বৃহস্পতিবার ● ২০ জুলাই ২০১৭
প্রথম পাতা » অর্থ-বাণিজ্য » দামতুয়া জলপ্রপাতে একদিন
দামতুয়া জলপ্রপাতে একদিন
হাসান মাহমুদ, আলীকদম প্রতিনিধি :: (৫ শ্রাবণ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৮.১০মি.) চার দিকে দিগন্তজোড়া বিস্তৃর্ণ গ্রন্থিল পাহাড় আর অন্তবিহীন মৌন নিস্তব্দ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার আলীকদম উপজেলা। দেশের দক্ষিন-পূর্বের জেলা বান্দরবানের সাতটি উপজেলার মধ্যে আলীকদমের ভৌগলিক গঠন অন্যান্য উপজেলার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন আদলে সৃষ্ট। গোটা উপজেলার চারপাশে যেন বহুবর্ষ পূর্বে নিযুক্ত কোনে রাজ প্রহরীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল সুউচ্চ পাহাড়গুলো যেন নিরাপত্তার চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে এ উপজেলাকে। এসব পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অগনিত নান্দনিক সৃষ্টি। ‘দামতুয়া ঝর্ণা আর দামতুয়া জলপ্রপাত অন্তবিহীন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। উচু নিচু সর্পিল পাহাড়ি পথের অনেকটাই যেন ভুতুড়ে পরিবেশ। তবুও আবিষ্কারের নেশায় আমাদের উদ্যাম ছুটে চলা। ইট কাঠ পাথরের শহর ছেড়ে যারা কিছুটা নিরবে নিবৃতে দুরে কোথাও ঘুরে আসতে চান তাদের জন্য এটা উপযুক্ত স্থান।
নামকরণ :
স্থানীয় মুরুংদের ভাষায় দামতুয়া শব্দের অর্থ মাছেদের শেষ আভাস বা মাছকুম। যেহেতু একটি ঝর্ণার কারণে মাছেরা এর পর আর যেতে পারছেনা। সেহেতু এটি ‘দামতুয়া ঝর্ণা’ বলেই পরিচিত। আলীকদম-থানচি সড়ক সংলগ্ন সুউচ্চ পাহাড় থেকে স্থানীয় ব্যাঙঝিরি নামক ঝিরিটি দক্ষিন-পূর্ব থেকে আলীকদম উপজেলার স্বাভাবিক ভূমিঢালের রুপরেখা নিয়ে বয়ে গেছে উত্তর-পশ্চিম দিকে। এ ঝিরি বেয়ে মাছেরা উজানের দিকে আসতে থাকে। কিন্তু দামতুয়া বা মাছকুম পর্যন্ত আসার পর ঝর্ণার উচ্চতার কারণে মাছেরা আর উজান আসতে পারেনা। সুউচ্চ ঝর্ণাজলের বিক্ষিপ্ত আচরণে ঝর্ণাতলায় সৃষ্টি হয় গভির কুম। এই কুমে মাছেরা আবাস গড়ে বলেই এর নাম “দামতুয়া ঝর্ণা”।
যাতায়াত :
বাংলাদেশের যেকোন যায়গা থেকে কক্সবাজারের গাড়িতে এসে চকরিয়া নামতে হবে। চকরিয়া থেকে কোস্টার অথবা জীপ (চাঁদের গাড়ি) যোগে প্রায় দেড় ঘন্টায় আপনি পৌঁচে যাবেন আলীকদম। আলীকদম থেকে জীপ গাড়িতে (রিজার্ভ নিয়ে যেতে হবে) অথবা মটর সাইকেলে আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটার যাওয়ার পর আপনাকে পায়ে হেঁটে প্রধান সড়ক থেকে বাঁ দিকে যেতে হবে আরো দুই ঘন্টা।…………. পেয়ে যাবেন দামতুয়া জলপ্রপাত। দামতুয়া জলপ্রপাত দেখার পর ৫ থেকে ৭ মিনিট পায়ে হেঁটেই পেয়ে যাবেন দামতুয়া তুম বা দামতুয়া ঝর্ণা।
ভ্রমণ :
সকাল তখন আটটা ছুঁই ছুঁই। পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক আমরা একটি স্থানে সবাই মিলিত হলাম আমরা পাঁচ জন। কিছু সময় অতিবাহিত হতে না হতেই দল মোটামুটি ভারি হল। সব মিলিয়ে নয় জনের একটি দল। আমাদের বাহন হিসেবে আছে ৪টি মোটর সাইকেল। কিন্তু আমরাতো ৯ জন। কিছুই করার নাই। একটি তে তিন জন চড়ে বসলাম। কখনো কখনো পাহাড়ের সর্বোচ্চ চুড়া আর কখনো কখনো পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো পাকা সড়ক বেয়ে উদ্যম বেগে ছুটলো আমাদের মটর সাইকেলগুলো। উদ্দেশ্য দামতুয়া জলপ্রপাত আর দামতুয়া ঝর্ণা। পঁয়ত্রিশ মিনিটেই আমরা পৌঁছে গেলাম ১৭ কিলোমিটার আদুপাড়া এলাকায়। একটি