সোমবার ● ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » জাতীয় » স্টার জলসা, জি বাংলা বনাম বাংলায় ডাবিং করা সিরিয়াল
স্টার জলসা, জি বাংলা বনাম বাংলায় ডাবিং করা সিরিয়াল
মেহেদী হাসান পলাশ :: হঠাৎ করেই বাংলাদেশে বিদেশী টিভি সিরিয়ালের বাংলা ডাবিং সম্প্রচার বন্ধের দাবিতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। টেলিভিশন শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক, কলাকুশলী এমনকি টিভি চ্যানেলের মালিকরাও এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। একেবারের ৩১ ডিসেম্বরের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তার বলছেন, এই সময়ের মধ্যে যদি বাংলা চ্যানেলগুলোতে বিদেশী সিরিয়ালের ডাবিং এবং বিদেশী চ্যানেলে বাংলাদেশী কোম্পানীর বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ না করা হয় তাহলে তারা আন্দোলন করবেন। রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পাঁচ দফা দাবিতে টেলিভিশন শিল্পী ও কলাকুশলীদের একটি সমাবেশে সংগঠনটির আহ্বায়ক নাট্যকার মামুনুর রশীদ এ মর্মে ৫ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সমাবেশে উত্থাপিত পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে দেশের বেসরকারি চ্যানেলে বাংলায় ডাব করা বিদেশী সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান বন্ধ; টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ, ক্রয় ও প্রচারে ক্লায়েন্ট বা এজেন্সির ব্যতীত চ্যানেলের অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ; টেলিভিশন শিল্পের সব ক্ষেত্রে আগাম আয়কর বা এআইটি পুনর্নির্ধারণ; টেলিভিশন শিল্পে বিদেশী শিল্পী ও কলাকুশলীদের অবৈধভাবে কাজ করা বন্ধ করতে হবে এবং ডাউনলিংক চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশী চ্যানেলে দেশী বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে। মামুনুর রশীদ সমাবেশে বলেন, ‘আমাদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে বেশ কটি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সরকারকে আমরা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি না মানলে ১ জানুয়ারি থেকে দুর্বার গণআন্দোলন শুরু করব।’ তিনি বলেন, ‘যদি কোনো চ্যানেলে ১৫ ডিসেম্বরের পর একটি ডাবিং সিরিয়াল চলে, তাহলে আমরা সেই চ্যানেলের সামনে অবস্থান নেব। ১৬ ডিসেম্বর আমরা বাংলাদেশে ডাবিংমুক্ত চ্যানেল চাই।’ মামুনুর রশীদ আরও বলেন, ‘যদি কোনো চ্যানেল আমাদের একজন কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বা ব্ল্যাক লিস্ট করে, তাহলে প্রত্যেকে তাঁর পাশে দাঁড়াব। কাজেই ষড়যন্ত্রের কোনো অবকাশ নেই। কোনো চ্যানেল যদি নিজের থেকে রুগ্ণ হয়ে যায়, তাহলে আমরা তা বাঁচাতে এগিয়ে আসব। কোনো চ্যানেল বন্ধ হোক চাই না। আমাদের কলাকুশলীরা সরকারের পলিসির কারণে রুগ্ণ হয়ে যাবে, এটা আমরা হতে দেব না।’ শহীদ মিনারের সমাবেশে অভিনেতা তৌকীর আহমেদ বলেন, আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নিতে পারি, তাহলে এফডিসির যে অবস্থা হয়েছে, আমাদেরও একই অবস্থা হবে। নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী রাকায়েত বলেন, প্রত্যেকটা চ্যানেলে যদি সপ্তাহে চার-পাঁচদিন করে ডাবিং করা বিদেশী সিরিয়াল চলে তাহলে ছয়-সাত কোটি টাকার শিল্পী সম্মানী নষ্ট হচ্ছে। প্রায় ৫০ পার্সেন্ট শুটিং হাউজে কাজ নাই। অভিনেতা মোশারফ করিম বলেন, বিদেশী টিভি সিরিয়ালগুলোর সাথে বাংলাদেশী নাটকের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা বেশ মুশকিল। কারণ সেসব সিরিয়াল নির্মাণের জন্য যে অর্থ খরচ করা হয়, বাংলাদেশের নাটকের বাজেট তার তুলনায় নগণ্য। তিনি মনে করেন বাংলাদেশের নাটকের মান বাড়লে দর্শক বাড়বে। আর নাটকের মান বাড়াতে হলে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের নাটক থেকে আর্ট ডিরেকশন উঠে গেছে। ভালো মেকাপম্যান উঠে গেছে, ড্রেস ডিজাইনার উঠে গেছে। কারণ এগুলোর খরচ লাগে। অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, কোনো একটি শক্তি আমাদের ইচ্ছামতো চালাতে চাইছে, দমন