বৃহস্পতিবার ● ১১ মে ২০১৭
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » পানির কোন সরকার নেই, দলীয় পরিচয় নেই
পানির কোন সরকার নেই, দলীয় পরিচয় নেই
শরণখোলা প্রতিনিধি :: (২৮ বৈশাখ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৯.৫৫মি.) পানি ব্যবস্থাপনায় রাজনীতিকরণের কারনে প্রকৃত অসহায় মানুষরা সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। পানির কোন সরকার নেই, দলীয় পরিচয় নেই। ভোটের অধিকার ধনী-গরীব সবার যেমন অধিকার, পানিতে তেমনি সমান অধিকার। সব মানুষের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে হবে। মূলধারাকে কম গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পরা প্রকৃত দু:স্থ মানুষদের সহায়তা করতে হবে। এনজিওগুলোর কার্যক্রমে ওভারল্যাপিং আছে, সমন্নয় ও মনিটরিং নেই । চাহিদা নিরুপনের ক্ষেত্রে নাগরিকদের অংশগ্রহন নামেমাত্র। কমিউনিটির কার্যকর অংশগ্রহন, মনিটরিং ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় না আনা গেলে পানিক্ষেত্রে শুদ্ধাচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবেনা । এমনটাই জানিয়েছেন বাগেরহাটের শরণখোলায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষন বিষয়ক এক আলোচনার বক্তারা। পানির ন্যয্যতা আদায়ে তরুণরা সংঘবদ্ধ হয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে পারে বলেও তারা মতামত ব্যক্ত করেছেন। শরণখোলায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের মাধ্যমে মূল্যবান সুপেয় পানি নিশ্চিতকরণ প্রকল্প পরিচিতি সভায় পানি খাতে এ রকম নানা বঞ্চনা ও অসঙ্গতির কথা উঠে আসে স্থানীয় মানুষদের আলোচনায়। বাংলাদেশ ওয়াটার পার্টনারশিপ ও গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপ সহযোগিতায় সোস্যাল ইকোনোমিক ডেভলপমেন্ট সোসাইটি এই প্রকল্প পরিচিতি সভার আয়োজন করে । ১০ মে বুধবার রায়েন্দা বাজার এলাকায় উদয়ন বাংলাদেশ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ সভায় শরণখোলা উপজেলা এনজিও সমন্বয় কমিটির সভাপতি মীর সরোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রকল্পটির পারিচালক এবং আর্ন্তজাতিক যুব পানি ও জলবায়ু অ্যাওর্য়াড বিজয়ী সোহানুর রহমান। সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন উদয়ন বাংলাদেশের সমন্নয়ক শফিকুল ইসলাম (মিলন)। যুবসংগঠক সুলতানা মুন্নির সঞ্চালনায় শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নান শ্রেনির নাগরিক প্রতিনিধিরা সংলাপ পর্বে অংশ নেন।
মূলত দুর্বল পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার কারণে বৃহত্তর খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে বক্তারা চিহ্নিত করেন। জলবায়ু পরিবর্তনসহ ফারাক্কার বাঁধ, বাঁধ কেটে লবণ পানি প্রবেশ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, নদী প্রবাহে বাঁধা, নদী-খাল দখলসহ নানাবিধ কারণে যুগ যুগ ধরে সুপেয় পানির এ সংকট অব্যাহত রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খাবার পানি সংকটের জন্য লবণাক্ততাকে দায়ী করে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠর উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ও নদীতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এরপর অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষে পুকুর ও অন্যান্য জলাধানগুলো লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট বেড়েছে। পুকুর-খাল ও নদী, উন্মুক্ত জলাশয়সহ পানির প্রধান উৎস্য প্রভাবশালীদের দখল ও ভরাটের কারণে– দিনদিন বাড়ছে খাবার পানির এ সংকট। সরকারি-বেসরকারিভাবে পানি সংকট সমাধানের উদ্যোগের কথা বলা হলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। পানি খাতে সঠিক পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। ফলে এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তার সুফল পাচ্ছে না ভুক্তভোগী জনগণ। উপকুলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানি সমস্যার জন্য সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও শহরমুখী পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক আন্দোলনের নেতারা। তাই সংকট মোকাবিলায় নাগরিক ও যুব অংশগ্রন বৃদ্ধিসহ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরো বেশি কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। উপকূলীয় এলাকার মানুষের নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করার দাবি তাদের।
উপস্থাপিত তথ্যপত্রে সোহানুর রহমান বলেন, খুলনাসহ দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলীয় মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংগে লড়াই নিরন্তর। সিডর, আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী ঘুর্নিঝড়, জ্বলোচ্ছাস এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। নানা সংকটের মধ্য পানীয় জলের অভাবই প্রধান। বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবনে ঢোকা লোনা পানির প্রভাব কাটানোর জন্য নদ-নদীতে যে পরিমাণ মিঠা পানির প্রভাব থাকা দরকার, তা বছরের মে থেকে নভেম্বর পযর্ন্ত না থাকায় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছেই। নদীগুলো খরস্রোতা না হওয়ায় কমে গেছে মিঠা পানির প্রবাহ। যার কুপ্রভাব পড়ছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে। শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের পূর্বপান্ত শরণখোলা থেকে পশ্চিমপ্রান্ত শ্যামনগর প্রযন্ত ১৬ উপজেলার ৫০ লাখ মানুষ ভুগছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে। বিশেষকরে বাগেরহাটের উপকূলীয় উপজেলা শরণখোলা, মংলা, চিতলমারী; খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা; সাতক্ষীরার শ্যামনগরে এ সংকট ভয়াবহ। এছাড়াও, খুলনার ডুমুড়িয়া, কয়রা, বটিয়াঘাটা; সাতক্ষীরার আশাশুনি, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, তালা; এবং বাগেরহাট সদর, রামপাল ও মোড়েলগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের অধিবাসীরা এখনো বিশুদ্ধ পানি বঞ্চিত।
আলোচনায় যুব প্রতিনিধিরা জানান, যদিও উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাব দীর্ঘকালের। এছাড়া ২০০৭ সালে ‘সিডর’ এবং ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’য় উপকূলের সুপেয় পানির উৎসগুলো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির বিষয়টি মহাসংকটে রূপ নেয়। এখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলীয় নদ-নদীতে লবনাক্ততার পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে উপকূলের জীবন-জীবিকা চরম সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এক কলস সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটতে হয় বাসিন্দাদের। একথা অনস্বীকার্য, এ দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় প্রতিকূল পরিসিস্থিতে পরিবারের সবার জন্য খাবার তৈরি ও পানির ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নারীদের কাঁধেই বর্তায়। তাই গ্রামীন নারী ও কন্যাশিশুদের কমপক্ষে দুই কিলোমিটার হেঁটে পানীয় জল সংগ্রহ করছেন বলে জানা গেছে। অনেকক্ষেত্রে সুপেয় পানির অভাবে বাধ্য হয়ে তাদের লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও শিশুবিবাহ। বিশুদ্ধ পানির অভাবের কারনে গর্ভাবস্থায় মায়েরা লবণাক্ত পানি পান করছেন, যা শিশুস্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। লবনাক্ততায় আক্রান্ত এলাকায় সন্তানসম্ভবা মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রি-একলেম্পশিয়া রোগ দেখা দেয়ায় মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হারও বাড়ছে। শিশুদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে পেটের পীড়া ও চর্মরোগ।