দোকানের সামনে মটর সাইকেলগুলো রেখে দোকান থেকে কিছু শুকনা খাবার আর পানি নিয়ে প্রস্তুত পাঁয়ে হাটার জন্য। কিন্তু কিভাবে যাবো! রাস্তাতো আমাদের সবারই অজানা। দোকানদারের সাথে কথা বললাম। তার মাধ্যমেই পেয়ে গেলাম একজন গাইড। শুরু হল আমাদের পায়ে হাঁটা। কিছুদুর গিয়েই গাইড পাহাড়ি বাঁশ ঝাড় থেকে সবার জন্য তিন হাত লম্বা একটি করে লাঠি কেটে দিল। বুঝতে পারছিলামনা কি কাজে আসবে। কিন্তু উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে চলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম এর প্রয়োজনীয়তা। লাঠিগুলো না থাকলে হয়তে অতটা সহজে পাহাড় বেয়ে উঠা সম্ভব হত না। প্রায় ত্রিশ মিনিট হাটার পর পেলাম ওয়াংপা ঝর্ণা। বিশাল বিশাল পাথরের গা বেয়ে পাহাড়ের পাদদেশের দিকে ধেয়ে আসা শীতল জলরাশি যেন প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। এখানে এসে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে, সামনে হয়ত এর চেয়েও বড় ঝর্ণা বা জলপ্রপাত থাকতে পারে। তবুও আমাদের কাছে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে মিনিট দশেক পর আবারো পথ চলা।
প্রায় আধঘন্টা হাটার পর পেলাম পামিয়া মেম্বার পাড়া। অনেকটা ক্লান্ত। তবুও থামলামনা! আরো কিছুদুর গিয়ে মনে হল এখন আর সম্ভব নয়। এখন মনে হচ্ছে পেটে কিছু দেয়া গেলে বোধ হয় সফল ভাবেই যাওয়া যাবে। দশ মিনিটের যাত্রা বিরতিতে শুকনো খাবারগুলো নিয়ে বসে পড়লাম সবাই। যতারীতি খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়েই মনে হল ধড়ে প্রাণ ফিরেছে। আবার পথ চলা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের আনন্দটা যেমন, তেমনি আবার মাঝে মাঝে সুউচ্চ পাহাড় চুড়ায় সরু পথ বেয়ে চলাটাও অনেকটা কঠিন। খানেক অসতর্কতায় ছোট খাট দুর্ঘটনার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোন রকম পাঁ ফসকে গেলেই কোন ভাগাড়ে গিয়ে পড়বেন খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
আমাদের দলে সবচেয়ে আকর্ষণ ছিল আমাদের সেলফি মাষ্টার আমার বাল্যবন্ধু শুভরঞ্জন বড়–য়া (অন্য সবার কাছে শুভদা বলেই পরিচিত। কারণ দলেল মধ্যে বয়সের দিক থেকে সেই জৈষ্ঠ্য)। একটু সুযোগ পেলেই একটা সেলফি না তুললে যার ভাত হজম হয়না। ওই বেচারা আজ সেলফি তুলতে যেন ভুলেই গেছে। গোটা পথ জুড়েই শুভ ছিল আমাদের আনন্দের খোরাক। অন্যদিকে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কমতি ছিলনা। কিসের দুঃশ্চিন্তা একটু বলি- দলের মধ্যে সবচেয়ে মোটা ছিল সে। উচ্চতায় যদিও ৫ ফুট ৩ বা ৪ ইঞ্চির বেশি নয়। কিন্তু ওজনে প্রায় ১০০ কেজির তেমন একটা কম হবেনা। সাধারণত এমন বিশাল দেহিরা অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে অনেকটা অক্ষম। তাই ওকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা ছিলতো বটেই।
যাই হোক বিশ্রাম শেষে পূনরায় চলতে লাগলাম। খাড়া ঢাল বিশিষ্ঠ আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথে। শুধু উঠছিই। জানিনা আরো কত সময় উঠতে হবে! আরো দশ মিনিট হাঁটার পর এবার নামার পালা। এত ভয়ঙ্কর সরু পথ দিয়ে চলা সত্যিই কষ্টকর। যতটা উঠা ঠিক ততটাই নামা। পাহাড় নেমেই পেলাম একটি মুরুং পাড়া প্রায় আট দশখান মত ঘর আছে। প্রতিটি ঘরেই দেখা গেছে মুরুং শিশুদেরকে। বড়দের অনুপস্থিতি হঠাৎকরে মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। মনে হল এ এক জনশুণ্য নগরী। গাইড সিংলক ম্রো এর কাছ থেকে জানলাম যে, দিনের বেলা ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে বাড়িতে রেখে বড়রা সবাই জুমে কাজ করতে যায়। তাই জনশুণ্য মনে হয়।
