রবিবার ● ২৫ জুন ২০১৭
প্রথম পাতা » জনদুর্ভোগ » সিলেট এখন যানজট’র নগরী
সিলেট এখন যানজট’র নগরী
সিলেট প্রতিনিধি :: (১১আষাঢ় ১৪২৪ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় রাত ১০.৩৪মি.) সিলেট এখন যানজট’র নগরীতে পরিনত হয়েছে। যানযট কত প্রকার ও কি কি তা সিলেট নগরী ও তার আশেপাশের রাস্তায় বের হলে টের পাওয়া যায়। কিন্তু কেন এই যানযট আর হঠাৎ কি এমন হল যে যানজট লেগে আছে ঘন্টার পর ঘন্টা। যানজট নিরসনে নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ। যানজট কমার কোন লক্ষন পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।
তবুও স্বস্তির মধ্যেই আছে সিলেটের মানুষ। রাস্তায় নেই ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। ডাকাতিও কমে এসেছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অনেকটা ভালো। সড়কপথেও বড় কোনো দুর্ঘটনা নেই। লোডশেডিংয়ের উৎপাতও অন্যান্য বারের চেয়ে কম। এত সব ভালো’র মধ্যে হঠাৎ এই তীব্র যানজট কিছুটা হলেও অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে সিলেটবাসীকে।
২৫ জুন রবিবার বেলা দুইটায় বাজারের থলে হাতে নিয়ে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে নগরের বন্দরবাজার এলাকার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন আরাফাত হোসেন। নগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা তিনি। তীব্র যানজট তার উপর রিক্সার ডাইভারদের দৌড়াত্ব্য। কোন ডাইভারই উপশহর যাবেনা। আর যদিওবা কোন ডাইভার রাজি হচ্ছে তারা দ্বিগুন ভাড়া দাবি করছে। প্রায় এক ঘণ্টা ছিলেন। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে হেঁটেই বাসার দিকে রওনা দিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেট নগরের বন্দরবাজার এলাকা ছাড়াও গতকাল নগরের অধিকাংশ এলাকায় ছিল অসহনীয় যানজট। জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, লামাবাজার, মির্জাজাঙ্গাল, জামতলা, তালতলা, সুরমা মার্কেট, বারুতখানা, নয়াসড়ক, জেলরোড, নাইওরপুল, মীরাবাজার, শিবগঞ্জ, টিলাগড়, লালদিঘিরপাড়, কালীঘাট, কাজিরবাজার, ছড়ারপাড়, কাজলশাহ, সোবহানীঘাট—সব এলাকাই ছিল স্থবিরপ্রায়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এসব এলাকায় তীব্র যানজট ছিল।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, রমজান মাসের অন্তিম সময় গভীর রাত পর্যন্তও এখন এসব এলাকায় দুর্বিষহ যানজট থাকে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রমজান শুরু হওয়ার পর থেকে যানজট সামান্য থাকলেও সময় বাড়ার সাথে সাথে যানজট অসহনীয় রূপ ধারন করেছে। যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি আটকে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কোনো দিকেই গাড়ি যেতে পারে না। কাজেই পায়ের ওপর ভরসা করেই অনেকে চলতে শুরু করেন। তাই ফুটপাতেও মানুষে ঠাসাঠাসি। পুরো শহরটাই যেন অচল হয়ে আছে।
রায়নগর এলাকার বাসিন্দা সালমান আহমদ সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমার বাসা থেকে উপশহর এলাকায় রিকশায় আসতে বড়জোর ১৫ মিনিট লাগার কথা। অথচ আজ ২৫ জুন রবিবার ওই দূরত্বে আমাকে আসতে হয়েছে এক ঘণ্টায়। ফলে সময় মেনে গন্তব্যে পৌঁছাটা এখন সম্ভব হচ্ছে না।’
শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রুহেল সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, ‘এমনিতেই নগরজুড়ে তীব্র যানজট। এর মধ্যে কখনো বৃষ্টি হচ্ছে, কখনো রোদ উঠছে। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিকশায় বসে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে পড়ছি।’
মহানগর পুলিশের ট্রাফিক শাখা সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানিয়েছে, বেশ কয়েকটি কারণে নগরে যানজট হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঈদের মৌসুম হওয়ায় প্রতিদিন কেনাকাটা করতে অসংখ্য মানুষ বাইরে বের হচ্ছে, অধিকাংশ সড়কে শুরু হওয়া সংস্কারকাজ, অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট এবং নগরের অধিকাংশ বিপণিবিতান ও হাসপাতালে পার্কিং ব্যবস্থা না থাকা।
তবে নগরবাসীর অভিযোগ, ঈদ সামনে রেখে নগরের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লায় অবৈধ রিকশার পাশাপাশি নিষিদ্ধঘোষিত ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করাই যানজটের প্রধান কারণ।
