এরকম কোন আইনী প্রক্রিয়া তো কোথাও নেই৷
রবীন্দ্রনাথ সরেনকে প্রশ্ন করা হয় যেহেতু জায়গা এখনো সাওতালদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি তারা সেখানে ঘরবাড়ি করলেন কিভাবে ?
রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন,
ফিরে পায়নি ঠিক, কিন্তু জমিতে শুধুমাত্র ধান আর বিভিন্ন তামক শশ্য আবাদ হচ্ছে, যাদের বাপ দাদাদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা হয় তারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, তারা জেনেছে যে, এখানে আর ইক্ষু চাষ হয়না মিল বন্ধ তাহলে আমাদের জমি আমরা পাবো, ঐ লোকগুলো আবার ফিরে আসছে এবং তারাতো ভুমিহীন বাস্তহারা, তাদের জীবণে আর কি আছে কিছুই তো নেই ৷
ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন,
সাতমারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল কিন্তু এই সাহেবগঞ্জ বাঘদাফার্ম ভুমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি, তাহলে তিনি কিন্তু ৬ নভেম্বরের যে উচ্ছেদ কার্যক্রম সবার আগে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই বুলবুল এবং তিনি মাইকিং করেছেন যেটা মিডিয়াতে আসেনি তিনি মাইকিং করেছেন প্রতিটা বাড়ীতে লুটপাট চালাও যে যেভাবে পার নাও যা লুটপাট করছ এগুলো তোমাদের কাছে ফেরত চাওয়া হবেনা৷ এখানে ঘরবাড়ী তোলার জন্য আদিবাসীদের সংঘবদ্ধ করেছিল পরে সেই নিজের স্বার্থ সিদ্ধি হয়ে এমপি সাহেবের সম্মতিতে এরকম ঘটনা ঘটালো৷ এই ধরনের ঘটনায় প্রশাসনের অবশ্যই নিরব সম্মতি ছিলো৷ আমি বলছিনা ভুমি আদিবাসীদের দিতে হবে তবে ভুমি যদি ফেরত দিতে হয় তাহলে এদেরই অগ্রাধিকার দিতে হবে আইনটা সেভাবেই আছে৷ এখন চুক্তির কথা যদি বাদও দেন আমার পুর্বপুরুষদের কাছ থেকে যে কারণে জমি নেওয়া হয়েছিলো সে উদ্যেশ্যে যদি ব্যবহার না হয় ১৯৮২ সনের যে অধিগ্রহণ আইন আছে সে আইন অনুযায়ীও কিন্তু সরকার যদি ইচ্ছা পোষন করে যে ফেরত দিবে যার পুর্বতন মালিকদের উত্তরাধীকারীরা প্রাধান্য পান ৷ আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত এবং পিছিয়ে পরা সামাজিক অবস্থার কারনে অনেক সময় জমির কাগজপত্র থাকেনা৷ তবে সাহেবগঞ্জের ক্ষেত্রে আমি বলবো এগুলো প্রতিষ্ঠিত গ্রাম, এ গ্রামগুলো ১৮শতকের সেই চা বাগান যখন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তখন জঙ্গল সাফ করার নিয়ে আসার যে প্রকল্প সে সময়ে কিন্তু এই সাওতাল আদিবাসীরা ভারত থেকে বাঙলায় আসে৷ পাহাড়ের আদিবাসীদের ভুমি ব্যবস্থাপনা আর সমতলের আদিবাসীদের ভুমি ব্যবস্থাপনায় কিন্তু বিরাট পার্থক্য রয়েছে৷ পাহাড়ের আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভুমি কমিশনের মত করে এই সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভুমি কমিশন আদৌ সম্ভব?
রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন,
বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসীরাই তো এই জমিগুলো প্রথমে গোড়া পত্তন করেছে, তারাই এই জমি চাষ যোগ্য করেছে, এখন তাদের হাতছাড়া হয়েছে৷ এবং প্রতিনিয়ত এই ভুমিকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের সাথে প্রভাবশালীদের ভুমিদস্যুদের বিবাদ হচ্ছে, এই বিবাধকে কেন্দ্র করে হত্যা ধর্ষন, উচ্ছেদ, নির্যাতন ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, দেশত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদি হচ্ছে৷ আপনি দেখবেন যে, আদিবাসীদের জমি বাদে কোন ফার্ম হয়না, দিনাজপুরের বিজ উত্পাদন ফার্ম সেটাও আদিবাসীদের জমি, কান্তা ফার্ম সেটাও আদিবাসীদের জমি,দিনাজপুর সদরের যে পল্লী বিদ্যুত্ সেটাও আদিবাসী জমিতে, অর্থাত্ আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহন মানে তাদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া৷ ঐ এলাকার মানুষগুলো কিন্তু বেশিরভাগ দেশত্যাগ করে চলে গেছে, যারা আছে তারা গুটিকয়েক এবং ছড়িয়ে ছিঠিয়ে আছে৷ সেজন্য আমরা জাতীয় আদিবাসী পরিষদ আমাদের দাবি উত্তাপন করেছি যে, আদিবাসীদের জমি যদি সুরক্ষা করতে হয় তাহলে সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বাধীনভাবে আলাদা ভুমি কমিশন গঠন করা৷ বর্তমান সরকার কিন্তু সেটা স্বীকার করেছে এবং এটাকে গ্রহণ করেছে অঙ্গিকার করেছে আদিবাসীদের কাছে ২০০৮ সালে বলেছে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইসতেহারে তারা বলেছে আমরা ক্ষমতায় গেলে আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভুমি কমিশন গঠন করবো৷ এই সরকার তো ৮ বছর অতিবাহিত করছে কিন্তু আদিবাসীদের ভুমি কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে কোন আলামত আমরা দেখি নাই, আলোচনাও হচ্ছেনা৷ আমরা মনে করি আলাদা ভুমি কমিশনের মাধ্যমে আদিবাসীদের ভুমি রক্ষা করা সম্ভব৷ আদিবাসীদের জমি তো অন্যায় ভাবে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷
ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন,
প্রান্তিক জনগোষ্ঠি যদি মুসলিমও হয় সেও কিন্তু ক্ষমতাসীনের ধারা শোষিত, রাজনীতির নীতিই যদি হয় দখলদারিত্বের রাজনীতি ক্ষমতার চর্চাটাই যদি হয় দখলদারিত্বের এই কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে যদি বের হয়ে না আসেন তাহলে আদিবাসীদের বাচাও বাচাও বলে কোন লাভ হবেনা৷ ভুমি ব্যবস্থাপনা বা ভুমি হস্তান্তরের বা মালিকানার সবচেয়ে ঝাপসা এবং অবিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থাপনা হচ্ছে বাংলাদেশে ৷
পৃথিবীতে সবচেয়ে নিখুত এবং স্বচ্ছ ভুমি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া হচ্ছে জার্মান এবং অষ্ট্রেলিয়া৷ আমাদের দেশের এই ভুমির সমস্যাটা সামগ্রিক এই আইনগুলোতে পরিবর্তন দরকার৷ আমার চোখের দেখা ৫০ টাকার ষ্টাম্পে ৩৫ একর জায়গার ভুয়া দলিল বানিয়ে নাম জারি হচ্ছে৷ এখানে জাল স্বাক্ষর জাল দলিল কোন বিষয় থাকছেনা৷ আপনি দেখবেন অর্পিত সম্পত্তি আইনের সংশোধনী হয়ে গেল ৭বার৷ ৬ লক্ষের উপরে মামলা, একলক্ষ মামলাও নিষ্পত্তি হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে৷
আদিবাসীদের বৈষম্য দুর করার ক্ষেত্রে এই সমাজ ব্যবস্থায় কি এখনো উন্নত হয়নি যে আদিবাসীদের দোকানে ঢুকতে দেওয়া হয়না ?
