মঙ্গলবার ● ১৭ জানুয়ারী ২০১৭
প্রথম পাতা » পাবনা » কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ : পাবনায় নানা আয়োজন
কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ : পাবনায় নানা আয়োজন
পাবনা প্রতিনিধি :: (৪ মাঘ ১৪২৩ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৮.৫৯মি.) পাবনার মেয়ে উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের আজ ১৭ জানুয়ারি তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এই উপলক্ষে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ তার কিশোরী বেলার বিদ্যাপিঠ পাবনা টাউন গার্লস হাই স্কুল প্রাঙ্গণে (মহাকালী পাঠশালা) এক স্মরণ সভার আয়োজন করেছে। পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
বৃহত্তর পাবনার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সেন ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল জন্ম নেন এই দীপ্তিময় প্রতিভা। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হীমসাগর লেনের একতলা পাকা পৈত্রিক বাড়িতে সুচিত্রা সেনের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তার বাবা করুনাময় দাশগুপ্ত পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারী ইন্সপেক্টর পদে চাকুরী করতেন। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিনী। দু’বোনের মধ্যে সুচিত্রা সেন ছিলেন বড়। ছোট বোন হেনা দাশগুপ্ত। শহরের মহাকালী পাঠশালায় পড়ালেখা শেষ করে সুচিত্রা সেন স্থানীয় পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পড়ালেখায় খুব একটা মনোযোগী ও মেধাবী না থাকলেও গান, নাটক, অভিনয় প্রিয় ও পছন্দের ছিল সূচিত্রা সেনের। পাবনা শহরের নানা অনুষ্ঠানে গান গাওয়া ও নাটক থিয়েটারে তিনি অভিনয়ে দক্ষতা দেখান।
উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সুচিত্রা সেন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ক’মাস আগে বাবা করুণাময় দাসগুপ্ত পাবনার বাড়ি-ঘর, চাকুরী সবকিছু ফেলে স্বপরিবারে ভারত পাড়ি দেন। কলকাতা যাবার বছর দু’য়েক পরেই সেখানকার বনেদি পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সাথে রমা দাশগুপ্তের বিয়ের পর নাম হয় সুচিত্রা সেন। আর বিয়ের পর স্বামীর পদবীতে রমা দাশ গুপ্ত হয়ে যান রমা সেন। সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেনের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশেরই দক্ষিণের এক জেলায়।
পাবনার উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রমা বনেদি পরিবারের বধু হয়ে ঘর সংসারের পাশাপাশি সিনেমায় অভিনয়ে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে “শেষ কোথায়” নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। অজ্ঞাত কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে নায়িকা হয়ে তার অভিনীত প্রথম ছবি “সাত নম্বর কয়েদি” ছবিটি মুক্তি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর সুচিত্রা সেন একটানা বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেন। স্বামী দিবানাথ সেনের প্রবল আপত্তি থাকলেও সুচিত্রা সেন মনের তাগিদে নিজেকে অভিনয়ে জড়িয়ে রাখেন। ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশগুপ্ত। তারই একজন সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় এ ছবিতে অভিনয় করার পর ছবি মুক্তির সময় রমা নাম বদলে নাম দেন ‘সুচিত্রা সেন’। এরপর থেকেই কিশোরী বেলার বান্ধবীদের রমা বাবা-মায়ের দেওয়া নাম রমা দাশগুপ্ত থেকে স্বামীর পদবী নিয়ে রমা সেন সবশেষে স্বপ্নসুন্দরী সুচিত্রা সেন হয়ে যান। সুচিত্রা সেন বাংলা ৫৬টি ও ৭টি হিন্দি মিলে মোট ৬৩টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি হয়ে বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন। ১৯৭৮ সালে উত্তম কুমার মারা গেলে সিনেমায় অভিনয় বন্ধ করে দেন।
১৯৬৩ সালে সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন সিলভার প্রাইজ ফর বেষ্ট অ্যাকট্রেস জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ভারত সরকারও তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করেন। ২০০৫ সালে তাঁকে দাদা সাহেব ফলকে পুরস্কার দেয়ার প্রস্তার রাখলে তিনি জনসমক্ষে আসতে চাননি বলে তা গ্রহন করেননি। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান বঙ্গবিভূষণ দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি দেবদাস ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন, যা ছিলো তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কোলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
সূচিত্রা সেনের অভিনীত চলচ্চিত্র নিয়ে বিগত এক দশক ধরে উৎসব করে আসছে পাবনার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই উদ্যোগ সূচিত্রা সেনকে চিরঞ্জীব রাখবে বলে মনে করা হয়। প্রতি বছর যখন এই উৎসব আয়োজন করা হয়।
২০০৯ সাল থেকে পাবনায় শুরু হয় কিংবদন্তি বাংলা ছবির নায়িকা সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসব। সূভাষ দত্ত, কবরীসহ বহু নামী দাবী শিল্পী ঐ সময় পাবনায় আসেন। এর পর থেকে একে চিত্রনায়ক ফারুক, আলমগীর, নায়ক রাজ রাজ্জাক, নায়িকা সুজাতা, রোজিনা, চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন, নায়ক উজ্জ্বল, নায়িকা দিতিসহ নবীন ও প্রবীণ নায়ক নায়িকারা এই উৎসবে আসেন। সর্বশেষ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও পাবনা জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এবং সূচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সহায়তায় ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সূচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি আয়োজনে এই উৎসব পালন সূচিত্রা সেন ও পাবনার ভাবমুর্তিকে বহুগুন বাড়িয়ে দেয়।
যার নেতৃত্বে পাবনার একদল সাংস্কৃতিকসেবি সূচিত্রা সেনকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছেন সেই মহান ব্যক্তি এম সাইদুল হক চুন্নু বলেন, সূচিত্রা সেনকে নিয়ে আমাদের আবেগের কমতি নেই। সবার সহযোগিতায় আমরা তার বাড়ী উদ্ধার করতে পেরেছি। স্ংস্কৃতি মন্ত্রণালয় শিল্পকলা একাডেমির সহায়তার তার স্মৃতি ধরে রাখতে প্রায় ২০ কোটি টাকা বয়ে বিশাল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পাবনার মেয়ে সূচিত্রা সেন আজীবন নতুন প্রজন্ম এবং বিশ্ববাসীর মনের মনি কোঠায় বেঁচে থাকবেন।