সেই সকাল থেকে যানজট থাকার কারণে ঈদে কেনাকাটা করতে আসা মানুষকে পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। শুক্রবার রাত থেকে সিলেটের ঈদবাজারে শুধু নগরেই মানুষ নয়- ছুটে আসছেন গ্রামের মানুষ। শেষ মুহূর্তের কাপড় কিনতে সবাই ভিড় করছেন নগরীতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য অনেকেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে ফিরতে না পেরে রাস্তায়ই সারতে হয়েছে ইফতার। আর এবারের এই যানজটে সিলেটবাসীর কপালে ফেলেছে চিন্তার ভাঁজ।
৭-৮ বছরের মধ্যে সিলেটে এমন যানজট পরিলক্ষিত হয়নি। সিলেটের রাস্তাঘাট এখন আর আগের মতো গলিপথ নেই। শহরের ভেতরের বড় রাস্তা সবক’টি ফোর লেনের। বাকি সব রাস্তা প্রায় দুই লেনের। এ রাস্তায় সন্তুষ্ট ছিলেন সিলেটবাসী। কিন্তু এখন এই রাস্তায়ই এখন সংকুলান হচ্ছে না। তীব্র যানজটে নাকাল সিলেট। কেন এই সমস্যা দেখা দিল- এর কোন সদুত্তর সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও দিতে পারেননি। শুধু বললেন, নগরের বন্দরবাজার, সুরমা মার্কেট, ডাকঘর রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করার ফলে যানজটের কবলে পড়া মানুষ অন্তত এবার ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারছে। তবে নগরের ব্যস্ততম এলাকার অসংখ্য বিপণিবিতানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় এই ঈদের মৌসুমে যানজট তীব্র রূপ নিয়েছে। তবে রাস্তায় যেন যত্রতত্র কেউ গাড়ি পার্ক করে রাখতে না পারে, সেটি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ নজরদারিতে রাখছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, রমজান শুরু হওয়ার পর পাশের জেলা ও উপজেলা থেকে প্রচুরসংখ্যক মানুষ বিভাগীয় শহর সিলেটে ঈদের কেনাকাটা করতে আসছে। নগরে মানুষের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূলত যানজট দেখা দিচ্ছে। তবে নগরের অধিকাংশ বিপণিবিতান ও হাসপাতালে পার্কিং সুবিধা না থাকায় মানুষজন রাস্তার মধ্যেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখছে, এতেও যানজট দেখা দিচ্ছে।
সিসিক সূত্র জানাযায় , সিলেটের যানজটের অন্যতম কারণ ছিল ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে ব্যবসা করা। সেটি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রমজানের প্রথমার্ধ্বেই করা হয়েছে। কিন্তু ২০শে রমজানের পর থেকে তারা ফের বসতে শুরু করেছেন। বর্তমানে ঈদবাজারে সব একাকার হয়ে গেছে।
হকার নেতারা জানিয়েছেন- তারা ফুটপাতে বসে ব্যবসা করছেন। রাস্তায় বসে করছেন না। রাস্তায় অটোরিকশা স্ট্যান্ডসহ কয়েকটি স্ট্যান্ড করা হয়েছে। রাস্তায় স্ট্যান্ড থাকলে যানজট কমবে না বলে তারা জানান। সিলেট নগরীর রাস্তায় প্রায় সব যানবাহনের অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকা আগে ছিল রাজনীতিবিদদের দখলে।
কিন্তু যানজটের কথা বিবেচনা করে আর কোর্ট পয়েন্টে সভা-সমাবেশ হয় না। তার বদলে কোর্ট পয়েন্ট দখলে নিয়েছে অবৈধ স্ট্যান্ড। প্রথমে সেখানে সিএনজি অটোরিকশার স্ট্যান্ড, পরে ধীরে ধীরে লেগুনা স্ট্যান্ডও গড়ে তোলা হয়েছে। এই অবৈধ স্ট্যান্ডের কারণে শত চেষ্টা করেও ট্রাফিক পুলিশ ওই এলাকার যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। একই সঙ্গে নগরীর মধুবন মার্কেট, করিমউল্লাহ মার্কেট, কারাগারের সামন, ধোপাদিঘীরপাড়, সুবহানীঘাট, চৌহাট্রা, দরগাহ গেট, রিকাবীবাজার, শেখঘাট, আম্বরখানা, মেডিকেল রোড, শাহী ঈদগাহ, শিবগঞ্জ, উপশহর এলাকায় স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে।
এসব স্ট্যান্ডের সিসিকের কোনো অনুমতি নেই। বলতে গেলে কেবল গায়ের জোরেই পরিবহন শ্রমিকরা এসব স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছেন। অ্যাকশনে গেলেই তারা ধর্মঘটের ডাক দেয়। ফলে প্রশাসন তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় এবারের ঈদের আগের তীব্র যানজটে নাকাল গোটা সিলেট। শুক্রবার সন্ধ্যা রাত থেকে গোটা নগরী যেন যানজটে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্বীন ব্রিজ থেকে আম্বরখানা, তালতলা, লামাবাজার থেকে টিলাগড় পয়েন্ট পর্যন্ত গোটা এলাকায় তীব্র যানজট দেখা দেয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার জেদান আল মুছা সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন- এবার সবকিছুই ঠিক ছিল। গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার সিলেটের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। ছিনতাই ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু যানজট পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি ছিল। এ কারণে সব এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশকেও ট্রাফিকের অতিরিক্ত দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, আশা করি আজ থেকে সিলেটের যানজট অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।