শুক্রবার ● ২ ডিসেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দশদফার অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে : জনসংহতি সমিতি
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দশদফার অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে : জনসংহতি সমিতি
ঢাকা প্রতিনিধি :: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ইত্যাদিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন করা; আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে যথাযথভাবে হস্তান্তর করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং স্থানীয় পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠন করা; প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা, যথাযথভাবে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা ও সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন করাসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পূর্ব-ঘোষিত দশদফা কর্মসূচির ভিত্তিতে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহতভাবে চালিয়ে নেয়ার ঘোষণা করেছে জনসংহতি সমিতি।
৩০ নভেম্বর বুধবার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক রাজধানীর সুন্দরবন হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সন্তু লারমা এ ঘোষণা দেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা’র সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী রূপম।
সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা তার মূল বক্তব্যে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দীর্ঘ ১৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। দীর্ঘ ১৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী হস্তান্তর; পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণসহ পুনর্বাসন; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ, চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। সুদীর্ঘ ১৯ বছরের মধ্যে চারটি রাজনৈতিক সরকার ও দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার- মোট ছয়টি সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসলেও কোন সরকারই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি।
২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়। শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ সাল থেকে আজ অবধি প্রায় ৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে কতিপয় বিষয় হস্তান্তর, ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন ইত্যাদি চুক্তির কতিপয় বিষয় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে এসব উদ্যোগে ছিল ধারাবাহিকতা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
পক্ষান্তরে দেশ-বিদেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করতে সরকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে’ বলে অসত্য বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। বস্তুত ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের এই দায়সারা উদ্যোগ, চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে গড়িমসি, চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অসত্য তথ্য প্রচার ইত্যাদি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সরকার জুম্ম জনগণসহ পার্বত্যবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় চরমভাবে অনাগ্রহী। তাই সরকার কেবল চুক্তি বাস্তবায়নে তালবাহানা নয়, সেই সাথে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম-স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম অব্যাহতভাবে বাস্তবায়ন করতে থাকে। চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম-স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র জোরদার করা হয়েছে।
আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর নামে একপ্রকার সেনা শাসন ও কর্তৃত্ব জারি রেখে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে অথর্ব করে রাখা হয়েছে।
জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি প্রত্যর্পণের পরিবর্তে ঠেগামুখে স্থল বন্দর স্থাপন, ঠেগামুখ-চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ সড়ক ও সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, সেনাবাহিনী কর্তৃক বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, বিজিবির বিওপি স্থাপন, কাচলং-সীতা পাহাড় ভূ-গঠনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন ইত্যাদি তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষাকে অবহেলিত অবস্থায় রেখে শিক্ষা প্রসারের নামে তথা চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে রাঙ্গামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী রাজনৈতিক কেন্দ্র স্থাপন করার প্রক্রিয়া চলছে।
জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখলের উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং উগ্র জাতীয়তবাদী শক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদ দিয়ে কমপক্ষে ১০টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত করা হয়েছে।
জুম্মদের মধ্যে তাবেদার গোষ্ঠী সৃষ্টি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।
জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পূর্ণাঙ্গ পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনের পরিবর্তে দলীয় সদস্যদের দিয়ে অন্তর্বর্তী পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করা হয়েছে এবং পার্বত্যবাসীর বিরোধীতা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী পরিষদের সদস্য-সংখ্যা পাঁচ থেকে ১৫ জনে বৃদ্ধি করে একতরফাভাবে ২০১৪ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং তার মাধ্যমে অগণতান্ত্রিক ও দলীয়করণের ধারা আরো জোরদার করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের সকল সম্ভাবনা নস্যাৎ হতে চলেছে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নানাভাবে পদদলিত করে চলেছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার মর্যাদা চিরতরে ক্ষুন্ন করার পাঁয়তারা চলছে। ফলে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ও নিরাপদহীন হয়ে উঠে।
সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়োজিত সেনা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে চলেছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। অথচ ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তিন বাহিনীর সম্মতিতে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। অপরদিকে সন্ত্রাসী তল্লাসীর নামে নির্বিচারে ধর-পাকড়, মধ্যযুগীয় কায়দায় মারধর, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেল-হাজতে প্রেরণ, জনসংহতি সমিতির অফিস তল্লাশী ও ভাঙচুর ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ অব্যাহতভাবে চলছে। গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সেনা-বিজিবি-পুলিশী অভিযানে বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান ও বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের একজন সদস্যসহ জনসংহতি সমিতির ৩০ জন সদস্য-সমর্থক ও নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ৮৯ জনকে মারধর করা হয়েছে, ৫৮ জনকে সাময়িক আটক ও হয়রানি করা হয়েছে এবং জনসংহতি সমিতির তিনটি অফিসসহ ২৩টি ঘরবাড়ি তল্লাসী ও তছনছ করা হয়েছে।
আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে বহিরাগত মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ছত্রছায়ায় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক অত্যন্ত সুক্ষ্ম পরিকল্পনাধীনে বহিরাগত বাঙালিদের অনুপ্রবেশ ও বসতি প্রদানের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরুদ্ধে ২০০০ সালে জনৈক বদিউজ্জামান ও ২০০৭ সালে এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম কর্তৃক পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উগ্র সাম্প্রদায়িক তৎপরতা ও সেনাশাসনের সুযোগে ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সেটেলারদের মধ্যে ঘাঁটি গড়ে তুলছে।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় জুম্মদের আবাসভূমি ও ধর্মীয় স্থানসহ রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় ভূমি বেদখল এবং স্বভূমি থেকে তাদেরকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও আইন মোতাবেক জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার নিশ্চিত না করে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের নামে, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে, রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণার নামে, ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হর্টিকালচার ও রাবার চাষের নামে ইজারা প্রদান করে হাজার হাজার একর জুম্মদের সামাজিক মালিকানাধীন জুমভূমি ও মৌজাভূমি জবরদখল করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পরও ভূমি জবরদখলের কারণে কেবলমাত্র বান্দরবান জেলায় আদিবাসী জুম্মরা তাদের ৩০টি গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাজেকে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন বা স্থাপনের জন্য ভূমি জবরদখলের কারণে রুইলুই-এর দুটি ত্রিপুরা গ্রামের ৬৫ পরিবার, বান্দরবানের সেপ্রু পাড়ার (জীবননগর) ১২৯ ম্রো পরিবার, আলিকদম-থানচির ক্রাউডং পাহাড়ের (ডিম পাহাড়) দুই শতাধিক ম্রো পরিবার, বান্দরবানে বগা লেকের ৩১টি বম পরিবার গ্রামবাসী উচ্ছেদের মুখে রয়েছে এবং তাদের জীবনজীবিকা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ এবং পুলিশ প্রশাসনের পুলিশ সুপার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রায় সকলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী নন। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ জুম্ম জনগণের জীবনধারার প্রতি সংবেদনশীল নন। তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী। ফলত: পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা বহুলাংশে সম্ভবপর হচ্ছে না। এ কারণেই এ যাবৎ আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যাবলী চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৯৭ সালে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করা হলেও তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব পুরোদমে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ভূমিকা পালন করে চলেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় শাখাসংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে একশ্রেণির জুম্মদের প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী ভূমিকা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেব তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হলেও আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব এসব পরিষদগুলোকে দলীয়করণ ও দুর্নীতির আখড়ায় এবং শাসকগোষ্ঠীর দালালী ও সুবিধাবাদী সংস্থায় পরিণত করে অথর্ব প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে। সারাদেশে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ তথা সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হলেও পার্বত্যাঞ্চলে সেই জঙ্গীবাদ বিরোধী কার্যক্রমকে ব্যবহার করা হচ্ছে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের ন্যায্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে। চুক্তি বাস্তবায়নের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে অপপ্রচার চালিয়ে সেনা-বিজিবি-পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পার্বত্য জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র, দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক হয়রানি চালিয়ে আসছে। তারই অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামীলীগের প্রত্যক্ষ মদদে আঞ্চলিক পরিষদের দুইজন সদস্য, উপজেলা পরিষদের দুইজন চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান ও দুইজন সদস্য এবং একজন মৌজা হেডম্যানসহ জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সহযোগী সংগঠনের ১৩০ জন সদস্য-সমর্থক ও নিরীহ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, তিনজন সদস্যকে খুন এবং অন্তত দেড় শতাধিক সদস্যকে এলাকাছাড়া করা হয়েছে।
দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে অনেক সোচ্চার হলেও এসব দল ও সমাজ নিজস্ব কর্মসূচী নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে এগিয়ে আসেনি। এযাবৎ আদিবাসী সংগঠনের উদ্যোগে আহুত কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশের মধ্যে এসব দল ও সংগঠনের কর্মসূচী সীমাবদ্ধ রয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ যেভাবে এগিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল সেভাবে নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে তাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। পার্বত্যবাসীরা, বিশেষত: জুম্ম জনগণ নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত এক চরম বাস্তবতায় মুখোমুখী হয়ে কঠিন জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। জুম্ম জনগণ এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। বস্তুত: পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে রক্ত-পিচ্ছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণ তথা পার্বত্যবাসীর অধিকার সনদ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অর্জিত হয়েছে। দেশের শাসকগোষ্ঠীর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি ও কালক্ষেপণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে আবারও জটিলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার যে কোন ষড়যন্ত্র এবং জুম্ম জনগণের এই চুক্তি বাস্তবায়নের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের যে কোন চক্রান্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। বলাবাহুল্য, জুম্ম জনগণ তার অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে যে কোন বিকল্প পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে এবং তার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে চুক্তি-পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী যে কোন ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণ বরাবরের মতো সদা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বার্ষিকীতে আবারো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শ্রী লারমা ঘোষণা দেন।
সাংবাদিকদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়নে প্রশাসন কর্তৃক আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে দুটো শাখা অফিস বানানো প্রয়োজন হলেও তা এখনো বানানো হয়নি, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা হয়নি, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রভৃতির অভাবে বিচারিক কাজগুলো করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব সেদরনের কোন বিষয়গু ছিল না। চুক্তি বাস্তবায়নে একদিকে প্রশাসন ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর চরম অনীহা, অন্যদিকে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ কর্তৃক যথাযথ পদক্ষেপ ও কর্মসূচী না নেওয়ার কারণে চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন- পার্বত্য চুক্তি হলো সেখানকার মানুষের অধিকারের সনদ। এই চুক্তি ১৯ বছরে বাস্তবায়িত না হওয়া সত্যিই দু:খজনক। আসলে চুক্তির ৪৮টি ধারা বনাম ২৫টি ধারা বাস্তবায়নের বিষয়টি অংকের বিষয় নয়। বিষয়টা হলো চুক্তির স্পিরিট কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। সবচেয়ে মূল বিষয পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের ক্ষমতায়ন। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। নৈতিক দায়িত্বের আলোকে যেন সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করে সেজন্য নাগরিক সমাজ জনসংহতি সমিতির ১০ দফার সাথে সংহতি জানাবে। ভূমি কমিশন আইন ও পার্বত্য চুক্তি নৈতিক দায়িত্ব থেকে যেন বাস্তবায়ন করে তা আমরা প্রত্যাশা করি।
আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে বাংলাদেশ আমরা আশা করেছিলাম তা পার্বত্য চট্টগ্রামে আজও অলিখিত সামরিক শাসন বিরাজমান থাকার মধ্যে দিয়ে ভুলন্ঠিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জনমত গঠন করতে হবে। নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলকে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সকল জাতির সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।