শনিবার ● ১০ জুন ২০১৭
প্রথম পাতা » অপরাধ » অপহরণকারীদের কবল থেকে যেভাবে মুক্তি পেলেন সাংবাদিক নির্মল বড়ুয়া মিলন
অপহরণকারীদের কবল থেকে যেভাবে মুক্তি পেলেন সাংবাদিক নির্মল বড়ুয়া মিলন
ষ্টাফ রিপোর্টার :: (২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় ভোর ৫.০২মি.) অপহরণকারীদের শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মিদশায় দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা থাকার পর সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানাধীন সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের গভীর জঙ্গলে নিজেকে আবিষ্কার করেন সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম এর প্রধান সম্পাদক ও বাংলাদেশ অনলাইন নিউজ পোর্টাল এসোসিয়েশন বনপা’র সহ সভাপতি সাংবাদিক নির্মল বড়ুয়া মিলন।
৬ জুন মঙ্গলবার সকালে আনুমানিক ৯-সাড়ে ৯টায় নিজেকে আবিষ্কারের পর ভয় আর হতাশায় প্রথমে জঙ্গলেই চলে যান তিনি। কিছুদূর হেটে বিশাল এক লেবু বাগান দেখে খাগড়াছড়ির রামগড় মনে করে নিজেকে কিছুক্ষনের জন্য সৌভাগ্যবানও ভাবছিলেন তিনি। এরপর আরো একটু হেটে গিয়ে দেখেন দুজন আদিবাসী এবং একজন বাঙ্গালী লোক লেবু বস্তা নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কাছে গিয়ে নির্মল বড়ুয়া মিলন বুদ্ধি খাতিয়ে জানতে চান এ সড়কটি কোন দিকে গেছে ? তারা জানান এটি হবিগঞ্জ জেলা এবং এই সড়কটি সিলেট গেছে। শুনে হতবাক হয়ে যান। তিনি পরিবারের কাছে খবরটা দেওয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে একটি ফোন চাইলে বাঙ্গালী লোকটি বলেন ভাই, ফোন আছে তবে এই জঙ্গলে নেটওয়ার্ক নেই, সামনে দোকান আছে সেখানে ফোন পাবেন। পাশে একটি সাইনবোর্ড লক্ষ্য করেন, বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে “সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান”। তিনি দ্বিগিদিক দিশা না পেয়ে রাস্তার বিপরিত পাশে চলে যান এবং হাটা শুরু করেন। কিছুদূর যেতে একটি যাত্রী ছাউনির পাশে লেবু নিয়ে থাকা একজনকে দেখে তার মনে হলো লোকটা পূর্বের পরিচিত। লোকটি তাৎক্ষনিক তাকে দেখে এবং হতচকিত হয়ে বলেন স্যার আপনি এখানে! বেড়াতে এসেছেন নাকি ? তখনই তার মনে পরে লোকটি তার জুডো’র ছাত্র বিজিবি সদস্য রতিশ দেব বর্মন। যিনি রাঙামাটি বরকলের ২২ বিজিবি’তে কর্মরত এবং বর্তমানে ছুটিতে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে নিজ বাড়ীতে রয়েছেন। রতিশকে দেখে মনে হলো “স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা রতিশকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন” বলেন নির্মল বড়ুয়া মিলন। সময় জানতে চাইলে রতিশ জানায় সকাল সাড়ে ৯টা। এরপর রতিশ নাস্তা করিয়ে বাসায় নিয়ে যান এবং নির্মল বড়ুয়া মিলনের পরিবারের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেন। নির্মল বড়ুয়া মিলন পরিবারের সাথে কথা বলে জানতে পারেন যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তাকে কে বা কাহারা সাদা পোশাকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে গেছে। পরিবার জানতে পেরে রাতেই আইনের আশ্রয় নিয়ে রাঙামাটি কোতয়ালী থানায় সাধারন ডায়েরী লিপিবদ্ধ করেছেন।
তখন থেকে অপহৃত নির্মল বড়ুয়া মিলনকে অপহরনকারীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে রাঙামাটি পুলিশ প্রশাসন এবং অনলাইন গণমাধ্যম।