এ প্রশ্নের জবাবে রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন,
আদিবাসীরা সবকিছুতে সব সময় বৈষম্যর শিকার, সমাজে অন্য লোকের সাথে আদিবাসীদের মিশতে বা একসাথে খেতে দেওয়া হয়না ঐ এলাকায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে, আদিবাসীদের জন্য সাধারন চায়ের দোকানেও দুই নম্বর কাপ পিরিচ৷ আর বিচারহীনতা প্রচন্ড৷ পুলিশ থানায় কোন অভিযোগ করলে আদিবাসীরা বিচার পাচ্ছেনা৷
ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন,
আজকেও ঐ এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তেমনটা করেছেন৷ গতকাল (৯ নভেম্বর) আমরা একটি টিম পরিদর্শনের জন্য সেখানে গিয়েছিলাম, সময়ের অভাবে আমরা খাবার বা অন্য কিছু কিনতে পারিনাই, সেজন্য ওরা যেহেতু না খেয়ে আছে তাই কিছু টাকা আমরা ওদের জন্য দিয়েছিলাম যাতে, চাল ডাল ইত্যাদি কিনে খেতে পারে৷ কিন্তু ইউএনও বিশাল ৬টি গাড়ীর বহর নিয়ে সেখানে বিজিবি ও পুলিশ নিয়ে যারা ওদের খাবারের ব্যবস্থা করছিল তাদের বাধা দেয় এবং বলেছিলেন, ভোটার কার্ড দেখে এসব বিতরন করতে হবে৷ এমনকি ইউএনও’র সামনে এসব বিতরন করতে দেবেন না৷
আমি জানিনা, আমাদের দেওয়া টাকা ইউএনও কেন বিতরন করবেন ? বা ত্রান বা সহায়তা বিতরন করছেন তার এলাকার লোকজন সেখানে গিয়ে বাধা দেয়ার কোন ধরনের আইনী এখতিয়ার আছে, বা আদৌ এখতিয়ার আছে কিনা৷ আসলে বেশী ছাড় দেয়া হয়ে যাবে যদি না বলি যে, উচ্ছেদ প্রক্রিয়াকে মিডিয়ার সামনে যেভাবে প্রচার হয়েছিল ধান কাটটে গিয়ে তাদের সাথে সংঘর্ষ উত্তেজনা, এটা আসলে মোটেও সেরকম ঘটনা নয়, নাসিরনগরে যেরকম দেখছি যে পরিকল্পিতভাবে সময় নিয়ে যেধরনের ঘটনা ঘটেছে ঠিক তেমনি একটি ঘটনা হচ্ছে গোবিন্দগঞ্জেও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার একটা সুপরিকল্পিত ঘটনা৷ পুলিশ বলছে একঘন্টা পরে তারা খবর পেয়েছে, তাদের গুলিতে কোন আদিবাসী মারা যায়নি, আমি নিজের চোখে রাইফেলের খোসা দেখেছি৷ পড়াশোনা আমরাও কিছু করেছি, পুলিশের ফৌজদারী আইন আমরাও কিছু বুঝি, সাধারন মানুষের উপরে রাইফেলের গুলি কখন ব্যবহার করছেন৷
লাশের সংখ্যা নিয়েও অনেক রকম কথা হচ্ছে৷ আজকেও রমেশ টুডু নামের এক আদিবাসীকে মেরে ফেলা দেয়া হয়েছে৷ শুরু থেকে স্থানীয়রা বলছিলেন ৫জনের লাশ মাঠে পরে থাকতে দেখেছেন কিন্তু একজনের লাশ আমরা পেলাম সেটা হচ্ছে যিনি চিকিত্সারত অবস্থায় মারা গেছেন, শ্যামল হেমব্রন তার পাজরে গুলি লেগেছিল যদিও পুলিশ বলছে কাউকে গুলি চালায়নি৷ ৮ নভেম্বর তারিখে একইভাবে মঙ্গল মান্দি নামের আরেকজনের লাশ মাঠে ফেলে আসে৷ ময়নাতদন্ত করা লাশ, তার শরীরে গুলির চিহ্ন আছে কিন্তু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আছে কোন বুলেটের আলামত নেই৷
তাহলে কোন জায়গায় যোগসাজস চলছে, রাস্তায় কুকুর পেলে পিটিয়ে মারার মত যে সংস্কৃতি সে ধরনের ব্যবহার হচ্ছে আদিবাসীদের উপর৷ তাদের সাহস যেভাবে ভেঙ্গে দেওয়া যায়, তাদের প্রতিবাদ বন্ধ করা যায়৷
আদিবাসীরা প্রতিবাদী তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল৷
আমরা ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের ভাষায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী’র প্রতি বৈষম্যের অবসান চাই৷
তথ্য সূত্র : ডিবিসি নিউজ, নাসিরনগর - গোবিন্দগঞ্জ সম্প্রীতির সুরভঙ্গ৷