নারীনেত্রী নাসরীন সুলতানা বলেন, পানি সংগ্রহের মূলকাজটা তাদের কাঁধে বর্তালেও নারীরা পানির কম ব্যবহারের সুযোগ পায়। সরকারি-বেসরকারি সুবিধা পায় নেতা ও তাদেও আত্মীয়রা। গরীব অসহায় পিছিয়ে পরা মানুষদের সংযুক্ত করতে হবে । পুকুর খনন প্রকল্পে সঠিকভাবে পুকুর কাটা হয়না। পার থেকে কাটা হয় । গভীরতা বাড়ায় না। এর নাম পুকুর চুরি। এসব বন্ধ সহ খাল খনন ও উদ্ধার করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে । ১০ বড়ি পরপর ৫০০ লিটার বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের ট্যাংক এবং ২০টি বাড়ি পর পর এক একটি পিএসএফ নির্মান করার ব্যপারে তিনি সুপারিশ করেন।
কিশোরী সাথী আক্তার বলেন, আমাদের উপযুক্ত পুকুরের সংকট রয়েছে। পুকুরের পারে লাগানো গাছের পাতা পরে পানি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নলক’পের পানিতে লবণের পাশাপাশি রয়েছে আর্সেনিক ও আয়রণ, লবণ পানি। খাল, পুকুর ভরাট ও দখলের কারনে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। পানি দূষন ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহনসহ পিএসএফ ও পানির ট্যাংক বিতরনে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। এসব কার্যক্রমে প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা প্রভাব খাটায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
যুব সংগঠক সুলতানা মুন্নি বলেন , অনেক জায়গায় পুকুরে পিএসএফ থাকলেও অকার্যকর হয়ে পরে আছে। সরকার বলছে কমিউনিটি পিএসএফ মেরামত করবে। টিউবয়েরগুলোতে সচল রাখতে ২ জন মেকানিক্স (সরকার এনজিও) দরকার। নাগরিক কমিটির মাধ্যমে এগুলোকে সংরক্ষন ও মেরামত করার পরামর্শ দেন তিনি । নিজেদের পিএসএফ নিজেরাই যেন সংরক্ষণ কওে সে বিষয়ে তিনি যুব সমাজকে আহ্বান জানান। উন্নয়ন সংগঠন উদয়ন বাংলাদেশের সমন্নয়ক শফিকুল ইসলাম (মিলন) বলেন, এলাকার মিষ্টি পানির পুকুরগুলো সংস্কার করে সেই পুকুর যাতে কোনোভাবেই নোনা পানিতে প্লাবিত না হয় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণসহ সুপেয় পানির বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে। শরণখোলার মানুষের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা খুবই দরকার দরকার । বছরের সবসময়ে পানি ধরা যায়না। মুষলধারে বৃষ্টির সময় পানি ধরতে হবে । বৃষ্টির পানিতে পোকা আসে যদি পরিচ্ছনতা না থাকে। তাই বৃষ্টির পানি সংরক্ষনে পরিস্কার পরিচ্ছনতার উপর গুরত্ব দিতে হবে। শরণখোলা উপজেলা এনজিও সমন্বয় কমিটির সভাপতি মীর সরোয়ার হোসেন বলেন, জণঅংশগ্রহনের মাধ্যমে স্থানীয় সম্পদেও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে। শরণখোলার মানুষও রিলিফ অরিয়েন্টেড হয়ে গেছে। পানি বিষয়ক অনেক প্রকল্পের টেন্ডার ক্ষমতাসীন দলীয় নেতারা পাওয়া সে সব প্রকল্পে রয়েছে দুর্নীতি। আর্সেনিক, আয়রণ, পিএসএফ’র পানি পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। পিএসএফ ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষনাগার মেরামতের জন্য আরো প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা উচিত। কি পরিমান পানি দরকার, কতজন মানুষের চাহিদ াএগুলো ঠিক করে বৃষ্টির পানি ধরার পরিকল্পনা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
সুপেয় পানির সংকট সমাধানে, ভরাট হওয়া সরকারি পুকুর ও খাল-নদী সংস্কার এবং পানির উৎসের লিজ বন্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি, গ্রামাঞ্চলভিত্তিক সমন্বিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি শরণখোলা উপকুলবাসীর।