শনিবার ● ২৮ জানুয়ারী ২০১৭
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » জয়িতা অন্বেষনে গাবতলীর চার সংগ্রামী নারী
জয়িতা অন্বেষনে গাবতলীর চার সংগ্রামী নারী
আল আমিন মন্ডল, বগুড়া প্রেতিনিধি :: (১৫ মাঘ ১৪২৩ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬.৩০মি.) জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় বগুড়ার গাবতলী উপজেলা পর্যায়ে চার ক্যাটাগরীতে চার সংগ্রামী সফল বাংলার নারী নির্বাচিত হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গাবতলী উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যাগে যাচাই-বাচাই শেষে আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে জয়িতা বাচাই করা হয়।
গাবতলী উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা হয়েছেন মনিরা ইয়াছমিন। ‘সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা মোছাঃ রোকেয়া বেগম। নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করেছে যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা লিপি খাতুন ও ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা মোছাঃ আনিছা বেগম নির্বাচিত হয়েছে। বাংলার নারী ‘শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী’ জয়িতা হলেন গাবতলী হাসনাপাড়া গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী ও দূর্গাহাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের (সমাজ বিজ্ঞান) সহকারী শিক্ষক মনিরা ইয়াছমিন। তাঁর পিতা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মাতা গ্রহিণী ও ২বোন-২ভাইকে নিয়ে তার পরিবার ছিল। এর মধ্য তিনি এসএসসি ও এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেন। মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় তিনি দারিদ্রতা কে জয় করে বিএ (অর্নাস) এমএ পাশ করেছেন। এরপরও সে থেমে থাাকেনি। পড়াশুনা পাশাপাশি শিক্ষকতা নিবন্ধন পরিক্ষায় অংশগ্রহন করে নারী হিসাবে গাবতলী উপজেলায় সমাজ বিজ্ঞানে প্রথম নিবন্ধিত হয়। সরকারীবিধি মোতাবেক পরিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করে তিনি নারী শিক্ষার প্রসার ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ’সহ আর্তমানবতা সেবায় কাজ করে আসছেন। তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে ও সমাজ সেবামূলক কাজ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। ‘সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরীতে জয়িতা অন্বেষনে নির্বাচিত হয়েছেন নেপালতলীর কালুডাঙ্গা গ্রামের আলহাজ্ব সামছুল হুদার স্ত্রী মোছাঃ রোকেয়া বেগম। তিনি জানান, পিতা-মাতা’সহ আমরা ৬বোন-২ভাই ছিলাম। নি¤œবৃত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বহু দুঃখ-কষ্টের মাঝে স্কুল পেড়িয়ে কলেজে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমি বড় সন্তান হওয়ায় মা-বাবা ও ভাই-বোন সবাইকে সহেযোগিতা করতে হতো। বাড়ীতে রান্নাবান্না কাজ। এমনকি ঢেঁকিতে ধান-চাল ও আটা ভাঙ্গার কাজ করতে হতো। মূর্খ্য সমাজে লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাকে ও পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমার বিবাহ হওয়ার পর সংসার জীবনে এসে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৮সালে শিক্ষকতা পেশা শুরু করি। আমার স্বামীও বে-সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এছাড়াও আমার তিন সন্তানের মধ্যে প্রথমপুত্র আরএসএম রেজা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, ২য়পুত্র রাজু আহম্মেদ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) ও ৩য়পুত্র আরএসএম রবিন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) থেকে পাস করে তিন সন্তানই অষ্ট্রোলিয়ায় নাগরিকত’¡সহ চাকুরিরত রয়েছে। সবমিলিয়ে আমি আমার স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা ও খুব সুখে দিন কাঁটছে। ফলে রোকেয়া বেগমের পরিবারে সুদিনের বাতাস বইছে। অপরদিকে ‘নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করেছে যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা হয়েছে গাবতলীর নাড়–য়ামালা বাইগুনি জয়ভোগা মধ্যপাড়া গ্রামের আব্দুল গফুর প্রাং স্ত্রী লিপি খাতুন। তাঁর ২০০৭ইং সালে বগুড়ায় বিয়ে হয়। ৮ম শ্রেণী পাশ করার পর বিবাহ ৮মাসের মাথায় সংসারে নেমে আসে