মঙ্গলবার ● ৪ জুলাই ২০১৭
প্রথম পাতা » খুলনা » সুন্দরবনের আয়তন ৩৭ বছরে কমেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার
সুন্দরবনের আয়তন ৩৭ বছরে কমেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার
বাগেরহাট প্রতিনিধি,সুন্দরবন থেকে ফিরে :: (২০ আষাঢ় ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১.১৪মি.) ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের আয়তন প্রতি বছরই কমছে। উজানে মিঠা পানির প্রভাহ কমার ফলে তিব্র লবণাক্ততা, সমুদ্রের প্রবল ঢেউ- নদী ভাংগন ও ভূমিদস্যুর কবলে পড়ে গত ৩৭ বছরে সুন্দরবন ১৪৪ বর্গকিলোমিটার আয়তন হারিয়ে। আর সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী ১০ কিলোমিটার জুড়ো ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’র (ইসিএ) বনভূমির কি পরিমান ক্ষতির মুখে পড়েছে তার কোন হিসেব নেই। পরিবেশ গবেষকরা বলছেন, দেশের ৫১ ভাগ বণাঞ্চালের এই সুন্দরবন জাতিসংঘের রামসার কনভেনশন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি। ওই কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে স্বাক্ষর করছে। এর ফলে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনে আন্তর্জাতিক শর্ত অনুযায়ী সুন্দরবনের ক্ষতি হতে পারে, এমন কোনও তৎপরতা চালাতে পারে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেনসিং অর্গানাইজেশনের (স্পারসো) ‘টাইম সিরিজ অ্যানালাইসিস অব কোস্টাল ইরোশন ইন দ্য সুন্দরবনস ম্যানগ্রোভ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হচ্ছে, ম্যানগ্রোভের চিরায়ত রীতি অনুযায়ী যতটুকু নতুন করে চর পড়ে বন গড়ে উঠেছে, তার চেয়ে বেশি ভাংগছে । এই ৩৭ বছরে নতুন ভাবে চর জেগেছে মাত্র ১০৪ বর্গকিলোমিটার, আর ভাংগনের কারনে সুন্দরবন তার আয়তন হারিয়েছে ২৩৩ বর্গকিলোমিটার। আবার ভাংগার হার পূর্ব দিকের চেয়ে পশ্চিম দিকে অনেক বেশি।
স্পারসোর এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের তুলনায় ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালে বন কমেছে সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বেড়েছে ২৯ বর্গকিলোমিটার হারে। আবার একই সময়ে আয়তন হারিয়েছে ৩২ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সময়কালে সুন্দরবনের আয়তন বেড়েছে বছরে মাত্র ৬ বর্গকিলোমিটার হারে। এ সময়ে আয়তন হারিয়েছে ৪২ বর্গকিলোমিটার সুন্দরবন। শুধু মাত্র ভাংগনের কারণেই প্রতিবছর ৬ বর্গকিলোমিটার করে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন। ১৯৭৩ সালের পর মাত্র ৩৭ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার। গবেষকদের ধারণা, উজানের ফারাক্কা বাঁধের কারনে নদীগুলোর ক্ষীণ প্রবাহ ও সমুদ্র স্রোতের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে ভাংগা-গড়ার ব্যবধান বড়েই চলেছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনেরও প্রভাব রয়েছে। ভাংগা-গড়ার এই প্রবণতা স্থায়ী হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ ম্যানগ্রোভ বনটির বাংলাদেশ অংশ আরো সংকুচিত হবার আশংকা বেড়েই চলেছে।
বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী তিব্র নোনা পানি পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন। যা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত। ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের বাংলাদেশে অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাংগা-গড়ার মধ্যে আয়তনে ছোট হয়ে আসার পাশাপাশি সুন্দরবনের আশেপাশে নানা শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ভূমি অধিগ্রহণ ও মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে এই বনটি তার বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পরিবেশ অধিদফতর ওসব এলাকাতেই ১৫০টি প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে। এসবের কারনে সুন্দরবনের আয়তন কমার পাশাপাশি কমেছে