বুধবার ● ২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
প্রথম পাতা » অপরাধ » গৃহকর্মী’র কাজের কথা বলে সৌদি আরবে যৌনবৃত্তিতে নিয়োগ করা মেয়েটি দেশে ফেরত
গৃহকর্মী’র কাজের কথা বলে সৌদি আরবে যৌনবৃত্তিতে নিয়োগ করা মেয়েটি দেশে ফেরত
ঢাকা প্রতিনিধি :: (১০ ফাল্গুন ১৪২৩ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় দুপুর ২.১৭মি.) সৌদি আরবে ‘গৃহকর্মী’র কাজের কথা বলে যৌনবৃত্তিতে নিয়োগ করা হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার সেই তরুণীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মঙ্গলবার ভোরে তরুণী ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান।
সেখান থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা ঢাকার কার্যালয়ে নিয়ে প্রাথমিকভাবে তরুণীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। বিকেলে তাঁকে ঢাকা থেকে এনে হবিগঞ্জের বিচারিক হাকিম বেগম লায়লা মেহের বানুর আদালতে হাজির করা হয়। বিচারক তাঁর খাসকামরায় মেয়েটির জবানবন্দি গ্রহণ করে তাঁকে পরিবারের জিম্মায় দেন।
সন্ধ্যায় সিআইডি পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেয়েটিকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে পাঠায়। একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন থাকায় আজ বুধবার ২২ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে মেয়েটির ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা করা হবে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী জানান, মেয়েটি দালালদের খপ্পরে পড়ে সৌদি আরবে পাচার হয়েছিলেন। সেখানে মেয়েটি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। মেয়ের পরিবারের কাছ থেকে তাঁর ওপর নিষ্ঠুরতার ঘটনা জানতে পেরে তিনি মেয়েটিকে উদ্ধারে পদক্ষেপ নেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে। তাঁদের সহযোগিতায় সিআইডির কর্মকর্তা শাহ আলম গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকার নয়াপল্টন এলাকার গ্রিন বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে দালাল চক্রের তিন সদস্যকে আটক করেন।
এ সময় পাচারের অপেক্ষায় থাকা হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ১৩ বছরের এক কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয় ২৫টি পাসপোর্ট, রেজিস্টার খাতা ও মোবাইল নম্বর।
আটক ব্যক্তিরা হলেন গ্রিন বেঙ্গল ট্র্যাভেল এজেন্সির মহাব্যবস্থাপক মো. শাহজানুর রহমান, পরিচালক এরশাদ উল্লাহ ও আবু তাহের। তাঁদের মধ্যে আবু তাহেরের বাড়ি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের ফরিদপুর গ্রামে। শাহজানুর রহমানের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বাগদানা গ্রামে। এরশাদ উল্লাহর বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কাতালিয়া গ্রামে। বর্তমানে তাঁরা হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে আছেন।
আটক তিনজনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ১৬ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের দাম্মাম থেকে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ওই তরুণীকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর মেয়েটিকে সৌদি আরবের একটি আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাঁকে বাংলাদেশে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালতের আদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস তাঁকে দেশে পাঠায়। সন্ধ্যায় মেয়েটি হবিগঞ্জের বিচারিক হাকিম আদালতে সৌদি আরবে তাঁর ওপর পাশবিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সিআইডি সিলেট অঞ্চলের উপপরিদর্শক (এসআই) সুমন মালাকার সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানান, গ্রেপ্তার হওয়া তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আজ বুধবার তাদের রিমান্ড শুনানি হবে।
তরুণীর আধা ঘণ্টাব্যাপী মুঠোফোনের কথাবার্তা ও আত্মীয়স্বজন সূত্রে জানা গেছে, দরিদ্র বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে ওই তরুণী ঢাকার গ্রিন বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে গত ৬ ডিসেম্বর গৃহপরিচারিকার চাকরি নিয়ে সৌদি আরবের দাম্মামে যান। কিন্তু তাঁকে গৃহপরিচারিকার কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানের ১৯ নারীর সঙ্গে তাঁকেও বন্দি করে রাখা হয়। সেখানকার দালাল তাঁদের তিন-চারদিনের জন্য একেকজন সৌদি নাগরিকের কাছে ভাড়া দেয়। এরপর শুরু হয় তাঁদের ওপর শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন। সেখানে তাদের উপার্জিত অর্থও দালালরা নিয়ে যায়। কেউ কোনো প্রতিবাদ জানালে তাঁকে কিল-ঘুষি-লাথি মারা হয়।
তরুণী বিষয়টি মুঠোফোনে তাঁর বাবা-মাকে জানিয়ে তাঁকে উদ্ধার করার আকুতি জানান। ফোন করেই বলেন, ‘আম্মা, আম্মা গো, আমারে বাঁচাও তাড়াতাড়ি। আমারে বেইজ্জতি থাইকা বাঁচাও। বাবা আমারে বাঁচাও।’ তরুণী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানসহ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এরপর তরুণীর দরিদ্র বাবা-মা নেতাদের কাছে মুঠোফোনের কর্তাবার্তার আধা ঘণ্টার রেকর্ড নিয়ে দৌড়ালে তাঁরা তাঁদের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করতে বলেন। দেশীয় দালালদের কাছ থেকে খবর পেয়ে সৌদি আরবের দালালরা ওই তরুণীর কাছ থেকে মুঠোফোন নিয়ে যায়। পরে কোনো উপায় না পেয়ে তরুণীর বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন ছুটে যান হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য (এমপি) অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর কাছে।
এমপি কেয়া চৌধুরীর প্রচেষ্টায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে গ্রিন বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে দালাল চক্রের তিন সদস্যকে আটক করেন। ওই দিন সন্ধ্যায় তিনজনকে হবিগঞ্জ আদালতে হাজির করা হয়। জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নিশাত সুলতানা তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।