বুধবার ● ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » তথ্যপ্রযুক্তি » সংকীর্ণ হয়ে আসছে আমাদের দিগন্ত
সংকীর্ণ হয়ে আসছে আমাদের দিগন্ত
সম্প্রতি আমি এক গবেষণার কাজে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখা করার উদ্দেশ্য হলো আমি যে বিষয়ের ওপরে গবেষণা করছি সেই সম্পর্কে তাকে অবহিত করা। সেই সঙ্গে তার কাছ থেকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া। যথারীতি তার অফিসে গিয়ে দেখা করলাম। ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমাকে স্বাগত জানিয়ে বসতে বললেন। কফি অফার করলেন। আলোচনা শুরু হলো। শেষের দিকে আমি তাকে এক এক করে আমার প্রশ্নগুলো করতে লাগলাম। একটু পর খেয়াল করলাম, আমি প্রশ্ন করার পর তিনি সময় নিচ্ছেন এবং গুগলে অনুসন্ধান করে আমাকে তার উত্তর জানাচ্ছেন। উত্তরগুলো তিনি নিজের ভাষাতেই জানাচ্ছেন কিন্তু গুগল থেকে নিয়ে। খুব একটা কি অবাক হলাম? হয়তো না।
আমার একজন সহকর্মী কাম দীর্ঘদিনের বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তার অফিসে গেলাম। দরজায় টোকা দিলে খুলতে একটু দেরি হলো। দরজা খুলে ভদ্রলোক একটু ভালোই বিরক্ত হলেন যদিও সেটা বুঝতে দিলেন না। প্রথমত আমি ফোন না করে গিয়েছি। দ্বিতীয়ত ঠিক ওই সময়ে তিনি কাউকে আশা করেননি। যা হোক আমাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেতরে সম্ভাষণ জানালেন। আমি তার অফিসে ঢুকে একটু হকচকিয়ে গেলাম। তার সামনে একটা ডেস্কটপ, একটা ল্যাপটপ ও একটা আইপ্যাড। তিনটাতেই গুগল সাইটটি খোলা রয়েছে। তার সামনে ও দুই পাশে দেয়াল ও সেলফের কার্নিশে অসংখ্য কাগজ টেপ দিয়ে লাগানো। দু-একটির দিকে চোখ বুলিয়ে বেশ অবাক হলাম। কাগজের সব লেখাগুলো ও টপিক সবই তার গবেষণা সম্পর্কিত। তিনি আমাকে দেখে মোটেও বিচলিত হলেন না বরং বিনয়ের সঙ্গে জানালেন একটু পরেই তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ফোন ইন্টারভিউ হবে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসলাম।প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
আমার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাত এগারোটায় এল আমার কাছে তার ম্যাথের কিছু সমস্যা নিয়ে। একপর্যায়ে গুন অঙ্কে ১৩ কে ৯ দিয়ে গুন করতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করতেই সে ক্যালকুলেটরে গুন করে বলে দিল। আমি বললাম এটা করতে তোমার ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে হলো? তুমি নামতা জান না? সে বলল হয়তো চেষ্টা করলে সে পারবে কিন্তু টিচার বলছে ক্যালকুলেটরে করতে, তাহলে সময় কম লাগবে। ভাবলাম হয়তো সে ঠিকই বলেছে। কী দরকার ২০ এর ঘর পর্যন্ত নামতা কষ্ট করে শেখার? হাতের কাছে ফোন, আইপড, আইপ্যাড, ক্যালকুলেটর এবং ঘড়িতেও যেখানে ক্যালকুলেটর সেখানে নামতা শিখে সময় নষ্ট করার কী দরকার।