করতে চাইছে আমাদের। কিন্তু আমরা তা হতে দেবো না। শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমস্যার সমাধান করতেই হবে। নির্মাতা বৃন্দাবন দাস বলেন, আজকের এই সঙ্কট আমাদের পেশার, সংস্কৃতিরও। আমাদের পরিচয়হীন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের এই আন্দোলন। অভিনেতা আবুল হায়াত বিদেশী শিল্পীরা এ দেশে কাজের ক্ষেত্রে কতটা নীতিমালা মানছে, তাদের কাছ থেকে আদৌ কোনো লভ্যাংশ আসছে কি না তা পর্যবেক্ষণের অনুরোধ জানান। অভিনেতা জাহিদ হাসান বলেন, আমরা টিভি বাক্সে বন্দি ছিলাম। এখন রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের রাস্তায় থাকতে বাধ্য করবেন না।
উপরের বক্তব্যগুলো থেকে দেখা যায়, টিভি নাটকের শিল্পী ও কলাকুশলীরা বিদেশী সিরিয়ালের বাংলা ডাবিং বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন। বিদেশী চ্যানেল প্রদর্শনের দাবি জানাচ্ছেন না। অর্থাৎ যা সরাসরি তাদের রুটিরুজির উপর আঘাত হানছে কেবল তার প্রতিবাদ করছেন। তবে শুধু বিদেশী সিরিয়াল নয়, বিদেশী চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশী পণ্যে বিজ্ঞাপন বাংলাদেশে সম্প্রচারও তাদের রুটিরুজির উপর আঘাত হানছে। সে কারণে এসবের বিরুদ্ধেও কথা বলছেন টিভি শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক ও টিভি মালিকেরা। এর কারণ বাংলাদেশের বেশ কিছু কোম্পানী ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। তারা মনে করে, ভারতীয় চ্যানেল যেভাবে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়েছে সে জন্য সেসব চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিলে তাদের দর্শকদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। কিন্তু অভিনয় শিল্পী এবং টেলিভিশনের সাথে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, এতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশী কোন কোম্পানী যাতে বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে না পারে সে জন্য তারা সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করছেন। তাদের দাবি, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করতে হবে এবং ভারতীয় পণ্যের প্রচার এ দেশে করতে হলে বাংলাদেশের টেলিভিশনে তাদের বিজ্ঞাপন দিতে হবে। এতে আয় হবে দেশীয় টিভি চ্যানেলের এবং উপকৃত হবে দেশ। কিন্তু এখন অবাধে ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে প্রচারিত হওয়ায় এ দেশের পণ্য মালিকেরা ভারতীয় টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। ফলে ভারতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন পাওয়া তো দূরের কথা দেশীয় পণ্যেরই বিজ্ঞাপন পাচ্ছে না স্থানীয় টেলিভিশন। তা ছাড়া বাংলাদেশের ক্যাবল অপারেটররা যাতে ভারতীয় টিভি চ্যানেল অবাধে ডাউনলিংক করে বাংলাদেশে প্রচার করতে না পারে সে দাবিও জোরের সাথে জানিয়েছেন টেলিভিশন মালিক শিল্পী, কলাকুশলীরা।
ও মিডিয়া ইউনিটি নামে একটি কমিটির নেতৃবৃন্দদের মধ্যে সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, বাংলাদেশের টাকা দিয়ে বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশী চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠান তৈরি করছে। সেগুলো বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য প্রচার হচ্ছে। অথচ এগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ভারতের টিভি বাংলাদেশে চলবে আর বাংলাদেশের টিভি ভারতে চলবে না, এটি হতে পারে না। অথচ সেটি হচ্ছে। বিজয় টিভির পরিচালক মহিবুর হাসান চৌধুরী বলেন, বিজ্ঞাপনের নামে বিদেশে ১০০ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। ইমার মহাসচিব রঞ্জন কুমার দত্ত বলেন, এরই মধ্যে ১০০ কোটি টাকা বিজ্ঞাপনের নামে পাচার হয়েছে। পরিচালক গাজী রাকায়েত বলেন, আমরা এখনো নিজের সংস্কৃতিকে সিস্টেমের মধ্যে আনতে পারিনি। বিদেশী অপসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করছি। নিজের সংস্কৃতিকে সিস্টেমের মধ্যে এনে বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক ও ‘মিডিয়া ইউনিটির’ আহ্বায়ক মোজাম্মেল বাবু বলেন, আইনের ফাঁকে বাংলাদেশের টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। যারা এ কাজে জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিতে হবে। বাংলাদেশের মিডিয়া জগৎ অপসংস্কৃতি দখল করার মাধ্যমে দেশে সাংস্কৃতিক চেতনাশূন্যতা তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশের বিজ্ঞাপন যারা বিদেশের চ্যানেলে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হলো। এর পর থেকে যেন তারা আর কোনো রকম বিজ্ঞাপন বিদেশী চ্যানেলে না দেয়। তারপরও যদি সেটি করা হয় তাহলে আমরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করব। মিডিয়া ইউনিটের সভায় জানানো হয়েছে, ভারতীয় চ্যানেলের দৌরাত্ম্যের কারণে বছরে ৪০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন হারাচ্ছে বেসরকারি টেলিভিশন। ভারতের মাত্র দুইটি চ্যানেল যথা স্টার জলসা ও জি বাংলা এ পর্যন্ত ৭০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ। ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বাবদ যে টাকা পাচার হচ্ছে তার বেশিরভাগই যাচ্ছে অবৈধভাবে। উক্ত আলোচনায় দুই টিভি চ্যানেল মালিক এ ঘটনার দায়ে অন্য এক মালিককে নব্য রাজাকার বলে আখ্যা দিলে নতুন বিত-া শুরু হয়। কেননা অপর দুই মালিকের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত মালিক ১০০ কোটি টাকা মানহানীর মামলা করার হুমকি দেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলে চলছে বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন। ভারতীয় বা বিদেশী কোনো ক্রেতা আকর্ষণ এ প্রচারণার উদ্দেশ্য নয়। বাংলাদেশী ক্রেতাদের আকর্ষণের লক্ষ্যেই বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে বিভিন্ন ভারতীয় চ্যানেলে। কারণ ভারতীয় অনেক চ্যানেল এখন চলছে শুধু বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য। ভারতীয় এসব চ্যানেলের অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন কিছুই ভারতে দেখা যায় না। ভারতীয় অনেক চ্যানেল বাংলাদেশে মাত্র তিন লাখ টাকা মাশুল দিয়ে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ডাউনলিংক বিম তৈরি করে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে, যা শুধু বাংলাদেশ থেকে দেখা যায়। ভারত থেকে এসব বিজ্ঞাপন দেখা যায় না। অপরদিকে ভারতে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল প্রচার করতে হলে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা ল্যান্ডিং ফি দিতে হবে রাজ্যভেদে। এ কারণে বাংলা ভাষাভাষী কলকাতায়ও আজ অবধি বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল নিবন্ধিত হতে পারেনি। বাংলাদেশে অতি সস্তায় ডাউনলিংক বিম তৈরি করে চ্যানেল চালু করতে পারায় ভারতীয় চ্যানেলগুলো খুবই কম খরচে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারছে। অপরদিকে এসব চ্যানেল প্রচুর দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছে। এ সুযোগে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান এবং পণ্যমালিকেরা ভারতীয় এসব চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বাংলাদেশী ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য। এতে করে অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ভারতীয় কয়েকটি চ্যানেলে যে সময় বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় বাংলাদেশীদের জন্য ঠিক একই সময়ে একই চ্যানেলে ভারতীয়দের জন্য আলাদা বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের জন্য আলাদা ডাউনলিংক বিম তৈরি করার কারণে এটি তারা করতে পারছে। এর ফলে ভারতীয় এসব চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিরতির সময় বাংলাদেশের দর্শকরা যে বিজ্ঞাপন দেখতে পায় তা দেখতে পায় না ভারতের দর্শকরা। তখন ভারতের দর্শকদের জন্য তারা ভারতীয় পণ্যের আলাদা বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। অর্থাৎ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিরতির সময় দুই দেশের দর্শক দুই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখতে পায়। বাংলাদেশের জন্য আলাদা ডাউনলিংক বিম তৈরির কারণে এটি তারা করতে পারছে সহজে। এতে করে ভারতীয় ওই সব চ্যানেল একই সময়ে দুই দেশের বিজ্ঞাপন প্রচার করে দ্বিগুণ আয় করছে। স্টার জলসা এবং জি বাংলায় এটি হচ্ছে।
