বৃহস্পতিবার ● ৫ নভেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম » তিন ফসলি কৃষিজমিতে আবাসন প্রকল্প, বসুমতি আনোয়ারা সিটির নামে প্রতারণার ভয়ংকর ফাঁদ!
তিন ফসলি কৃষিজমিতে আবাসন প্রকল্প, বসুমতি আনোয়ারা সিটির নামে প্রতারণার ভয়ংকর ফাঁদ!
সামসুদ্দীন চৌধুরী, আনোয়ারা থেকে ফিরে:: কৃষি দপ্তর কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমতি ছাড়ায় চট্টগ্রামের আনোয়ারায় তিন ফসলি কৃষিজমিতে “বসুমতি আনোয়ারা সিটি”র নামে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলছে হিরাঝিল প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে উপজেলা প্রশাসন ওই প্রকল্পের কার্যালয় সিলগালা করে দিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেও অদৃশ্য কারনে একই বছরের নভেম্বর মাসে উপজেলা প্রশাসন প্রকল্পটির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। হিরাঝিল প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এই আবাসন প্রকল্প নিয়ে এলাকায় জনরোষ দেখা দেওয়ার পর সেটি বন্ধ করা হয়েছিল।
সূত্র বলছে, সাবেক আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আহমেদ প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে কিছু দিনের মধ্যে বদলি হয়ে যায় তিনি। নতুন ইউএনও শেখ ফরিদ আহম্মদ আসার পরে তিনি “বসুমতি আনোয়ারা সিটি” প্রকল্পের বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে দাবী করেছিলেন হিরাঝিল প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের প্রকল্পের কার্যালয় সিলগালা করার প্রক্রিয়া বৈধ ছিল না। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার আগের ইউএনও তাদের কাজ বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু ওই সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র তিনি পাইনি। তাদের কাছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করার অনুমতি আছে বলে ইউএনও শেখ ফরিদ আহম্মদ দাবী করেছিলেন। তবে তারা কৃষিজমি আবাসনের কাজে ব্যবহারের অনুমতি পায়নি বলে তিনি স্বীকারও কলেছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকল্পটির প্রস্তাবিত আয়তন ৭০০ একর। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কেনা জমির পরিমাণ মাত্র সাত একর। প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে আরও জমি কেনার চেষ্টা করছে।
আনোয়ারার বারখাইন ইউনিয়নের মাজার গেট এলাকায় আনোয়ারা বাঁশখালী পিএবি সড়কের পাশে কৃষিজমিতে এই প্রকল্প গড়ে উঠছে। এসব জমিতে এখনো আউশ, আমন ও বোরো ধান চাষ হচ্ছে। জমিতে ‘বসুমতি আনোয়ারা সিটি’ আবাসন প্রকল্প নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তারা আশপাশের জমি কিনে অনেক কৃষককে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করছিল। এ নিয়ে এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছিল। আগে যাঁরা বসুমতি সিটি বন্ধের জন্য আন্দোলন করেছিলেন এখন তাঁরা মুখ বন্ধ রেখেছেন। ভয়ে স্থানীয় কৃষকেরাও মুখ খুলছেন না।
স্থানীয় একাধিক কৃষকের অভিযোগ, আশপাশের জমি কেনার পর প্রতিষ্ঠানটি এখন তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করছে। ৭০০ একরের আবাসন প্রকল্পের নামে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেদারসে প্লট বিক্রি শুরু করেছে হিরাঝিল প্রপার্টিজ। এ জন্য কৃষিজমিতে আবাসন করার বিষয়ে জেলা প্রশাসন কিংবা কৃষি দপ্তরের কোনো অনুমোদন নেয়নি বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করেছেন।
সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, ‘মূল আনোয়ারা এবং আশপাশের এলাকা সিডিএর আওতাভুক্ত। মূল সড়কের পাশে কৃষিজমিতে আবাসন প্রতিষ্ঠান করার জন্য কেউ সিডিএর কাছ থেকে অনুমতি নেয়নি।’
‘আইনে আছে কৃষিজমি অকৃষি জমিতে রূপান্তরের জন্য অনুমতি নিতে হবে।
বঙ্গোপসাগর আর শঙ্খ নদীর উত্তরে আনোয়ারা উপজেলায় সাধারণ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারণার খেলায় মেতে উঠেছে বসুমতি আনোয়ারা সিটি। তিন ফসলি জমিতে অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট শহর নির্মাণের টোপ ফেলে পেতেছে ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ। তাদের এ প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়ে নিংস্ব হওয়ার পথে সহস্রাধিক মানুষ। অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে উঠে এসেছে তাদের এসব প্রতারণার রহস্য।
