বৃহস্পতিবার ● ২৩ মার্চ ২০১৭
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » কলসি বাদক ‘রাজিব কানা’ এক সুর স্রষ্টা নায়ক
কলসি বাদক ‘রাজিব কানা’ এক সুর স্রষ্টা নায়ক
নজরুল ইসলাম তোফা :: (৯চৈত্র ১৪২৩ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় সকাল ১১.৫৫মি.) মানব জাতির এক ধরণের নেতিবাচক ধারণা অন্ধ, বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধীরা পরনির্ভরশীল, অন্যের মুখাপেক্ষী, নিজ পরিবার তথা সমাজের বোঝা স্বরুপ অতিশয় হতদরিদ্র অকর্মণ্য মানুষ। কালের সাক্ষী স্বরূপ দৃষ্টান্ত মিলে মিশরীয় সাহিত্যে অন্ধ প্রতিবন্ধী ড. ত্বহা হুসাইন। তিনি প্রখ্যাত গুনি ব্যক্তি নিদর্শন হয়েই শুধু থাকেনি। সর্বকালের আলোচিত অন্ধ প্রতিবন্ধী হাজারো প্রতিকুলতায় উত্তীর্ণ হয়ে সাহিত্যিঙ্গনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। এতেও তিনি ক্ষান্ত হননি, অর্জন করেছেন মিশরীয় রাষ্ট্রের গুরু দায়িত্ব অর্থাৎ শিক্ষামন্ত্রী হয়ে জনগণের কল্যাণে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে পেয়েছেন। তিনি শুধুই এই অবদানের স্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশে ক্ষান্ত নন, অবাক করে দেয়ার মতোই তাঁর অর্জন রয়েছে, মানুষের প্রতি কিভাবে অকৃত্রিম ভালোবাসা অর্পণ করতে হয় তা যুগে যুগে আদর্শ হয়ে রবে। মিশরীয় শিক্ষামন্ত্রীর, অলংকৃত এমন পদে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সত্যিই আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত মূলক উদাহরণ। এমন কৃতিত্বপূর্ণ, আলোকিত অন্ধ ব্যক্তির সাদৃশ্য পূর্ণ অন্য যোগ্য ব্যক্তি চোখে ধরা না পড়লেও কখনো সখনো কিছু সফল হতদরিদ্র অন্ধ মানুষ চোখে পড়ে। দারিদ্রের কষাঘাতে সেসব মানুষ আজব আজব পন্থায় উপার্জনের পথ খুঁজে নেয় পেটের ধান্দায়। কৌশলী ভাবেই হোক অভাবের তাড়নায় নিজ কাঁধে তুলে নেয় উপার্জনের দ্বায়-দ্বায়িত্ব। তাদের সংগ্রামী উপার্জনের পথ হয়ে যায় জনতার রাজপথ, বাস, ট্রেন, নৌকা, হাটবাজার, গ্রামীণ পথঘাট এবং অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর মনোরম পার্ক। এই সব দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর জীবনে নেমে আসে উদ্ভট উদ্ভট কষ্টসাধ্য চিন্তা আর পরিকল্পনা। সংসার পরিচালনার লক্ষ্যে জীবন যুদ্ধের লড়াইয়ে উপার্জনের অদম্য সাহস সৃষ্টি করে ফেলে কেউ কেউ। তাদেরই মধ্যে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রাজীব কানা।
গানের সুরে বলে,…
আর কতকাল কলসি বাজাই
হাতে কড়া পড়ে যায় ব্যাথা ধরে যায়।
কন্ঠ ভালো ছিল ভাই আমার
যাই বলে ব্যাকিং নাই।।
বাড়ী আমার তানোর থানা
নাম রাজিব কানা ভাই।।
এভাবে স্বরচিত গানে সিলভার কলসে তাল তুলে অপূর্ব ছন্দের মূর্ছনা ছড়িয়ে দেয় রাজশাহীর মনোরম পরিবেশ তথা পদ্মার পাড়ে। তাছাড়া রাজশাহীর কোর্টে তাকে অনেক বেশি দেখা মেলে। শুধুই যে রাজশাহী তা কিন্তু নয়, বাস, ট্রেন, নৌকা, গ্রামের হাট বাজার, শহরের উন্মুক্ত মঞ্চ পদ্মার পাড়ে বিভিন্ন গানের পশরা সাজিয়ে দর্শকদের অনেক আনন্দ দিয়ে থাকে। মাউথ স্পিস দু’পায়ের হাঁটু মাঝে রেখে টেপ রেকর্ডারের স্পিকার বাজিয়ে মিষ্টি মধুর কণ্ঠে অসাধারণ সাউন্ড প্লে করে।
