রবিবার ● ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » পরবাস » বর ফরাসি বধূ বাঙালি
বর ফরাসি বধূ বাঙালি
বিয়ের আসর। বরের মাথায় টোপর, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। সাত পাক ঘুরে বর পড়লেন মন্ত্র, ‘যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।’ বাঙালির বিয়েতে এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু এই দৃশ্যই বিশেষ হয়ে ওঠে যখন বরটি হয় ফরাসি মুলুকের।
গত ১৭ আগস্ট চট্টগ্রামের ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পরিচালক ৩৫ বছর বয়সের রাফায়েল ইয়েগার সাত পাকে বাঁধা পড়লেন চট্টগ্রামের মেয়ে ২৫ বছর বয়সের মৌটুসী বণিকের সঙ্গে। বাদামি চুলের সুদর্শন রাফায়েল চট্টগ্রাম আলিয়ঁসে যোগ দিয়েছিলেন দুই বছর আগে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) পাস করা মৌটুসীও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ছাত্রী। তিন বছর ধরে ফরাসি ভাষা শিখছেন তিনি। পাশাপাশি এই কেন্দ্রে ভাষা শিখতে আসা শিক্ষার্থীদের ফরাসি ভাষার প্রাথমিক পাঠও দিচ্ছেন। আলিয়ঁসে মৌটুসী কাজের সূত্রেই পরিচিত হন রাফায়েলের সঙ্গে। তবে কী করে সখ্য গড়ে উঠল, সে কথা বর-কনে শোনালেন নিজ মুখে। ১৫ সেপ্টেম্বর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে তাঁদের আলাপচারিতায় উঠে এল দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ঘর বাঁধার গল্প।
বিয়ের এক মাস গেছে মাত্র। এর মধ্যে নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাফায়েল। তবে দাম্পত্য জীবনেও আছেন শতভাগ। জানালেন, মৌটুসীর পাশাপাশি বাঙালি খাবারের রান্নাও শিখেছেন। মাছ ভাজা, ডাল আর ভাত বেশ পছন্দ হয়ে গেছে। রুপচাঁদা মাছও রান্না করেছেন এর মধ্যে।
ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির দূত হয়ে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরেছেন রাফায়েল। শেষমেশ হয়েছেন চট্টগ্রামের ‘জামাই’। বিষয়টা মৌটুসীকে বুঝিয়ে বলতে হলো। বাঙালি বধূর বর আত্মীয়স্বজন আর এলাকার লোকজনেরও জামাই। শুনে রাফায়েল হাসিমুখে বললেন, ‘আসলে বিয়েটা করার আগে আমি জানতাম না চট্টগ্রামের লোকজন কীভাবে নেবে। বিষয়টা নিয়ে ভাবনা ছিল। কিন্তু দেখলাম, এখানকার লোকজন বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানায়।’
মৌটুসীর সঙ্গে ঘর বেঁধে রাফায়েল এখন চট্টগ্রামের জামাই l জুয়েল শীলকী করে ভালো লাগা জন্ম নিল—এমন প্রশ্নের উত্তরে রাফায়েল বলেন, ‘এখানে পরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একা থাকতাম। তখন সংস্থার কাজের মধ্যে ডুবে ছিলাম। নিজেকে নিয়ে ভাবতাম না। কিন্তু মৌটুসীকে দেখার পর বুঝতে পেরেছি, আমি নিঃসঙ্গতায় ভুগছি।’
প্রথম দর্শনে প্রেম? মৌটুসী বললেন, ‘না, তেমনটা নয়। আসলে কাজের সূত্রে আমরা কাছাকাছি এসেছি। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে পরস্পরকে জেনেছি। একসময় আবিষ্কার করেছি, ওর প্রতি আমার মধ্যে বিশেষ অনুভূত তৈরি হয়েছে।’