এবার একটু অন্য রকম প্রসঙ্গ। একদল মানুষ চট্টগ্রামের কোনো রাস্তায় ভিড় করে আছে। সবাই ছবি তোলা আর ভিডিও করা নিয়ে ব্যস্ত। ঘটনা কি? একজন মানসিক প্রতিবন্ধী মহিলা রাস্তায় প্রসব বেদনায় ছটফট করছেন আর অনেকগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে আর ছবি তুলে যার যার ফেসবুকে দিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছে কে কার আগে এটি পোস্ট করতে পারেন। বৃষ্টিভেজা কর্দমাক্ত রাস্তায় একজন মধ্যবয়সী মানুষ পিছলে পড়ে কাদায় মাখামাখি আর দুই পাশের মানুষ ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। সুন্দর একটি জায়গায় বেড়াতে গেছেন প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করতে। বেশির ভাগ মানুষই ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপলোড করছেন। দৃশ্য কতখানি দেখা হলো বলাই বৃথা। কারণ আসা যাওয়ার পথ পুরোটা জুড়েই তারা পাঁচ আঙুলের মধ্যেকার দিগন্তে তাদের দৃষ্টি জোড়াকে নিবদ্ধ রাখলেন। কি দেখছেন? কিছুই না, ফেসবুকে বন্ধু লিস্টের অন্তত দুই শ বন্ধুর স্ট্যাটাস। কে কোথায় কি খাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন এসব। পারিবারিক ভ্রমণে বেরিয়েছেন চারজন। নিজস্ব সময় কাটানোর জন্য। সবাই যার যার ল্যাপটপ আর ফোন এই সময় কাটিয়ে দিলেন। না হলো কথা, না হলো দেখা, না হলো কোনো আলাপন। পার্কে গেছেন হাঁটতে। সুন্দর বিকেল, কী সুন্দর সোনালি রোদ্দুর। ইস এই সময়ে দুজনের বা চারজনের আড্ডা ভালোই জমত। পার্ক ভর্তি মানুষ কিন্তু কথা বলার কেউ নেই। সবাই ব্যস্ত। সবারই দৃষ্টি ওই দুই হাতের তালুর মাঝের দুই ইঞ্চি বাই দুই ইঞ্চি ফোনের স্ক্রিনে। ওটাই সবার দিগন্ত। ওই দিগন্ত অনেক বিশাল। ওখানেই আছে সব বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, লেখাপড়া, প্রেম, রোমান্স, সবজান্তা গুগল, সমস্ত পৃথিবী। এইটুকু জীবনে আর কি চাই?
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীতআসলেই কি তাই? আমরা কি আমাদের দেখার, অনুভব করার দিগন্তকে সংকীর্ণ করে ফেলছি না? আমাদের জ্ঞানের দৌড় এখন হালকার ওপরে ঝাপসা। আমরা সব জানি কিন্তু সব জান্তার সহায়তায়। আমরা সব দেখি কিন্তু মুঠোফোনের ক্ষুদ্র মনিটরে। আমরা সবকিছু অনুভব করি কিন্তু অন্তরাত্মা দিয়ে নয়। আমাদের অনুভূতি আমাদের আবেগ এসব কি দিন দিন সুপারফিসয়াল হয়ে যাচ্ছে না? আমরা ফেসবুকে একটা ছবি দেখলে সেটাতে হাজার লাইক দিই। একটা জোকস দেখলে সেটা সানন্দে সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার করি। আমার কোনো বন্ধু ক্রিয়েটিভ কিছু করলে, লিখলে আমরা সেটা পড়তে পারি না। কারণ আমাদের সময় নেই অত কিছু পড়ার। আমাদের সময় নেই ওসব দেখার। কারণ আমরা যারপরনাই ব্যস্ত।
আমরা যারা নিজেদের কিছুটা আগের প্রজন্ম বলে দাবি করি আমরা কি করছি? আমরা স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালোবাসি। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করি। কী ছিলাম, কী হলাম, কী করলে কী হতো, কী না করে কী হলো, কেন এটা করলাম এই সব ভেবে দিনাতিপাত করছি। আমরা না পারছি আমাদের বিশাল দিগন্তের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে আবার না পারছি ক্ষুদ্র দিগন্ত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কি আদৌ কোনো উপায় আছে? আমরা ভুলতে বসছি দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া—কারণ আমার চক্ষু মেলার দরকার নাই। বোতাম টিপলেই যদি আমি সব পেয়ে যাই, আঙুলের স্পর্শে যদি দুনিয়া আমার কাছে চলে আসে কী হবে আমার চক্ষু মেলিয়া বাইরে তাকাবার?প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসন্তীর কথা বলে। বাসন্তীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। একদিন মধ্যরাতে সবাই যখন ঘুমে, চারদিকে সুনসান নীরবতা। বাসন্তীর ফেসবুকে আমন্ত্রণ আসে সাজিদ নামের একজন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ছেলের বন্ধু হওয়ার। অনেক ভাবনা চিন্তার পর বাসন্তী তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। এরপর? কথা চলে, মেসেজ চলে দিনের পর দিন। মাস গড়িয়ে বছর। দুজনের প্রেম হয়ে যায়। ইন্টারনেট প্রেম। বাসন্তীর ক্ষুদ্র কল্পনায় অস্ট্রেলিয়া দেখে, দেখে তার দুই ইঞ্চি বাই দুই ইঞ্চি সেল ফোনের ক্ষুদ্র মনিটরে। সাজিদের বলা গল্পগুলো, দেখানো স্বপ্নগুলো বাসন্তীকে নিয়ে যায় সুদূর অস্ট্রেলিয়ার সুন্দরতম কোনো এক শহরে। অনেক অনুরোধের পরেও সাজিদ কোনো দিনও ওয়েবক্যামে ধরা দেয়নি বাসন্তীকে। সরল মনের গ্রাম্য মেয়ে বাসন্তী সাজিদকে বিশ্বাস করেছে। সাজিদ বলেছে সে আসবে বাসন্তীর কাছে। সাজিদ আর আসেনি। হঠাৎ একদিন সাজিদ হারিয়ে যায় ফেসবুক থেকে। বাসন্তীর জীবন থেকে। সাজিদ এরই মধ্যে অন্য আইডি খুলে হয়তো অন্য আরও অনেক বাসন্তীকে খুঁজে নেয়। বাসন্তী এখনো প্রতি রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে ফেসবুকে সাজিদকে খোঁজে। প্লাস্টিকের চার দেয়ালে বন্দী ক্ষুদ্র দিগন্তে আটকে থাকে বাসন্তীর দুচোখ, কল্পনা ও স্বপ্ন। জীবনের প্রথম ভালো লাগা, ভালোবাসা একজন অদেখা মানুষের জন্য তার আকুতি গুমরে কাঁদে। বাস্তব জীবনের সুবিশাল দিগন্ত জোড়া প্রকৃতির ক্যানভাসে বাসন্তীর সুন্দর চোখ জোড়া যেন সত্যি বেমানান। তবুও একদিন বাসন্তী জেগে উঠে। ফিরে আসে বাস্তবতায়। বাসন্তী এখন চারপাশের সুবিস্তৃত দিগন্তে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ায়।
ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তি। আমরাও তা থেকে পিছিয়ে থাকতে চাই না। সমগ্র ভূমণ্ডল যখন হাতের মুঠোয়। ঘরের লিভিং রুম যখন এক একটি মিনিয়েচার দিগন্ত। আমরা যখন আমাদের হাতের মুঠোয় সমগ্র দিগন্তকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমরা যেন কখনই ভুলে না যাই, আমাদের চার পাশের খোলা দিগন্ত অনেক বেশি বিস্তৃত। সেই দিগন্তের বৈচিত্র্যতা আরও অনেক বেশি গভীর, অতলান্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা এই দিগন্ত কখনই আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে না, করতে পারে না। সুন্দরতম মুহূর্তগুলো প্রিয়জনদের সঙ্গে উপভোগ না করে আমরা যেন হাতের মুঠোর ক্ষুদ্রতর অস্থায়ী দিগন্তে হারিয়ে না যাই।