প্রিয় পাঠক এখানে আমাদের অভিযাত্রী দলের সাথে একটু পরিচয় করিয়ে না দিলেই নয়। ইসমত ইলাহি কাকারে থেকে এসেছেন। একজন অত্যান্ত ভ্রমন প্রিয় মানুষ। সাথে আছেন তার বন্ধু নঈম। মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম প্রেস ক্লাবের সভাপতি, বন্ধু শুভ রঞ্জন বড়–য়া। কল্লোল চৌধুরী, গ্রামীন ব্যাংক থেকে। ছোট ভাই দেশমনী তঞ্চঙ্গ্যা, নয়ন শর্মা, নিকসন শর্মা আর আমি হাসান মাহমুদতো আছিই আপনাদের সাথে।
মুরুং পাড়া থেকে প্রায় আধ ঘন্টা হাটার পর দেখা মিললো দামতুয়া জনপ্রপাতের। এখানে এসে বুঝার মত উপায় ছিল না যে, এই গভির অরণ্যে প্রকৃতির এতবড় লীলা অনাদরে শুপ্ত হয়ে আছে শত শত বছর ধরে। প্রায় ত্রিশ ফুট চওড়া শীতল জলের নাহার যেন কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি। গোটা পথ জুড়েই ছোট বড় অসংখ্য ঝর্ণা রয়েছে এখানে।
প্রকৃতির নান্দনিকতায় ভরপুর জলপ্রপাতটি দেখে কে না মাতোয়ারা হবে। পৃথিবীর সমস্ত কিছু ভূলে আমরাও কাটিয়ে ছিলাম কিছু সময়। গা ভিজিয়ে ছিলাম পাহাড়ের গাত্র থেকে বেয়ে পড়া পাথর ভেজা শীতল জলে। আবার পথ চলা। মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। এবার দামতুয়া ঝর্ণা। এখানে এসে মনে পড়ছে জাতীয় কবির ‘রুম ঝুম, রুম ঝুম, ঝুম ঝুম নুপুর বাজে, আসিলোরে প্রিয় আসিলোরে’ কবি যেন পাহাড়ের পাঁয়ে পরা জলের নুপুরের উদ্দাম ছুটে চলাকেই বুঝাতে চেয়েছেন। এখানে এসে দৈনন্দিন জীবনের নান্দনীকতাকে একটি বারের জন্যও মনে পড়েনি। কিন্তু এখান থেকে মন যেন যেতেই চাইছেনা। বার বার ইচ্ছে করছে আর একটি বার ঝর্ণা জলে গা ভিজিয়ে নিই। পপ্রকৃতির ভালবাসায় আমরা সিক্ত হলাম। আমাদের সব ক্লান্তি মুছে গেল প্রাপ্তিতে। মনের মধ্যে অন্য কিছুর শুন্যতা রইল না। মনের অজান্তেই সবাই বলে উঠলো, আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে….। অবশেষে ফেরার পালা।
যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা কিংবা পাকা সড়ক না থাকায় শতবর্ষী এসব ঝর্ণাগুলো রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে অনাদরে। কিন্তু সম্প্রতি একদল তরুন যুবেকের উদ্যমী পচেষ্টায় বেরিয়ে আসছে পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা এসব নান্দনিক সৃষ্টি…..।
সঙ্গে যা নেবেন :
পর্যাপ্ত শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গামছা অথবা প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত কাপড়। একজন গাইড আবশ্যক। বর্ষায় আপনার মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ও ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর নিরাপত্তার জন্য পলিব্যাগ প্রয়োজন হতে পারে।
থাকা ও খাবারের ব্যবসস্থা :
দুর থেকে যারা আসবেন তাদের জন্য থাকার একমাত্র ব্যবস্থা জিয়া বোর্ডিং। এটি মাঝারি মানের একটি বোর্ডিং। যোগাযোগ : মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন (০১৫৫৩৬০৩৯১৫)। এছাড়াও সরকারী একটি রেস্ট হাউজ আছে। কিন্তু তা বর্তমানে বিজিবি’র কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে শীগ্রই আরো দুটি রেস্ট হাউজের কাজ সম্পন্ন হবে। আলীকদমের খাবার হোটেলগুলো মাঝারি মানের। তাই খুব বেশি কিছু আশা না করাই ভাল।