সোমবার ● ২৮ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » নরসিংদীবাসীর প্রিয়, আস্থাভাজন, নির্ভরযোগ্য ও সৎ জেলা প্রশাসক কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এখন চক্ষশূল
নরসিংদীবাসীর প্রিয়, আস্থাভাজন, নির্ভরযোগ্য ও সৎ জেলা প্রশাসক কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এখন চক্ষশূল
নরসিংদী প্রতিনিধি :: এক সময়ের নরসিংদীর সরকারদলীয় রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের অতিপ্রিয়, আস্থাভাজন, নির্ভরযোগ্য এবং সৎ জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান এখন তাঁদেরই চক্ষশূল। ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ২৮ মে অনুষ্ঠিত সদর উপজেলার হাজীপুর ও শীলমান্দী ইউনিয়নের স্থানীয় সরকার নির্বাচন, পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ ও দুদকের গণশুনানিতে ডিসির বিরুদ্ধে পৌর মেয়রের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগকে ঘিরে। রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিবিদদের সাথে ডিসির দ্বন্ধ ক্রমশই বাড়ছে। ‘আস্থাভাজন’ ডিসির অপসারণ চেয়ে বর্তমানে আন্দোলনে মাঠ কাঁপাচ্ছেন তাঁর এক সময়ের শুভাকাঙ্খিরা। এ কারণে জেলার স্বাভাবিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। এ দ্বন্ধ রাজনীতিরই মারপ্যাঁচ বলে সূধীমহল মনে করছে।
জানা যায়, কয়েক মাস আগে পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামীলীগ সভাপতি কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি গোপন প্রতিবেদন পাঠান ডিসি আবু হেনা মোরশেদ জামান। ঐ প্রতিবেদনের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টপাল্টি অভিযোগ ও দ্বন্ধে ক্ষমতাসীন দল এবং জেলা প্রশাসনের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান দুই বছর চার মাস আগে ফরিদপুর থেকে বদলি হয়ে নরসিংদীতে যোগদান করেন। যোগদানের পর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হীরু এমপি সহ স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে ডিসির ঘনিষ্ঠ সখ্যতা গড়ে উঠে। গত ২৯ জানুয়ারি নরসিংদী ক্লাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামানকে একজন অত্যন্ত মেধাবী, সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এমনকি ভালোবেসে নরসিংদীর ‘নাগরিকত্ব’ও দিতে চেয়েছিলেন।
গত ২৮ মে অনুষ্ঠিত সদর উপজেলার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হাজীপুর ও শীলমান্দী ইউনিয়নের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে বিভক্তি দেখা দেয়। জেলা প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে প্রতিমন্ত্রীর ঘোর বিরোধিতার পরও শীলমান্দী ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেন। ফলে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী ও সরকার দলের একাংশের দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। এরই মধ্যে স্থানীয় স্বতন্ত্র সাংসদ সিরাজ মোল্লাহকে উপেক্ষা করে প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম হীরু শিবপুরের নবনির্মিত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স উদ্বোধন করতে চাইলে তা বাতিল করে দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ফলে প্রশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব আরো বেড়ে যায়।
কয়েক মাস পূর্বে স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতিমন্ত্রীর আস্থাভাজন নরসিংদী পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি গোপন প্রতিবেদন প্রেরণ করেন জেলা প্রশাসক। ঐ প্রতিবেদনে মেয়রকে ক্ষমতালোভী, পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু গোপন প্রতিবেদনের তথ্য সম্প্রতি ফাঁস হয়ে গেলে পরস্পরের “বন্ধুত্ব শত্রুতায়” রুপ নেয়। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিভক্ত হয়ে ডিসির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামীলীগের বর্ধিত সভায় জেলা প্রশাসকের সব কার্যক্রম বয়কট করার সিদ্ধান্তের ফলে মতাসীন দলটির সঙ্গে ডিসির সম্পর্কের অবনতির বিষয়টি সাধারণ মানুষের নজরে আসে।