নিত্যসঙ্গী সিলভারের কলস, একে দড়ি দিয়ে বেঁধে এক কাঁধে ঝুলিয়ে আর অন্য কাঁধে পুরনো আমলের টেপ রেকর্ডার মাফলার দিয়ে বেঁধে দুর-দুর্দান্তে অর্থ উপার্জনে ছুটে বেড়ায়। কিন্তু প্রতিবন্ধী রাজিব কানা শুধুই যে অন্ধ তা নয়, পায়েরও সমস্যা প্রকট। সঠিক ভাবে চলা ফেরায় ব্যর্থ। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যোগাযোগের জন্য অর্থ খরচ হয় অনেক। জানা গেল হাট-বাজারে অনেক বেশী অর্থ উপার্জন হয়। কিন্তু যোগাযোগ মাধ্যম ব্যয় বহুল হওয়ায় সে অর্থ ঘরে আসে না। তবে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ ভালো, কেউ কেউ খুশি হয়ে চা, রুটি, বিস্কুট আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়, কুশল বিনিময়ে মোবাইল নম্বর চায়। আমার নিজস্ব মোবাইল নম্বর না থাকায় বাড়ির পাশের একজনের নম্বর দিয়ে থাকি। (01719897482) কারণ গ্রামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে ডাকে এবং অনেক অর্থও দিয়ে থাকে।
আমাদের জাতির গর্ব এই হতদরিদ্র ছেলেটি। তার দরদী মিষ্টি মধুর কণ্ঠ, সত্যিই প্রতিবন্ধীর রাজ্যে আসলেই সুর-সম্রাট। উত্তর বঙ্গের এই প্রতিশ্রুতশীল শীর্ষ প্রতিবন্ধী রাজিব কানাকে চিনে না এমন মানুষ খুব কম আছে। তার স্বরচিত গান সহ অন্যান্য গাওয়া গান অনেকই ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড দিয়েছে। অসম্ভব সুন্দর গায়কি রাজপথের নায়ক রাজিব কানার। বলে রাখি, এন টিভি’র একটা প্রতিবন্ধী প্রতিযোগিতায় ২০ জনের মধ্যে সে প্রথম হয়েছিল। তার নিজের জীবনকে নিয়ে অর্থাৎ তার স্বরচিত গান ছিল সেটি চমৎকার গেয়েছিল। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুন্নি সাহার ভালোবাসা ও সহযোগীতায় সেখানে গিয়েছিলো। আজো সেই সুর বিলিয়ে দেয় পথ-ঘাট-প্রান্তর, গ্রাম- গঞ্জ-শহর, হাটে-মাঠে-ঘাটে, জনতার ভিড়ে এবং সাংস্কৃতিক মঞ্চেও তার বিবরণ। স্বরচিত গান, দেহতত্ত্ব, মাইজভান্ডারী, বিচ্ছেদী গান এবং দেশ-বিদেশের আধুনিক ও হিন্দি গান অবিরাম ক্লান্তিহীন ভাবে গেয়ে চলে। দেহতত্ত্ব ও স্বরচিত গান গাইতে বেশ মজা পায়, মানুষও এসব গানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং গাইতে অনুরোধ করে। বেঁচে থাকার সংগ্রামে দিনে দিনে এমন গানের জগতে নাকি খোঁজে পায় সৃষ্টি কর্তার দেয়া আধ্যাত্মিক পরম সুখ।
রাজশাহী শহরের প্রাণ কেন্দ্র দক্ষিণের পদ্মার পাড় সেখানে অবস্থিত বড়-কুঠির, এই মনোরম পরিবেশে হঠাৎ করে রাজিব কানার সঙ্গে গান গাওয়ার এক ফাঁকে কথা হয়। রুটি-রুজির ভরসায় বেশ কয়েকদিন ধরে ‘পথের গায়ক’ কলসি বাদক এখানে আসে। মুগ্ধ হয়ে শ্রোতারা সাধ্যানুযায়ী টাকা-পয়সা দেয়, সে তৎক্ষণাৎ খুশি হয়ে আবারও চমৎকার গান ধরে। সে বলে, সারাদিন, সারামাস, সারাবছরই আমাকে রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলায় গান করতে হয়। আমি শুধুই রাজশাহীর গাযক নই, বিভিন্ন থানায়, গ্রামঅঞ্চলে গান গাওয়ার জন্য দুর-দুর্দান্তে চলে যাই। ঘুরে বেড়াই দিবানিশি সংসার চালানোর নেশায়। যুগ-যুগান্তর হয়তো মানুষ আমাকে মনে রাখবে না কিন্তু আমার তো অধিকার আছে, যে ক’দিন বাঁচি, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে দুবেলা খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার। রাজীব কানাকানাকে জিজ্ঞাসাবাদের এক মুহূর্তে জানা গেলো পরিবারের আদ্যোপান্ত।