চরম দুরদিন ও হতাশা। পরিবারে সাংসারিক ঝগড়াকলহ চলতে থাকলে একপর্যায়ে তাঁর সংসার ভেঙ্গে যায়। ফিরে আসে বৃদ্ধ পিতা-মাতার বাড়ীতে। সেখানে দরিদ্র ও অসহায় পিতার সংসারে নিজেকে অসহায় ও একাতীত্ব জীবনযাপন করতে থাকেন। এরপর লিপির শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। নিজেকে স্বাবলম্বী করতে লিপি দর্জি প্রশিক্ষণ গ্রহন করে। দর্জির কাজের পাশিাপাশি সে যে অর্থ আয় করতেন সে টাকায় চলতো পিতা-মাতা ও তার সংসার। লিপি জানান, স্বামীর নির্যাতনের কথা মনে পড়লে ‘গাঁ’ যেন শিউড়ে উঠে। এরপরেও নিজের জীবনের ভবিষ্যতের কথাচিন্তা করে পুরোনো দিন গুলো পিছনে ফেলে রেখে আত্মস্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সে। ফলে নিজের পায়ে দাড়াতে আজ আমি সক্ষম হয়েছি। সুস্থ্য-সুন্দর জীবন গঠনে নির্যাতনের বিভিষিকা কে প্রজ্বোলিত করে আবারো নতুন উদ্যেমে জীবনটা কে শুরু করেছি। আশাকরছি জয়িতা অন্বেষনে আমাকে নির্বাচিত করায় আগামীদিনে আমার মত অনেক নির্যাতিত নারী দরিদ্র জনপথে নারী ক্ষমতায়নে নতুন বিপ্লবের সূচনা হবে। সর্বশেষ ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী’ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ট জয়িতা হন মোছাঃ আনিছা বেগম। সে গাবতলী’র পদ্মপাড়া গ্রামের আবু তালেবের স্ত্রী। ১৯৯০সালে বিবাহ হলে সে ১ছেলে-১কন্যার জননী হন। তাঁর সংসার জীবনে পরিশ্রম ও স্বামীর অর্থে সংসার চলতো। এরপরেও সে সমাজ ও জনকল্যাণ মূলক কাজ করার জন্য তিনি ১৯৯৭ ও ২০১১সালে ইউপি নির্বাচনে নারী সদস্য পদে নির্বাচিত হন। প্রশিকা সমিতির মাধ্যমে অসহায় বয়স্কদের নিরক্ষতা দূরীকরনে ভূমিকা রেখেছেন সে। অসহায় নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান ও পুষ্টি প্রকল্প মাধ্যমে দুঃস্থ মহিলা ও শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূরীকরন এবং স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে গনসচেতনতা সৃষ্টি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন তিনি। এমনকি সে বিপদের সময় অসহায় গর্ভবতী নারীদের হাসপাতালে পাঠানো ও স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে তথ্যসেবা প্রদান করে আসছেন। আনিছা বেগম আরো জানান, গরীব ছেলে-মেয়েদের বিবাহ, বাল্য-বহু বিবাহ রোধ, যৌতুক প্রতিরাধ, শিশু-মহিলা ও নারী নির্য়াতন প্রতিরোধ, কিশোর-শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরন এবং মাদকাসক্তি বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমাজে গনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে আসছি। এমনকি নারীদের কে হাস-মুরগী পালন, সবজি চাষ ও কুঠির হস্ত-শিল্পের কাজে আগ্রহী করে তুলতে উৎসাহ প্রদান করে আসছি। এভাবে তিনি সরকারী-বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র নারীদের ও সমাজ উন্নয়নে কল্যাণমুখী কাজ করে সমাজের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসচ্ছেন। এরপরেও সে নারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, কুসংস্কার দূরীকরন ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরনে কাজ করছেন। বঞ্চিত নারীদের স্বাবলম্বী করতে অনুপ্ররনা দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও আনিছা বেগম একজন উদীয়মান অক্লান্ত পরিশ্রমী সফল নারী। নানাপ্রতিকূলতা সঙ্গে লড়াই করে সমাজ উন্নয়নে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। একদিকে তিনি নিজে স্বাবলম্বী অপরদিকে সমাজ উন্নয়নে তিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এছাড়াও সে সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও দারিদ্রতা দূরীকরনে অবদান রেখেছেন। জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ গাবতলী উপজেলা পযার্য়ে কমিটির আহবায়ক গাবতলী সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইউএনও (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রামকৃষ্ণ বর্মন জানান, জয়িতা অন্বেষনে চার ক্যাটাগরীতে চারজন কে নির্বাচিত করা হয়েছে। চার জনই সমাজ ও জনকল্যাণ মূলক কাজে ভিন্নভিন্ন ভাবে অবদান রয়েছে। সদস্য সচিব ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ আশরাফ আলী জানান, শতাধিক আবেদনের মধ্য যাচাই-বাচাই শেষে চার জনকে জয়িতা নির্বাচিত করা হয়। আশাকরছি, নির্বাচিত বা বিজয়ী গাবতলীর চার জয়িতা আগামীদিনে সমাজ উন্নয়নে আরো গুরুত্বপূন্ন ভূমিকা রাখবেন।