গত ১৬ নভেম্বর নরসিংদীতে দূর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতে পৌর মেয়রসহ বেশ কয়েকজন নেতা ‘রোকেয়া পদক’ প্রদানে নরসিংদীর কীর্তিমান নারীদের নাম বাদ দিয়ে নিজের মায়ের নাম প্রস্তাব, মাধবদীর গরুর হাট এবং সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের ভেতরে ৮৫ শতাংশ ইট ভাটার সরকারি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ‘ক্যান্ডেল লাইট’ নামে বন্দোবস্ত দেওয়ার উদ্যোগসহ ডিসির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করেন।
জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খন্ডন করে নিজের ফেসবুক আইডিতে বার্তা দেন। গত সোমবার সকালে ডিসির বিরুদ্ধে জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পরদিন সকালে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে। সকাল সাড়ে ১০টায় মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রধান ফটকের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। তাঁরা সাত দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসককে অপসারণের আলটিমেটাম ঘোষণা করেন। এ সময় জেলা প্রশাসনের কিছু কর্মচারী লাঠিসোঁটা নিয়ে এগিয়ে এলে পুলিশের সঙ্গে তাদের বাকবিতন্ডা হয়।
জেলা প্রশাসক ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের দ্বন্ধের জের ধরে আদালতপাড়া, আইনজীবী সমিতি, সোনালী ব্যাংক, জেলা জজ, প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বাস ভবনসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। দিনে অতিরিক্ত আর্মড পুলিশ ও আনসার সদস্য মোতায়েনের পাশাপাশি রাতে শহরে র্যাব-পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে স্থানীয় জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন (কমিশনার), শহর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অলিউর রহমান আজিম, নরসিংদী পৌরসভার প্যানেল মেয়র রিপন সরকারের নেতৃত্বে ‘জেলা পরিষদ নির্বাচনের পূর্বেই ডিসির বদলীর উদ্দেশ্যে’ কর্মসূচী জোরদার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের নরসিংদী সরকারী কলেজ মাঠে জমায়েত করা হয়।
এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন (কমিশনার), শহর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অলিউর রহমান আজিম, নরসিংদী পৌরসভার প্যানেল মেয়র রিপন সরকার, করিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান হারিছুল হক, আলোকবালী ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দিপু, নরসিংদী পৌরসভার কাউন্সিলর আলমাছ মিয়া, ইয়াছমিন সুলতানা, জেলা যুব মহিলা লীগের সভানেত্রী তৌহিদা সরকার রুনা, সেচ্ছাসেবক লীগ জেলা সভাপতি দিপু, জেলা পূজা কমিটির সাধারন সম্পাদক দীপক কুমার সাহা, করিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর সরকার, আওয়ামী লীগ নেতা নাজমুল করীম পিন্টু, জেলা শ্রমিক লীগের সাধারন সম্পাদক রফিকুল ইসলাম প্রমূখ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য প্রদান করেন।
পরে তাঁরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আ.ন.ম ফয়জুল হক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) হাসিবুল হক, গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক শহিদুর রহমানসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে আদালতের ভেতরে প্রবেশে বাধা প্রদান করলে জেলখানা মোড়ের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কালেক্টরেট কর্মচারী সমিতির সদস্যরা এ সকল কর্মকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন বাচ্চু জানান, জেলা প্রশাসকের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে আমাদের দলের ভাবমূূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
পৌর মেয়র কামরুজ্জামান ডিসির সঙ্গে মতবিরোধের কথা স্বীকার করলেও কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান জানান, তদন্তেই প্রমাণিত হবে তিনি কোন ভুল করেননি। রোকেয়া পদক জেলাভিত্তিক কোন পদক নয়, দেশের দু’জন নারীকে এই পদক দেয়া হবে। জেলা প্রশাসকের মা হিসেবে নয়, কর্মগুণের কারণেই নির্বাচক বোর্ড নরসিংদী থেকে আমার মায়ের নাম প্রস্তাব করেছে।
নরসিংদী-৩ আসনের (শিবপুর ও রায়পুরার একাংশ) সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা জানান, প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদদের এ আন্দোলন কারোরই কাম্য নয়। আলোচনার ভিত্তিতে এ দ্বন্ধ নিরসন করা উচিত।
জেলা প্রশাসকের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এ দ্বন্ধকে শহরবাসী রাজনীতির মারপ্যাঁচ বলে উল্লেখ করেছেন। সূত্র:নিউজ সময়