রাজশাহী জেলার তানোর থানা সদরের এক গ্রাম মোল্লাপাড়ায় মৃত বাবা মো: বাক্কার আলী মোল্লার অভাবে অনটনের সংসারে তার জন্ম। শিশু বয়সে বাবা পরপারে গমন করে। মা মোছা: বতি বিবি পেটে ভাতে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অন্যের বাড়িতে রান্না-বান্নার কাজ করেন। রাজিব কানার আরেক ভাই কৃষক মো: জাহিদুল মোল্লা তার পরিবার থেকে পৃথক হয়ে নিজের মতো সংসারে ব্যস্ত। বাবাকে হারানোর পর মাত্র ছয় সাত বছর বয়সেই গানকে পুঁজি করে পথে নামতে হয় তার। দিনে দিনে তিরিশোর্ধ এই রাজীব কানা যুবক হয়ে উঠে এবং বিয়ে করে। সহধর্মিণী মোছা: রুজিনা বেগম অন্যের বাড়িতে অন্যের কোন কাজ কর্ম পেলে করে। স্বামীর অর্থ উপার্জন স্বল্পতায় দুটি মেয়ে সন্তানকে তো বড় করতে হবে, বড় মেয়েটি মোছা: রাজিয়া খাতুন স্কুলে যায়, দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী আর শিশু মেয়েটি মোছা: রাফিয়া তো এখনো মায়ের কোলে। কষ্টের সংসারে গায়ক রাজিব কানা বলে, মেয়ে দুটিকে সুশিক্ষিত করে আলোকিত মানুষ করতে চাই। আমি জন্ম অন্ধ, তারা তো জগৎ সংসার দেখতে পায়। আরও কিছু দেখানো ইচ্ছে। আমার প্রশ্ন ছিল আরও কিছু কি? উত্তরে হাসতে হাসতে বলে যেমন তাদের জামাই অর্থাৎ বর। বাবা হিসেবে আশা তো করতে পারে। রাজিব কানা বলে, ‘অন্ধজনেরে দিও আলো’ এই মানবিক সত্য প্রবাদটি আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ তখনই হয়। যখন আমাকে ভালোবেসে জনগণ যে টাকা পয়সা দেয় সে টাকা পয়সা আমার মেয়েদের পরিচর্যার সন্তুষ্টি হয় এবং ভরন পোষণে পরিপূর্ণতা খুঁজে পাই। দু’বেলা না খেলেও চলে যায় কিন্তু মেয়েদের কষ্ট তার সহ্য হয়না। সে ভালোবাসার মানুষদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।
গান গাওযার শুরুর দিকে বাউল, বয়াতিদের রেকর্ডকৃত গানে শুনার নেশা ছিল এবং সেই ভাবে গাওয়ার ঢং অর্জনে ব্যস্ত ছিল। সেই থেকে আজ অবধি চলার পথে বাউল, বয়াতিদের গুরু মানে সে। তাছাড়া তাদের গান অহরহ গেয়ে বেড়ায় সর্বত্র। মানুষ তার কণ্ঠের সেই সময়ের সুরের কিছুটা প্রশংসা করেছিল বলেই টানা তিরিশ বছর গান গাওয়ার পেশা জেঁকে বসে। তিনি আরো বলে, সুরের সাধনা করে সুখ পাই। সুরের মধ্যে পরম করুণাময়ের আরাধনা করি। মানুষ মুগ্ধ হলে আনন্দ পেলে আমিও সুখ পাই। গান গাই, খাই-দাই, ঘুরি ফিরি। সুখানন্দ বিলানো ‘পথের গায়ক’ রাজীব কানা আনন্দের এক ফাঁকে উঁকি দেয় তার আক্ষেপ। তিনি বলেন, বয়স হচ্ছে তো দিনে দিনে, তীক্ষ্ণ অর্ন্তদৃষ্টি আর কন্ঠে সুর ক্ষীণ হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ভাতা আজও মিললনা। অতি প্রাকৃতিক এক বিপুল আবেগে তার কন্ঠ ভারি হয়ে ছুঁয়ে যায় আকাশে বাতাসে। নজরুল ইসলাম তোফা সেই টানেই যেন মণ্ত্রমুগ্ধের মত তাকে ভালোবেসে দু’কলম লেখার জগতে প্রবেশ করেছে।
গান নিয়ে তার যে পরিকল্পনা, মনের ইচ্ছা অপূর্ণই থাকে নিজ উপার্জন কম বলে। তার চাওয়া একটা উন্নত সাউন্ড সিস্টেম যন্ত্র। সেই যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে সব ধরনের গান পরিবেশন করে শ্রোতা, দর্শকদের মন জয় করবে। তাছাড়া কোন সুহৃদ ব্যক্তির সান্নিধ্য পেলে তার স্বরচিত গান রেকর্ড করে আজীবন এদেশে মানুষকে শুনাতে আশা পোষণ করেন এবং সঙ্গীত শিল্পী হওয়ার বাসনায় সদাসর্বদা স্বরচিত গান রচনা করে।