শুক্রবার ● ৩০ জুন ২০১৭
প্রথম পাতা » অর্থ-বাণিজ্য » খেজুর পাতার ঝুল ঝাঁড়ু শিল্পের কারিগরদের সুখ-দু’খের কথা
খেজুর পাতার ঝুল ঝাঁড়ু শিল্পের কারিগরদের সুখ-দু’খের কথা
ময়মনসিংহ অফিস :: (১৬ আষাঢ় ১৪২৪ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২.৪৭ মি.) ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বালিপাড়া ইউনিয়নের বিয়ারা দক্ষিনপাড়া গ্রামের ১৫টি পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষনসহ লেখাপড়া আর সংসারের খরচ চলে খেজুর পাতার ঝুল ঝাড়ু বিক্রি করে। প্রতিদিন এখানে তৈরী হচ্ছে প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার ঝুল ঝাড়ু–। আর তাদের তৈরী ঝাড়ু ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
ব্রহ্মপুত্র নদের কূল ঘেষে গড়ে উঠা ওই গ্রামের ১৫ টি পরিবার হস্ত ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে কোন রকম যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই খালি হাতে কাজ করে সৃজনশীলতা ও নিপুণতার পরিচয় তুলে ধরার পাশাপশি নিজেদের সংসার সেই সাথে সন্তানদের সামান্য লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছেন।
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় নানা রকম শিল্পের মাঝে ছোট্ট ওই গ্রামের ১৫টি পরিবার এই হস্ত শিল্পটি আঁকড়ে ধরে আছেন উপার্জনের উৎস হিসেবে। গ্রামের ছোট,বড়, বৃদ্ধ সব বয়সের নারী, পুরুষ, শিশু মিলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান ঝাড়– তৈরির কাজে। নতুনরা ছাড়াও ওই পরিবারগুলোর মধ্যে কেউ কেউ পূর্বপুরুষদের এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে তাদের জীবন সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে আবার যোগালী হিসেবে ২শ’ ৫০টাকা থেকে ৩শ’ টাকা মজুরিতে নিয়ে কামলার কাজ মনে করে এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
খেজুর পাতা, বাঁশ, বেত, লতা অথবা প্লাস্টিক ফিতা, পিন-তারকাটা, সুতলি এসব ঝুল ঝাড়ু তৈরীর প্রধান উপকরণ। আগে খেজুর গাছ পরিস্কার করে দিলেই বিনিময়ে খেজুর পাতার ডাল পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আড়াই টাকা মূল্যে প্রতি পিছ ডাল ক্রয় করতে হয়।
প্রথমে খেজুর পাতা শুকিয়ে গজাল বা সলা দিয়ে চিকন চিকন করা হয়। তার পর বাঁশ কিনে এনে দা দিয়ে ছেটে রোদে শুকিয়ে বানানো হয় হাতল। চিকন চিকন করা খেজুর পাতা হাতলের চারপাশে প্লাস্টিকের ফিতা ও সুতলি দিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি করা হয় খেজুর পাতার ঝুল ঝাঁড়ু। পরিবহন খরচ ও উপকরনসহ প্রতিটি ঝাড়– তৈরির ব্যয় পড়ে গড়ে ৫ টাকা। এসব ঝাড়–– এক টাকা লাভে পাইকারি দরে বিক্রি করতে হয় ৬টাকায়। এ অঞ্চলে দুই ধরনের ছোট হাতলের এবং বড় হাতলের দৈনিক ৩ থেকে ৪ হাজার ঝুল ঝাড়ু তৈরি হয়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিয়ারা জয়মনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আসমা খাতুন নিজে তার মা সুফিয়া খাতুনকে ঝাড়ু তৈরির কাজে সহযোগিতা করছে। পড়াশুনার ফাঁকে অবসর সময়ে বাবা-মাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ৫ভাইয়ের একমাত্র বোন আসমা। আসমার সাথে কথা বলে জানা যায়, স্কুল বন্ধ থাকলে বা অবসর সময় পেলেই ঝাড়– তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটায় সে। সারাদিন কাজ করলে ৪শ’ থেকে ৫শ’ পিছ ঝাড়ুর ফিতা বাঁধতে পারে। আসমা আরো জানায়, টানাটানির সংসারে ঝাড়– তৈরিসহ সব কাজে বাবা-মাকে সহযোগিতা করতে তার খুব ভাল লাগে।
আসমা’র বাবা আফাজ উদ্দিন সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানান, লেখাপড়া করি নাই, বাপ-দাদার কাছ থেকে ঝাড়– তৈরীর কাজ শিখে ছোটকাল থেকেই এ পেশার সাথে জড়িত হয়েছি। ঝাড়–র ব্যবসা দিয়েই সংসার চালাই। মেয়েটা পড়াশুনা করলেও অবসর সময়ে আমাকে সাহায্য করে। আমার ছেলেরাও একই কাজ করে। কাঁচামালের দাম বেশি থাকায় শ্রমিকের মজুরি দিয়ে লাভের অংশ খুব কম থাকে।
ঝাড়– তৈরীর কারিগর হবিকুল ইসলাম জানান, বাপ-দাদার আমল থেকেই এ কাজ শিখেছি, বর্তমানে ঝাড়– তৈরিই আমার একমাত্র পেশা। এ ব্যবসা করে এখন সংসার ও চার মেয়ের লেখাপড়ার খরচ ব্যয় করেও আল্লাহর রহমতে কিছু আয় থাকে। নিজে লেখা পড়া করতে পারি নাই কিন্তু মেয়েদেরকে লেখা পড়া করিয়ে মানুষ করতে চাই। সরকার আমাদের মত গরিব মানুষদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দিলে অবহেলিত এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি এর সাথে জড়িতদের সংসারে কিছুটা সুখের আলো ফিরে আসবে বলে মনে করি।