রবিবার ● ৯ জুলাই ২০১৭
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » ড. কামাল হোসেন : কপট সত্যবাহক
ড. কামাল হোসেন : কপট সত্যবাহক
সিরাজী এম আর মোস্তাক :: শ্রদ্ধেয় ড. কামাল হোসেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হলেও তিনি সত্য গোপনকারী। এ সত্য বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, আইন ও বিচারে সৃষ্ট বিতর্কের চুড়ান্ত সমাধান। তিনি এ সত্য গোপন রেখে আশি বছর পার করলেন। তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে (২০ এপ্রিল, ২০১৭) দৈনিক প্রথম আলোতে আসিফ নজরুলের একটি সুন্দর লেখা পড়লাম। লেখাটিতে তার পিতা-মাতার নাম বা বংশ পরিচয় উল্লেখ নেই। তাকে দেখানো হয়েছে অনেক বড় করে। বাস্তবে তিনি এর চেয়েও বেশী গুণী। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকমী ছিলেন। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আটক হয়ে পাকিস্তানের করাচীতে নীত হন। পরে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর আবার তাঁর সহকর্মী হন। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের ঘোষণা, মুক্তিযোদ্ধা তালিকার গেজেট প্রকাশনা এবং দালাল আইনে বিচারের সার্বিক ঘটনা তার সামনেই ঘটেছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর সকল ঘোষণা ও নীতি সম্পর্কে অবগত। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ও নীতি নিয়ে বাংলাদেশে অনেক বিতর্ক ও রক্তপাত হয়েছে। এজন্য ড. কামাল হোসেনের একটি বিবৃতিই যথেষ্ট ছিল। অথচ তিনি এখনও নিরব রয়েছেন। তার এ নিরবতা বঙ্গবন্ধু ও জাতির সাথে স্পষ্ট কপটতার শামিল। তাই তার নিরবতা ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বার্তা আদায় করাই আমার এই লেখার উদ্দেশ্য।
এবার ক্রমান্বয়ে আসি। ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনের গ্রেফতারের ঘটনা আলোচনা করেছেন, বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলা ও লেখক কাজী মোহাম্মদ সাখাওয়াতউল্লাহসহ বহু লেখক। তারা কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন, আর অনেকে বলেছেন জিয়াউর রহমানকে। এসব বর্ণনা, লেখালেখি ও বিতর্কের সমাপ্তি একটি বাক্যেই সম্ভব, তা রয়েছে ড. কামাল হোসেনের কাছে। এ বিষয়ে তার বিবৃতি সংবিধানের মতোই গৃহীত হবে। চির অবসান হবে, স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক নিয়ে অনাকাঙ্খিত বিতর্কের।
ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যা প্রসঙ্গে সৃষ্ট বিতর্কও মেটাতে পারেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে শহীদ-গাজী নির্বিশেষে দেশের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেছেন। নিজেও একজন বন্দী মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়েছেন। মাত্র ৬৭৬ যোদ্ধাকে বিশেষ খেতাব দিয়েছেন। তম্মদ্ধে সাতজন শহীদকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দিয়েছেন। আর সুনির্দিষ্ট করেছেন ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের সংখ্যাটি। বঙ্গবন্ধুর সকল ভাষণে তা স্পষ্ট হয়েছে। অনলাইনে শুনুন-(https://www.youtube.com/watch?v=ExL5YvTCxCw অথবা (https://www.youtube.com/watch?v=CXKlLJB9O8E)। বঙ্গবন্ধুর সময়ে দেশে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা পার্থক্য ছিলনা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও কোটাসুবিধা ছিলনা। অথচ এখন মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ৬৭৬ থেকে বেড়ে দুই লাখেরও বেশি হয়েছে। তালিকাভুক্তদের বড় অংকের ভাতাসহ পরিবার-পরিজনকেও কোটাসুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বীর, ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ আত্মত্যাগী নারী মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বঞ্চিত হয়েছে। শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত পরিবার ছাড়া তালিকাবহির্ভূত ষোলকোটি জনতা পরিচয়হীন হয়েছে। ড. কামাল হোসেন এটি ভালোভাবে জানেন। তিনি এ বিভাজন ও বৈষম্য দূর করতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধানীতি তুলে ধরতে পারেন। জাতি তা সাদরে গ্রহণ করবে। দেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে।
ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশকে যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ক থেকেও রক্ষা করতে পারেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সময়ে দেশীয় আইনে শুধু বাংলাদেশী দালালদের বিচার করেছিলেন। চিকন আলী নামে একজনের ফাঁসিও কার্যকর করেছিলেন। তখন আদালতে আন্তর্জাতিক শব্দটি ছিলনা। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু নিজেই এ বিচার বাতিল করেন এবং মামলার সমস্ত কাগজ-পত্র বিনষ্টের আদেশ দেন। ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও আইনবিদ হিসেবে নিজেই তা বাস্তবায়ন করেছেন। বর্তমানে সে একই বিচার চলছে, বিশ্বজুড়ে সমাদৃত আদালত তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দ্বারা। এবারও পাকিস্তানী খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশীরা অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। আদালতে আন্তর্জাতিক শব্দ থাকলেও তাতে পাকিস্তানীদের অপরাধ প্রমাণ হয়নি। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে সংগঠিত সকল গণহত্যা ও অপরাধ বাংলাদেশীরাই করেছে। সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ, সাক্ষ্য ও সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ পিটিশনের মাধ্যমে বিচার সস্পন্ন হয়েছে। এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিবর্তিত হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষপুর্ণ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক হাজার হাজার গ্রন্থ মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। কারণ যেখানে সর্বোচ্চ আদালতে পাকিস্তানিরা অপরাধী সাব্যস্ত হয়নি, সেখানে এসব গ্রন্থের বর্ণনা স্পষ্ট আদালত অবমাননার শামিল।
এটি এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। ফলে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিদেশে গেলে, প্রথমে তাকে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বা তাদের স্বজন সন্দেহ করা হয়। কোনো পাকিস্তানীর ক্ষেত্রে তা হয়না। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে রায়ের ফলে বিশ্ববাসী পাকিস্তানীদের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশীদেরকে গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী মনে করে। বঙ্গবন্ধু এ কলঙ্ক চিন্তা করেই দালাল আইনে প্রচলিত বিচার বাতিল করেছিলেন। আজ বাংলাদেশে সে কলঙ্ক চেপেছে। এজন্য ড. কামাল হোসেন অনেকাংশে দায়ী। তিনি যদি ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক শব্দটি ব্যবহারের প্রতিবাদ করতেন এবং ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু গৃহীত নীতি ও ঘোষণা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতেন, তাহলে বাংলাদেশে এ কলঙ্ক আসতনা। মহান বীর ও লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ক নয়, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা নিবেদন হতো। এরপরও ড. কামাল হোসেন নিরব রয়েছেন। অর্থাৎ তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে খন্দকার মোশতাকের চেয়েও কপটতা দেখিয়েছেন।
এখনও সময় আছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর সত্যবাহক হতে পারেন। উল্লেখিত বিভাজন ও বিতর্ক নিরসনে বঙ্গবন্ধুর মহান নীতি ও ঘোষণা ব্যাখ্যা করতে পারেন। জাতি তা স্বাদরে গ্রহণ করবে। তিনি কপট সত্যবাহক থেকে শান্তির দূত বরিত হবেন।
শিক্ষানবিশ আইনজীবি, ঢাকা।
[email protected].