কে আগে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে—এমন প্রশ্ন করতে রাফায়েল নিজের দিকে ইঙ্গিত করলেন। বললেন, ‘আসলে নার্ভাস না হলেও সে সময় নিজের কথাটা বলার জন্য ছটফট করছিলাম। আর আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিলাম এ বিষয়ে। কারণ, আমাদের মধ্যে যে রসায়ন ঘটছিল, তা বুঝতে সমস্যা হয়নি তখনো।’ আর রসায়নটা কী করে ঘটেছিল, সেটাও শোনালেন মৌটুসী-রাফায়েল দম্পতি।
উদ্যমী তরুণী হিসেবে মৌটুসী আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। কোনো বিতর্ক সভার আয়োজন, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী অথবা সাংস্কৃতিক উৎসব—সব কাজেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন মৌটুসী। ছিলেন বায়োডাইভার্সিটি ক্লাবের সদস্য। এর মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ভালো ফল করে ফ্রান্স থেকেও ঘুরে এসেছেন তিনি। পাশাপাশি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ভাষাবিষয়ক প্রতিটি পরীক্ষায় তাঁর ফলাফল ছিল ঈর্ষণীয়। রাফায়েলের কথায়, এমন মেধাবী, সুন্দরী আর উদ্যোগী নারী কম আছেন। তাঁর চোখে মৌটুসীর বড় গুণ এই উদ্যম। কেবল তিনি নিজে নন, অন্যকে দারুণভাবে উদ্যমী করে তোলেন।
অন্যদিকে রাফায়েলের আত্মবিশ্বাস মুগ্ধ করে মৌটুসীকে। উদাহরণ হিসেবে তাঁর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার ঘটনার কথা মনে করলেন তিনি। মৌটুসীর বাবা শ্রীকৃষ্ণ বণিক ও মা রত্না চক্রবর্তী দুজনেই চিকিৎসক। এর আগে তাঁর বড় বোনের বিয়েতে দুজনের সঙ্গে আলাপও হয়েছে রাফায়েলের। কিন্তু বিয়ের কথাটা কীভাবে বলবেন, তাঁরা মেনে নেবেন কি না, এ ব্যাপারে খানিকটা দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাকে রাফায়েল সামলালেন খুব দক্ষতার সঙ্গে। হবু শ্বশুর-শাশুড়িকে বললেন, ‘আমি আপনাদের মেয়েকে চুরি করতে আসিনি। সবার সম্মতি নিয়েই তাঁকে গ্রহণ করব।’
বিয়ে উপলক্ষে রাফায়েলের মা–বাবা সুইজারল্যান্ড থেকে উড়ে এসেছেন। ১৯ আগস্ট নগরের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় বিবাহোত্তর সংবর্ধনা। কেমন লেগেছে বাঙালি রীতিতে বিয়ে করতে? রাফায়েলের উত্তর, সব মিলিয়ে দারুণ! তবে খুব বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। রাস্তায় পানি জমে গিয়েছিল। তবু খুব ভালো লেগেছিল। মৌটুসী জানান, গায়েহলুদের দিন রাফায়েলের আসার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি পাঞ্জাবি পরে ফুল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ফরাসি বরের এমন চমকে দেওয়া ভালোই লেগেছিল তাঁর।
বিয়ের পর দুজনে ঘুরে এসেছেন কক্সবাজার। পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত মুগ্ধ করেছে রাফায়েলকে। এর বাইরে ইনানীর পাথুরে সৈকত, হিমছড়ির কথাও মনে আছে।
এ দেশে আরও দুই বছর থাকতে চান রাফায়েল। এরপর দুজনে কোথায় থিতু হবেন, তা এখনো ঠিক করেননি। তবে একটা লক্ষ্য স্থির করেছেন ইতিমধ্যেই। সেটা হলো শতভাগ বাঙালি হওয়া। ইতিমধ্যে বাংলা শিখেছেনও কিছু। তার নমুনা দিতে বললেন, ‘আমি বাংলাদেশ বাসি ভালো।’