প্রতিবেদকে বিভিন্ন সূত্রে জানায়, ২০১১ সালে পিএবি সড়কের ঝিওরি মাজার গেট এলাকার ঝিওরি বিলে বসুমতি আনোয়ারা সিটি নামের একটি আবাসিক প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকাস্হ হিরাঝিল প্রপার্টিজ। শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাদের এ প্রকল্প। ২০১২ সালে প্রশাসন তাদের কাছে পরিবেশ ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসনের অনুমোদনের কাগজপত্র চাইলে তারা কিছুই দেখাতে পারেনি। এসময় বসুমতি আনোয়ারা সিটির নামে কোনো জমি নামজারি করা হবে না বলে উপজেলা ভুমি অফিস ঘোষণা দেয় । সে থেকে আজ পর্যন্ত আর কোনো নামজারি তারা করতে পারেনি।
স্থানীয় বারখাইন ইউনিয়ন ভুমি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত বসুমতি আনোয়ারা সিটির বিপরীতে জমির নামজারির পরিমাণ ২ একর ৯ শতক। তাছাড়া আরো ২৭ শতক জমির নামজারির জন্য তারা আবেদন করেছেন। বরুমচড়া ভূমি অফিস থেকে আরো কিছু জমি নামজারি করা হয়েছে। সর্বমোট তিন একরের কাছাকাছি তারা জমি নামজারি করেছে। অথচ ইতিমধ্যে গ্রাহকদের মাঝে বিক্রি করেছে তার কয়েকগুণবেশি জমি। বর্তমানে হাজারের কাছাকছি প্লট তারা গ্রাহকদের নিকট বিক্রি করেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং টিভিতে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা গ্রাহক বাড়াতে থাকে। পরে তাদের দেয়া ঠিকানায় গ্রাহক পৌঁছলে তাদের নিজস্ব লোক দ্বারা নিজস্ব বাহনে করে গ্রাহককে নিয়ে যাওয়া হয় প্রকল্প এলাকায়। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকে তাদের বেতনভূক্ত বেশ কয়েকজন কর্মচারী। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা গ্রাহকদের গোটা বিল বসুমতি ক্রয় করেছে বলে জানায়। এরপর গ্রাহকরা সরল বিশ্বাসে তাদের দেয়া লোভনীয় ফাঁদে আটকে যায়। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের জায়গা জোরপূর্বক দখল এবং সংখ্যালঘুদের শ্বাশান দখলেরও অভিযোগ রয়েছে। চেয়ারম্যানঘাটা এলাকায় তাদের দ্বিতীয় সাইট অফিসটি নির্মাণ করা হয়েছে স্থানীয় মোস্তাক আহমদ নামের একজনের জমির উপর অবৈধভাবে।
বসুমতি আনোয়ারা সিটির নামে প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারা উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রতিবেদকের প্রশ্নশুনে ব্যস্ততার দাবী জানিয়ে প্রথমে উপজেলা ভুমি কর্মকর্তা পরে সাবেক ইউএনও দের কারসাজির বিয়য়ে প্রশ্নশুনে ১ ঘন্টা পরে ফোন করার কথা বলে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
জানতে চাইলে বসুমতি আনোয়ারা সিটির নামে প্রতারণার বিষয়ে আনোয়ারা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মৃণাল কান্তি ধর জানায়, বসুমতি আনোয়ারা সিটি সম্পূর্ণ অবৈধ একটি প্রতিষ্ঠান। তবে আমি বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপরি জানিনা। আমি বিষয়টি খুজ নিয়ে দেখব।
হিরাঝিল প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের অপকর্মের বিষয়ে আনোয়ারার সাংসদ ভুমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ জানায়, বসুমতি আনোয়ারা সিটির জন্য কেউ কোন ধরনের অনুমতি দেয়নি তাদের। আপনি এই বিষয়ে আনোয়ারা ইউএনও’র সাথে কথা বলেন। ইউএনও প্রতিবেদকের প্রশ্ন শুনে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার বিষয়টি ভুমি প্রতিমন্ত্রীকে জানালে তিনি এই বিষয়ে ইউএনও সাইফুল ইসলামের সাথে কথা বলবেন বলে জানান। এবং বসুমতি আনোয়ারা সিটি কিভাবে হচ্ছে বিষয়টি দেখবেন বলে প্রতিমন্ত্রী প্রতিবেদকে নিশ্চিত করেছেন।
এই বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের অর্থসম্পাদক সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুছ ছালাম কে বারবার ফোন করা হলে তিনি মুঠোফোন রিচিভ করেননি।
এই বিষয়ে হিরাঝিল প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড এর জেনারেল ম্যানেজার (এস্টেট) শামসুল আনাম জানায়, আমরা সরকারী সকল অনুমতি নিয়ে বৈধ কাগজপত্র দিয়ে বসুমতি আনোয়ারা সিটির কাজ শুরু করেছি। ভুমি প্রতিমন্ত্রীর ও অনুমতি আছে। তবে লিখিত কোন অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা কোন সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন ৭০০ একর জমির মধ্যে হিরাঝিল প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড মাত্র ৩ একর নামজারী করিয়েছে। তার মধ্যে ১২০ টি প্লট বিক্রি করেছে বসুমতি আনোয়ারা সিটি ।
আপলোড : ৫ নভেম্বর ২০১৫ : বাংলাদেশ : সময় : রাত ৯.৩০ মিঃ