মঙ্গলবার ● ২০ জুন ২০১৭
প্রথম পাতা » ঢাকা বিভাগ » জঙ্গি অভিযানের গুমর ফাঁস
জঙ্গি অভিযানের গুমর ফাঁস
সিরাজী এম আর মোস্তাক::সম্প্রতি নরসিংদী জেলায় একটি মেসবাড়িতে জঙ্গি অভিযানে সব গুমর ফাঁস হয়। এলাকাজুড়ে পরিচিত উচ্চশিক্ষিত কয়েক ছাত্র টিউশনি বা কোচিংয়ের জন্য বাড়িটি ভাড়া নেয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখানেই পাঁচজন নিরীহ ছাত্রকে জঙ্গি হিসেবে দীর্ঘ ২২ ঘন্টা ঘিরে রাখা হয়। একজন ঢাকা ভার্সিটির, ৩জন নরসিংদী সরকারী কলেজের মাষ্টার্সের ছাত্র এবং আরেকজন সেখানে প্রাইভেট পড়তে আসা দশম শ্রেণীর ছাত্র বলে জানা যায়। তাদের ঘিরে রাখার খবরে হাজার হাজার নারী-পুরুষ জড়ো হয়। বাইরে কান্নার রোল পড়ে যায়। ১৪৪ ধারা জারি হয়। মিডিয়াকে সংবাদ সংগ্রহে বাধা দেয়া হয়। অবরূদ্ধরা বিভিন্নভাবে নিজেদের নির্দোষের প্রমাণ দেখায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য প্রার্থনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। সে সুত্র ধরে ৭১টিভিতে বিশেষ রিপোর্ট প্রচার হয়। এতে দেশজুড়ে চরম উৎকন্ঠা ছড়ায়। সবাই অপেক্ষা করতে থাকে, শীঘ্রই নিরীহ পাঁচ ছাত্র প্রাণ হারাবে নিছক জঙ্গি তকমায়। এতে প্রশাসন তাদের বের করে এনে আত্মসমর্পন করেছে বলে জানায়। রাতেই তিনজনকে ছেড়ে দেয় এবং দুজনকে মামলায় জড়ায়। জনমনে একটু স্বস্তি হয়। সবাই ৭১টিভিকে ধন্যবাদ জানায়। রিপোর্টটি প্রচার না হলে অন্যান্য অভিযানের মতো নিরীহ পাঁচ ছাত্রেরও নির্মম পরিণাম হতো বলে সবাই ধরে নেয়।
বিষয়টি জনমনে নাড়া দেয়। কিছু উৎসুক গবেষক নাটকীয় জঙ্গি অভিযানের রহস্য উদঘাটনে গবেষণা চালায়। তারা গুলশান হলি আর্টিজান হামলাতেও নরসিংদীর অভিযানের মিল খুঁজে পায় এবং সাজানো নাটক বলে অভিমত দেয়। সেদিনও মাত্র ছয়-সাত জঙ্গি কর্তৃক দুই পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাসহ চল্লিশজন পুলিশ আহত হয়। জঙ্গিরা কিছু বন্দীকে অবিশ্বাস্যভাবে ছেড়েও দেয়। তারপর হোটেলে অবস্থানরত বাইশজন নিরীহ ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং হোটেলের রক্তাক্ত মেঝেতে সারারাত নিরবে কাটিয়ে দেয়। পরদিন সকালে অপারেশন থান্ডারবোল্ট শুরু হলে, প্রতিরোধ করে এবং নিহত হয়। এ অবাস্তব ঘটনা, পাগলের কাছেও অস্পষ্ট নয়। অথচ দেশের গৃহপালিত বিরোধীদল ও সকল রাজনৈতিক দল কথিত জঙ্গিদের বিরূদ্ধে অভিযানে সোচ্চার হয়। তখন থেকেই দেশে নাটকীয় জঙ্গি অভিযান শুরু হয়। জঙ্গি অভিযানে বাড়ি-বাড়ি ঘেরাও হয় এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত হয়।
এখন দেশের কেউ নিরাপদ নয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও নয়। বিনা নোটিশে তাঁর গুলশান কার্যালয়েও অভিযান চালানো হয়। এভাবে কখন কার বাড়িতে জঙ্গি অভিযান চলে, তা স্পষ্ট নয়। কার কপালে জঙ্গি তকমা জোটে, তাও কেউ অবগত নয়। নরসিংদীর ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়। সিলেটের জঙ্গি অভিযানও হুবহু মিলে যায়। সেখানে চার-পাঁচ মাইল জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি ও সংবাদকর্মীদের প্রতি বাধা সত্ত্বেও কিভাবে পুলিশ কর্মকর্তা নিহত ও র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান আহত হয়, তা কারো বোধগম্য নয়। তারপর আহত সেনা কর্মকর্তাকে ঘটা করে সিঙ্গাপুরে নেয়া, মুমূর্ষু সত্ত্বেও দেশে ফিরে আনা এবং দুইদিনের মধ্যে দাফন করা; সবই রহস্যজনক মনে হয়। দেশে প্রকৃত বিরোধীদল নেই, বিধায় সিঙ্গাপুরের মতো সভ্য দেশ একজন মুমূর্ষু রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে সহজে পার পেয়ে যায়। আর আমাদের দক্ষ সেনাবাহিনীও এ সিঙ্গাপুরী বাঁশ মেনে নেয়।
নরসিংদীর ঘটনায় প্রতীয়মান হয়, জঙ্গি অভিযানে নিরীহ নাগরিকগণ হত্যার শিকার হয়। জনমনে চরম ও বাধ্যগত আনুগত্য সৃষ্টি হয়। এ অভিযান চলছে, দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায়। এ খবর কমই মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। কিছুদিন আগে ঢাকার ধানমন্ডিতে সরকারী অবসর ভবনে রাত বারোটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত যৌথ অভিযান চলে, অথচ মিডিয়ার কেউ তা অবগত নয়। তেমনি পত্রিকাতে প্রায়ই পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে হত্যার খবর দেখা যায়। তাতে পুলিশের কাছে আটক ব্যক্তিরাই শুধু নিহত হয়। যেমন, দশদিনের রিমান্ডে থাকা জঙ্গি ফাহিম পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে হাতকড়া অবস্থায়। নরসিংদীর ঘটনার পর উৎসুক গবেষকদের মাধ্যমে জঙ্গি অভিযানের আরো গুমর বের হয়। অতএব, জঙ্গি অভিযানের নামে বিচাবহির্ভূত হত্যাকান্ড আর নয়।
শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা।