বুধবার ● ১৯ জুলাই ২০১৭
প্রথম পাতা » মুক্তমত » ফরহাদ মজহার ও আমাদের নিরাপত্তাহীনতা
ফরহাদ মজহার ও আমাদের নিরাপত্তাহীনতা
সিরাজী এম আর মোস্তাক :: (৪ শ্রাবণ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১.৫৩মি.) ৬ জুলাই, ২০১৭ ইং তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে বিশিষ্ট লেখক ও কবি ফরহাদ মজহারের (৩ জুলাই) অপহরণ বিষয়ে একটি ভয়ঙ্কর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টটি সঠিক হলে, তা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। রিপোর্টটির শিরোনাম, “ফরহাদ মজহারকে মারধর করে অপহরণহারীরা (পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দি)”। সেখানে উল্লেখ হয়েছে, ‘অপহরণকারীরা ফরহাদ মজহারকে মাইক্রোবাসে তুলেই মারধর করে এবং বলে, ‘তুই বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।’ বর্ণণাক্রমে সেখানে আরো উল্লেখ হয়েছে, ‘সেদিন (৩ জুলাই) রাতে ফরহাদ মজহার হানিফ পরিবহনে যশোরের নওয়াপাড়া বাজার অতিক্রম করে বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলের সামনে এলেই বাসটি থামানো হয়। অভয়নগর থানার পুলিশ বাসটির সুপারভাইজার হাফিজুর রহমানকে ফোন করে বাসটি থামাতে বলেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ ফরহাদ মজহারকে বাস থেকে নামিয়ে আনে। পরে র্যাব-৬ এর একটি দল তাঁকে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে তাদের গাড়িতে তোলে। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাবের মধ্যে বাগবিতন্ডা হয়। একপর্যায়ে র্যাব তাঁকে নিয়ে উল্টোপথে খুলনার দিকে যেতে থাকে। তখন পুলিশের গাড়িটিও র্যাবের গাড়ির পিছু নেয়। প্রায় ১০ কিলোমিটার যাবার পর খুলনার ফুলতলায় ডিআইজির নির্দেশে পুলিশের আরো গাড়ি র্যাবের গাড়িকে ব্যারিকেড দেয়। র্যাবের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এই অবস্থায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এরপর পুলিশ ফরহাদ মজহারকে ঢাকায় নিয়ে যায়।’ এ রিপোর্টটি সঠিক হলে জনাব ফরহাদ মজহারকে ৪ জুলাই আদালতে তোলা ও জবানবন্দি নেয়ার প্রয়োজন ছিলনা। বিভিন্ন স্তরে তদন্তেরও দরকার ছিলনা। র্যাব-পুলিশের উল্লেখিত বিরোধে স্পষ্ট হয়েছে যে, ঘটনাটি সুপরিকল্পিত।
ফরহাদ মজহার একজন সাদামাটা মানুষ। সবসময় লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী পরেন। মানিব্যাগের পরিবর্তে মেয়েদের মতো কাছে রাখেন ছোট্ট ব্যাগ। জীবনের শেষ বয়সে এসে বিবেকের তাড়ণায় সত্যের পক্ষে সৎসাহস দেখান। হয়তো এ সৎসাহসের পরিণামই হাড়ে-হাড়ে টের পেলেন। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পর চরম মনোভঙ্গুর অবস্থা সত্ত্বেও আদালতে জবানবন্দি দিতে বাধ্য হলেন। এখন উক্ত জবানবন্দি ও পুলিশের তদন্তে পার্থক্য দেখা গেছে। হয়তো ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে সাধারণ মানুষও বলির পাঠা হচ্ছে। প্রশাসনের বহু কর্মকর্তাও এর শিকার হয়েছে। ফরহাদ মজহার ছাড়াও বহু ঘটনা রয়েছে।
২০১৬ সালে মহামান্য আদালত জঙ্গি ফাহিম নামে এক যুবককে ১০দিনের রিমান্ড দেয়। পুলিশের কাছে রিমান্ডে থাকার ২য় দিনে হাতকড়া অবস্থায়ই কথিত সন্ত্রাসীদের গুলিতে সে নিহত হয়। এতে স্পষ্ট হয়, কথিত সন্ত্রাসীরা পুলিশের চেয়েও শক্তিশালী! তারা পুলিশের যিম্মায় থাকা ব্যক্তিকেও হত্যা করতে পারে। এ ঘটনায় পুরো জাতি স্তম্ভিত হয়। এর পরপরই কথিত সন্ত্রাসীদের দ্বারা দেশে বেশকটি দুর্ধর্ষ ঘটনা ঘটে। ১ জুলাই, ২০১৬ তারিখে গুলশান হলি আর্টিজান রেষ্টুরেন্টে হামলা তার অন্যতম। সেদিন কথিত মাত্র ছয় জঙ্গি গ্রেনেড ছুঁড়ে ২পুলিশ হত্যা ও ৪০পুলিশকে আহত করার পর অবিশ্বাস্যভাবে ১৫বন্দিকে ছেড়ে দেয়। আর আমাদের দক্ষ প্রতিরক্ষা বাহিনী তাৎক্ষণিক অভিযান না চালিয়ে জঙ্গিদেরকে সারারাত অবকাশ দেয়। সন্ত্রাসীরা অবকাশ পেয়ে ২০জন বন্দিকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং হোটেলের রক্তাক্ত মেঝেতে সারারাত নিরবে কাটায়। পরদিন ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শুরু হলে, সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে নিহত হয়। তাদের পরিচয় এখনো স্পষ্ট নয়। কথিত পরিবার-পরিজন জঙ্গিদের লাশ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এতে সবাই বিস্মিত হয়। বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়।
এভাবে সিলেটে জঙ্গি অভিযানকালে ২/৩ মাইল জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি সত্ত্বেও আচমকা হামলায় র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা আজাদ আহত হয়। তাকে বিমানে করে দ্রুত সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। মুমূর্ষু সত্ত্বেও একদিনের মধ্যে দেশে ফিরে আনা হয়। এরপর ২দিনের মধ্যে সে মারা যায়। সিঙ্গাপুরের মতো সভ্য দেশে একজন বিদেশী মুমূর্ষু রোগীকে এভাবে ছাড়পত্র দেয়ার কথা নয়। মূলত সরকার যা জানায়, জনগণকে তাই মানতে হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখার বা প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই। ফলে দেশের দক্ষ প্রতিরক্ষাবাহিনী, প্রতিবন্ধী বিরোধীদল ও সচেতন মানবাধিকার কর্মীসহ সবাই সরকার প্রদত্ত ‘সিঙ্গাপুরী বাঁশ’ মেনে নেয়। এতে দেশের নিরাপত্তাহীনতা প্রকাশ পায়।
উল্লেখিত বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোটেও ভালো নয়। র্যাব-পুলিশের বাগবিতন্ডা, পুলিশের যিম্মায় থাকা সত্ত্বেও কথিত সন্ত্রাসীদের গুলিতে হত্যা, গুলশান হলি অর্টিজান রেষ্টুরেন্টে মাত্র ছয় জঙ্গির হলিখেলায় প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং সবশেষে সিঙ্গাপুরী বাঁশ দেখিয়ে সেনা কর্মকর্তা হত্যা, এসব মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। বরং আশংকা হচ্ছে, যেকোন সময়ে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। বিডিআর বিদ্রোহের মতো বা তার চেয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। তাই ফরহাদ মজহারের বিষয়টি একটি হুমকি ধরে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা, [email protected]