উপরের তথ্য ও বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশী টিভি মালিক, টিভি শিল্পী ও কলাকুশলীদের উদ্বেগের কারণ মূলত তাদের আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে হুমকির সৃষ্টি হওয়া। জাতীয় স্বার্থ, দেশপ্রেম, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। বিশেষ করে গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ আকাশ সংস্কৃতি দখল করে নিয়েছে ভারতীয় মিডিয়া। এক্ষেত্রে ভারতীয় মিডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর নিম্নমানের অনুষ্ঠান ও মুনাফাখোরী মনোবৃত্তি প্রধানত দায়ী।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলে বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিবেচনায় সরকারগুলো একের পর এক টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দিয়ে গেছে। এভাবে বর্তমানে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪১টিতে। আরো চ্যানেল অনুমোদনের অপেক্ষায়। অনুমোদন পেয়েই নতুন টিভি গুলো যেনতেনভাবে মানহীন অনুষ্ঠান তৈরি করে সম্প্রচার শুরু করে। তাদের দৌরাত্ম্যে টিকতে না পেরে মানসম্পন্ন চ্যানেলগুলোও একসময় অনুষ্ঠানের মান নিচে নামাতে বাধ্য হয়। এতে বাংলাদেশের দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিলেও টিভিগুলো নির্বিকার ছিল। আবার মানহীন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মিছিলে যদি কোনো টিভিতে একটি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হতো সাথে সাথে সেই অনুষ্ঠান দিয়ে চ্যানেল মালিকরা শুরু করতো বেপরোয়া বিজ্ঞাপন ব্যবসা। ফলে দর্শকরা চাইলেই বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে পারেনি। দর্শকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেননা, রেকর্ড বলে ভাল অনুষ্ঠান পেলে বাংলাদেশী দর্শকরা তাতে সাড়া দিয়েছে। মনপুরা বা আয়নাবাজির মতো সিনেমা বাংলাদেশী দর্শকরা বিপুলভাবে গ্রহণ করেছে বলেই মাসের পর মাস এই সিনেমা দুটি এক নাগাড়ে চলেছে বিভিন্ন সিনেমা হলে। টিভি অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশী অনুষ্ঠান নির্মাতাগণ সব সময় অভিযোগ করে থাকেন ভাল অনুষ্ঠান নির্মাণের যে বাজেট প্রয়োজন বাংলাদেশে তা দেয়া হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে এটাই একমাত্র বাধা নয়। কেননা, মনপুরা বা আয়নাবাজি সিনেমা দুটোর কোনোটাই বিগ বাজেটের ছিল না। তারপরও দর্শক গ্রহণ করেছে। মূলত সিনেমা দুটির মৌলিক কাহিনী দর্শকের হলে টেনেছে। বাংলাদেশ গুণী অভিনেতার অভাব না থাকলেও গুণী নির্মাতা ও কাহিনীকার ও কাহিনীর প্রচ- অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের টিভি নাটক ও সিরিয়ালের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবো সাসপেন্স, ক্লাইমেক্সবিহীন গতানুগতিক কাহিনীর সাথে হাস্যরস মিশিয়ে সিরিয়ালগুলো তৈরি হচ্ছে। হাস্যরস সাহিত্যের অন্যতম উপাদান। কিন্তু বর্তমানের নাটকগুলোর কাহিনীকাররা কাহিনীতে হাস্যরসের উপাদান আনতে পারছেন না। আঞ্চলিক ভাষার সাহায্য নিয়ে নির্মাতা যা সৃষ্টি করছেন তাকে ভাড়ামো ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এখানে কোনো সুলিখিত চিত্রনাট্য বা সংলাপ থাকে বলে মনে হয় না। সিকোয়েন্সের উপর নির্ভর করে অভিনেতারা গড়গড় করে স্বাভাবিক কথোপকথন চালিয়ে যান। এ ধরনের মানহীন অনুষ্ঠানের কারণে বাংলাদেশের দর্শকরা বাংলাদেশী চ্যানেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ভারতীয় চ্যানেলে দিকে।