গাছ ও প্রাণি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা মতে, ১৯৫৯ সালে এই সুন্দরবনে প্রতি হেক্টরে সুন্দরী গাছের সংখ্যা ছিল ২১১টি। কিন্তু ১৯৮৩ সালে ১২৫ ও ১৯৯৬ সালে ১০৬ এ নেমে এসেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের হেক্টর প্রতি গাছের সংখ্যা নেমে আসতে পারে ৮০টিতে। ফারাক্কা বাধেঁর কারনে মূলত উজানে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়া ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারনে সুন্দরবনে গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এর কারনে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে বা প্রাণ-প্রকৃতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনেরও প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরবন বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মোহম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, আমাদের সামনে আর কোনও পথ নেই। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচাতে হলে ওয়ার্ড হ্যারিটেজ এই সুন্দরবনকে ম্যনগ্রোভ বনের মতো করেই স্বভাবিক নিয়মে থাকতে দিতে হবে।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষনা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি তিব্র লবণাক্ততা, সমুদ্রের প্রবল ডেউ- নদী ভাংগনের কারনেই শুধু সুন্দরবন সংকুচিত হচ্ছেনা। সরকারের উদাসিনতা ও মানুষ্যসৃষ্ট কারনে সুন্দরবনের জলজ ও বনজ প্রাণিসহ জীববৈচিত্র্যের সব থেকে বেশী ক্ষতি হ্েচ্ছ। সুন্দরবনে অস্তিত্ব রক্ষায়, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণি শিকার রোধসহ মাছের অভয়াশ্রম ও খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা ও কাঠসহ সুন্দরবনের সম্পদ পাচার রোধসহ ভূমিদস্যু-আগুনদস্যু এবং চোরা শিকারিদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। একই সাথে ক্ষতি এড়াতে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনে আন্তর্জাতিক শর্ত অনুযায়ী সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী ১০ কিলোমিটার জুড়ো ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’য় (ইসিএ) আর শিল্পকারখানা গড়তে দেয়া চলবে না। ইতিমধ্যেই গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাসহ মংলা বন্দরে আগত সব জাহাজগুলোর বর্জ্য শোধনাগার শোধন করেই সেই পানি নদীতে ছাড়তে হবে।
এ প্রসঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনের কোলঘেঁষে আর কোনও ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপন করতে দেয়া চলবে না। শিল্পবর্জ্য ও ধোঁয়া যে বনের ভয়াবহ ক্ষতি করবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের কো ক্ষতি বন্ধ করতে হবে। মংলা বন্দরসহ কলকারখানার বর্জ নদী অববাহিকায় দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব ফেলছে। যা খালি চোখে দৃশ্যমান নাও হতে পারে। অনেক প্রানী এই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না। এছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের কারনে সুন্দরবনে গাছপালা, বন্যপ্রানী জলজ প্রানীসহ কয়েকশত প্রজাতির মাছ সংকটে পড়েছে। এরফলে পানিতে থাকা মাছসহ অনেক প্রানীর প্রজনন ক্ষমতা হৃস পাচ্ছে।
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রানী ও প্রকৃতি সংরক্ষন বিভাগের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. জাহিদুল কবির মুঠোফোনে এ প্রতিবেদকে বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে কারনে প্রতিবছর সুন্দরবনে আয়তন যে পরিমান কমছে, সেই পরিমান নতুন বন গড়ছেনা। গভীর সমুদ্রের ঢেউ ও নদী ভাংগনের কারনে সুন্দরবনের পশ্চিম অংশে ভাংগনের মাত্রা অনেক বেশী। একারনে প্রতি বছর কিছু বনভূমি কমছে। এছাড়া সুন্দরবনের দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন ধরনের শিল্প কলকারখানা থাকলে তার প্রভাব তো অবশ্যই সুন্দরবনের উপর পড়ছে। এসব কারনে সুন্দরবন সংকুচিত হচ্ছে।