নির্মল বড়ুয়া মিলন হবিগঞ্জ জেলার চুনারীঘাট থানার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের পাশে একটি আদিবাসী গ্রামে আছে জেনে তার পরিবার রাঙামাটি পুলিশ প্রশাসনে তাৎক্ষনিক খবর দিলে পুলিশ হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাট থানার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এস কে আজমীরুজ্জামান সাথে সাথে ফোর্স নিয়ে পৌঁছেন সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের পাশের গ্রামে। সেখান থেকে নিয়ে সিপাহী রতিশ দেব বর্মন চুনারুঘাট থানায় অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এস কে আজমীরুজ্জামান এর নিকট নির্মল বড়ুয়া মিলনকে নিয়ম অনুযায়ী হস্তান্তর করেন।
এদিকে রাঙামাটি পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান সময় ক্ষেপন না করে তাৎক্ষনিক তার স্ত্রী জুঁই চাকমাকে রাঙামাটি কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুহাম্মদ রশীদের মাধ্যমে খবর দিয়ে নিয়ে গিয়ে গাড়ী ও পুলিশ ফোর্সসহ চুনারুঘাট থানা থেকে নির্মল বড়ুয়া মিলনকে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেন। ৬ জুন বেলা ৩টায় রাঙামাটি কোতয়ালী থানার এস আই লিমন বোসের নেতৃত্বে রওনা দিয়ে ৭ জুন রাত ১টার সময় চুনারুঘাট থানায় পৌছে আইনগত সকল প্রক্রিয়া শেষ করে চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এস কে আজমীরুজ্জামান অপহৃত নির্মল বড়ুয়া মিলনকে রাঙামাটি কোতয়ালী থানার এস আই লিমন বোস এবং নির্মল বড়ুয়া মিলনের স্ত্রী জুঁই চাকমার কাছে হস্তান্তর করেন। রাত ২টায় চুনারুঘাট থানা থেকে নির্মল বড়ুয়া মিলনকে নিয়ে আবার রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে পরের দিন দুপুর ১টায় রাঙামাটি পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পৌঁছে আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আবার বেলা আড়াইটার দিকে রাঙামাটি কোতয়ালী থানায় গিয়ে আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নিরাপদে সুস্থ শরীরে স্বপরিবারে বাসায় যান নির্মল বড়ুয়া মিলন।
নির্মল বড়ুয়া মিলন জানান, ৫ জুন সোমবার বিকাল ৪টায় এ্যাডভোকেট উথাইমং মারমা ফোনে জানান যে, ডা. রেনিন সুয়ে তালুকদার জামিন পেয়েছেন এবং সেদিন বিকেলে রাঙামাটি জেলা কারাগার থেকে মুক্ত হবে। ডা. রেনিন সুয়ে একবার দেখা করতে অনুরোধ করেছেন। খবর পেয়ে তনি বিকাল সাড়ে চারটায় ডা. রেনিন সুয়ে তালুকদারের সাথে দেখা করার কথা বলে বাড়ী থেকে নিজের মোটর সাইকেলযোগে কারাগারের উদ্দেশ্যে যান। কারাগারে গিয়ে দেখেন ডা. রেনিন সুয়ে তালুকদারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তসলিম এবং দিদার নামে দুজন লোক কার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। নির্মল বড়ুয়া মিলন জানতে পারেন ডা. রেনিন সুয়ে তালুকদারকে ঈফতারের পর ছাড়া হবে তাই তিনি অপেক্ষা করেন। সন্ধ্যা সাতটার পর ডা. রেনিন সুয়ে তালুকদার কারাগার থেকে বেরিয়ে এলে কুশল বিনিময় শেষে প্রায় দু’শ গজ দূরত্বে ডাক্তারের অপেক্ষায় থাকা কার গাড়ীতে তুলে দিয়ে চলে আসার সময় পিছন দিকে তাকিয়ে দেখেন যে, সাদা পোশাকের ১০-১২ জন কম বয়সী যুবক ডাক্তারকে অস্ত্র তাক করে ঘিরে ধরেছে। এ অবস্থা দেখে তিনি কাছে যান এবং গিয়ে দেখেন একটি সাদা মাইক্রো গাড়ীতে ডাক্তারকে টেনে হিছড়ে তুলছে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগে সাদা পোশাকধারীরা নির্মল বড়ুয়া মিলনকে মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে মাইক্রোতে তুলে ফেলেন এবং ডাক্তারকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেয় এবং