নিম্নমানের অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপন দৌরাত্ম্যে প্রথম দিকে শহুরে মানুষেরা স্টার প্লাস, জি, সনি প্রভৃতি চ্যানেলের হিন্দী সিরিয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পরে স্টার জালসা, জি বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো তাদের হিন্দী সিরিয়ালগুলো বাংলায় রিমেক করে সম্প্রচার শুরু করলে বাংলাদেশের শহরের পাশাপাশি গ্রামের দর্শকরাও দেখতে শুরু করে। মার্কেট পাওয়ায় ভারতীয় প্রায় সকল টিভি চ্যানেল তাদের বাংলা ভার্সন সম্প্রচার শুরু করে। এভাবেই বাংলাদেশের আকাশ ও ড্রয়িং রুম চলে যায় ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যের দখলে। এতে পরিবর্তন আসে জাতীয় জীবনযাপনেও। গায়ে হলুদ হয়ে যায় মেহেদী সন্ধ্যা। কাজল, কারিনা, ক্যাটরিনা বলিউডি নায়িকাদের নামের পোশাকের বাজার দখল করে নেয় ঝিলিক, পাখিরা। সে পোশাক কিনতে না পারায় অনেকে ক্ষোভে দুঃখে আত্মহত্যা করেন। ড্রয়িং রুম, বেড রুমে টিভি রিমোটের দখল নিয়ে স্বামী স্ত্রী দ্বন্দ্বে মারামারি, ছাড়াছাড়ি এমনকি হত্যাকা-ের ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। এই সব সিরিয়ালের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও পরকীয়া, লিভ টুগেদার, ফ্রি মিস্কিং ও পৌত্তলিক সংস্কৃতি বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজ জীবনে যে বিপুল প্রভাব ফেলেছে তার কথা।
বাংলাদেশের টিভি মালিক, অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের এ নিয়ে কোনো দিন কথা বলতে শোনা যায়নি। বরং সচেতন ও দেশপ্রেমিক মানুষেরা বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ করতে গেলে এই সাংস্কৃতিক কর্মী নীতিবাক্য শুনিয়ে বলেছেন, ‘সংস্কৃতি হলো প্রবাহমান নদী কিংবা মুক্ত আকাশের মতো। গ্রহণ ও বর্জনের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়। তাই জোর করে আটকে বা অবরোধ করে তাকে বদ্ধ করা ঠিক নয়।’ এভাবেই সংস্কৃতি কর্মী ও সচেতন সুশীল সমাজের মানুষের আস্কারায় এক সময় বাংলাদেশের আকাশ সংস্কৃতিতে ভারতীয় মিডিয়া একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। তবে দেশের মানুষ বাধ্য হয়ে গলাধকরণঃ করলেও মন থেকে যে তা মেনে নিতে পারেনি তার প্রমাণ তারা দিয়েছেন।
এই অবস্থার মধ্যে দীপ্ত টিভি নামে একটি টিভি চ্যানেল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতাপশালী খলিফা সুলতান সুলেমানের জীবনীভিত্তিক নির্মিত সিরিয়াল বাংলা ডাবিং করে সম্প্রচার শুরু করলে তা দ্রুতই এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, দর্শকরা এই টিভি চ্যানেলকে সুলাইমানি টিভি চ্যানেল আখ্যা দিতে শুরু করে। ঐতিহাসিক কাহিনীনির্ভর ডাবিং করা বাংলা সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা দেখে অন্যা টিভি চ্যানেলগুলোও একের পর এক মুসলিম কাহিনী ও রূপকথানির্ভর সিরিয়ালের বাংলা ডাব সম্প্রচার শুরু করে। এভাবেই হাতিম তাই, আলিফ লায়লা, ইউসুফ জোলেখা, লুকানো ভালবাসা, টিপু সুলতান, সীমান্তের সম্রাট প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত সিরিয়ালগুলো ডাবিং করে বাংলায় সম্প্রচার শুরু করলে বাংলাদেশী দর্শকেরা আবার ভারতীয় সিরিয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে এসব বাংলা ডাব করা সিরিয়ালের দিকে ফিরে আসতে শুরু করে। আর ঠিক সে সময় মাঠে নেমেছে এক শ্রেণীর টিভি মালিক, শিল্পী ও কলাকুশলী। তাদের কণ্ঠে বাংলাদেশ একতরফাভাবে সম্প্রচারিত ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের দাবি নেই। দাবি বাংলায় ডাবিং করা মুসলিম ইতিহাস ও আখ্যাননির্ভর সিরিয়াল বন্ধের। ফলে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে সুস্পষ্ট প্রশ্ন তোলা যায়। কি চান টিভি মালিক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা? তারা কি বাংলায় ডাব করা সিরিয়াল বন্ধ করে পুনরায় দর্শকদের ভারতীয় অপসংস্কৃতি ও পৌত্তলিক সংস্কৃতিনির্ভর টিভি ও সিরিয়ালের দিকে ঠেলে দিতে চান? তাদের হাবভাবে কিন্তু সেটাই মনে হয়। বাংলাদেশের দর্শকেরা বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলে মান সম্পন্ন অনুষ্ঠান দেখতে চায়। হয় টিভি মালিক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা নিজেরা তা বানান, নয়তো বিদেশী ডাবিং করা সুন্দর সিরিয়ালই চলবে। টিভি মালিক, শিল্পী ও কলাকুশলীদের অন্যায্য দাবির সাথে দেশের টিভি দর্শকেরা একমত নয়। সৌজন্যে : ইনকিলাব