দু’জনের চোখ মুখ ও হাত বেঁধে ফেলে। এ অবস্থার আগে তিনি লক্ষ্য করেন যে, আরো একটি কার ও একটি মাইক্রোসহ মোট তিনটি গাড়ী সেখানে ছিল। তাদের নিয়ে গাড়ীটি দ্রুত গতিতে কাপ্তাই রাঙামাটি সড়কের দিকে গেছে বলে নির্মল বড়ুয়া মিলন চোখ বাঁধা অবস্থায় অনুমান করেন। গাড়ীটি আনুমানিক ৩ ঘন্টা চলার পর একটি সুনসান এলাকায় গিয়ে থামে এবং নির্মল বড়ুয়া মিলন শুনতে পান কেউ বলছে আপনি ডাক্তার রেনিন সুয়ে ? ডাক্তার হ্যাঁ জবাব দেন। তৎক্ষনিক ডাক্তার তার পাশের সিট থেকে নেই। সেখানে গাড়ীটি দীর্ঘক্ষন সেখানে থাকার পর আবার চলতে শুরু করে। তখন থেকে ডাক্তার রেনিন সুয়ে তালুকদারের কোন শব্দ বা ছোঁয়া পাননি বলে জানান তিনি।
কিছুক্ষন পর গাড়ীতে জ্বালানী নেওয়ার জন্য থামে সেসময় নির্মল বড়ুয়া মিলনকে কোন একজনের কোলে শুতে বলা হয় এবং গায়ের উপর কয়েকটি ব্যাগ তুলে দিয়ে লোকচক্ষুর আড়াল করে তাকে কোন ধরনের শব্দ করতে নিষেধ করা হয়। জ্বালানী নিয়ে গাড়ীটি চলতে শুরু করে। গাড়ী চলতে চলতে অপহরণকারীদের কেউ একজন নির্মল বড়ুয়া মিলনকে জিজ্ঞেস করেন তুমি কি কর? তিনি জবাব দেন আমি সাংবাদিকতা করি। ও আচ্ছা আপনি সাংবাদিক বলে তুমি থেকে আপনি সম্বোধন করেন। ডাক্তার রেনিন সুয়ে তালুকদারের সাথে আপনার কিভাবে পরিচয় ? আত্মীয় ? নির্মল বড়ুয়া মিলন জবাব দেন- না ডাক্তার বাবু আমার কোন আত্মীয় নয়, আমি কয়েক মাস আগে তথ্য প্রযুক্তি আইনে ৫৭(২) ধারায় একটি হয়রানীমূলক একটি মামলায় ১৮ দিন কারাগারে থাকার সময় ডাক্তার বাবুর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তখন অপহরণকারীদের কোন একজনকে ফোনে বলতে শোনা যায় ইনোসেন্ট লোককে কেন তুলে আনা হয়েছে ?
গাড়ী এত বেপরোয়া গতিতে চলছিল প্রথম প্রথম অন্যান্য চালকদের গালাগালির আওয়াজও শোন গিয়েছিল বলে জানান নির্মল বড়ুয়া মিলন।
গাড়ী চলছিল দ্রুত গতিতে। তিনি অনুমান করেন যে, গাড়ী কোন মহাসড়কে চলছিল। গাড়ী দীর্ঘ সময় চলার পর গাড়ী থামে কোন এক স্থানে থামে দুয়েকজন পাহাড়াদার রেখে বাকীরা খাবার খেতে গেছে বলে অপহরণকারীদের কথাবার্তায় অনুমান করেন। কিছুক্ষণ পর আবার গাড়ী চলা শুরু হয়। ততক্ষনে নির্মল বড়ুয়া মিলনের প্রস্রাবের বেগ পেলে প্রস্রাবের অনুমতি নিলে অপহরণকারীরা একটি বোতল দিয়ে বোতলে প্রস্রাব করতে বলে। গাড়ীর ঝাকুনির কারণে প্রস্রাব আর হয়না। চলতে চলতে একসময় নির্মল বড়ুয়া মিলন ঘুমিয়ে পরেন। জেগে ওঠা মাত্র কেউ একজন বলে উঠলেন আপনার তো প্রস্রাব পেয়েছে তাছাড়া দীর্ঘক্ষন এক জায়গায় বসে রয়েছেন একটু হাটাহাটি করলে ভাল লাগবে। ডাক্তার রেনিন সুয়ে তালুকদারকে নিয়ে যারাই গেইম খেলতে চাইবে তাদের হাত পুড়ে যাবে, আপনাকে দিয়ে একটা টোপ দিলাম মাত্র। কিছুক্ষন পর গাড়ী থামিয়ে একজ বলেন, মাঠের মধ্যে একটু হাটাহাটি করেন প্রস্রাব করেন, আপনার ভাল লাগবে। তারপর দু’জন দুইপাশে এবং সামনে পিছনে দুজন ধরে নিয়ে নামিয়ে বেশ কিছু দূর নিয়ে গিয়ে হাটু গেরে বসতে বলে কেউ একজন প্যান্টের জিফার খুলে দিয়ে বলে ১০ মিনিট সময় দিলাম আমরা আসছি, চোখের বাঁধন খুলবেন না কোথাও যাবেন না বলে দ্রুত গতিতে তারা সেখান থেকে চলে যায়। তখনই তিনি গাড়ী নিয়ে চলে যাওয়ার শব্দ কানে আসে। কিছুক্ষন পর হাতের হালকা বাঁধন খুলে চোখের বাঁধন খুলে দেখেন গভীর জঙ্গলে সূর্যের প্রখর আলো। অপহরণকারীদের কথামত প্রাকৃতিক কাজ সারতে দশ মিনিটের সীমাবদ্ধ সময় শেষে তিনি চোখে বাঁধা কাপড় খুলে তিনি নিজেকে গভীর জঙ্গলে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরেন।