মঙ্গলবার ● ৮ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » রাঙামাটিতে ছেলের বিরুদ্ধে মায়ের মামলা,ছেলে কারাগারে : পারিবারিক দ্বন্দে দিশেহারা গোটা পরিবার (ভিডিওসহ)
রাঙামাটিতে ছেলের বিরুদ্ধে মায়ের মামলা,ছেলে কারাগারে : পারিবারিক দ্বন্দে দিশেহারা গোটা পরিবার (ভিডিওসহ)
ষ্টাফ রিপোর্টার :: (২৪ শ্রাবণ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬.১৪মি.) রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী এলাকার সাবেক মেম্বার আহমদ কবির পরিবারে পারষ্পরিক কোন্দল ও পারিবারিক প্রতিহিংসার দাবানল সৃষ্টি হয়েছে। পরিবার নামক মধুশ্রেষ্ঠ ঐ প্রতিষ্ঠানে স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন আর মা-ছেলের বন্ধন হয়ে উঠেছে যেন বিষভান্ডার। পরিবারের সদস্যদের কারো মনে যেন স্নেহ ভালবাসা নামক বস্তুটি ছিলই না। পরিবারের কর্তা সাবেক মেম্বার আহম্মদ কবির বয়সের ভারে ন্যুজ আর বাকশক্তিহীন সমস্ত শরীর বিকল প্যারালাইসিসে আক্রান্ত দীর্ঘদিন। ছোট একটি ঘরে খাওয়া দাওয়া ও মলত্যাগ সবকিছু। তাকে দেখাভাল করেন মেঝ ছেলে ফয়েজ আহম্মদ ও তার স্ত্রী। পারিবারিক অশান্তিতে দিশেহারা হয়ে পরেছে পুরো পরিবার।
আহম্মদ কবির ও সালমা বেগম দম্পতির স্বামী-স্ত্রী এবং নূর আহাম্মদ, ফয়েজ আহম্মদ সালেহ আহম্মদ ও আমেনা বেগম ভাই বোন সম্পর্কের ফাটল দীর্ঘদিনের হলেও সম্প্রতি ১৭ জুলাই ২০১৭ তারিখে ঐ পরিবারে নাড়ীছেড়া ধন দুই পুত্র নূর আহাম্মদ স্ত্রী জারিয়া বেগম ও ফয়েজ আহম্মদ স্ত্রী রহিমা বেগম চার জনের বিরুদ্ধে মাতৃনির্যাতনের অভিযোগ এনে রাঙামাটি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে স্বয়ং মা সালমা বেগম (৬৫) ফৌজদারী অভিযোগ করেছেন। যার মামলা নং সিআর ১০৭/১৭। তারিখ- ২০/০৭/২০১৭ইংরেজি। একমাস আগেও মা সালমা বেগম নিজের গর্ভজাত সন্তানদের অত্যাচারের অভিযোগ এনে রেহাই পেতে আইনী সহায়তার জন্য রাঙামাটি পৌর মেয়রের বরাবরে আবেদন করেছিলেন।
এর আগে সাবেক মেম্বার আহম্মদ কবির ও সালমা বেগমের কণ্যা আমেনা বেগম নিজের ভাই ফয়েজ আহম্মদ ও তার স্ত্রী রহিমা বেগমের এর বিরুদ্ধে জমি জবর দখল, নির্যাতন ও নিজের স্বামীকে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ এনে গত ২০ মার্চ ২০১৭ তারিখে রাঙামাটি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ফৌজদারী নালিশ করেন। মামলা নং পিটি-৪৪/১৭। তারিখ-২০/০৩/২০১৭ইং।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে আহম্মদ কবির ও তার স্ত্রী সুসম্পর্ক নেই একসাথে থাকেন না আবার বিবাহ বিচ্ছেদও হয়নি। সংসারের এমন বৈরী সময়ে তিন সন্তান নূর মোহাম্মদ, ফয়েজ আহম্মদ ও সালেহ আহম্মদ অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে অন্যর ঘরে থেকে বড় হয়ে আজ পর্যন্ত তাদের নিজেদের কষ্টে নিজেরা সংসার গুছিয়েছেন। প্রতিবেশী আবু ড্রাইভার জানান সন্তান নূর আহাম্মদ,ফয়েজ আহম্মদ অর্থনৈতিকভাবে বেশী স্বাবলম্বী না হলেও শান্ত সৌজন্য এবং বিবাদহীন লোক। আগে সবকিছু ঠিক চলছিল এই কয়েক বছরের মধ্যে তাদের পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আর ফয়েজের মাকে মারধরের বিষয়ে তিনি জানান, তাদের মা সালমা বেগম এখানে থাকেন না সেদিন হঠাৎ করে তার মেয়ে আমেনাসহ এসেছে, তার পর চিৎকার শুনেছি কি নিয়ে ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে জানি না। তবে বাবা-মা’র প্রতি ছেলে ও বৌদের এবং ছেলে - বৌ,নাতি-নাতনী বাবা-মা’র আচরন আরো মধুর থাকার কথা কিন্তু এদের উভয়ের মধ্যে নেই।
মা সালমা বেগমের পুত্র ফয়েজ আহম্মদ সম্পূর্ন অভিযোগ অস্বীকার করে সিএইচটি মিডিয়াকে বলেন, আমার বোন আমেনা বেগম আমার ঘর ছেড়ে চলে গেছে আজ প্রায় এক বছর হলো, গত এক বছরে সে ও তার পরিবার ভেদভেদী এলাকায় ও ছিলনা, আমি তাকে কিভাবে মারপিট করবো, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। কারণ ও চলে যাওয়ার পর ১ মাস নিখিল কান্তি পালের বাসায় ভাড়া ছিল, তারপর বনরুপা লেকার্স পাবলিক স্কুলের কাছাকাছি দেলোয়ারের বাসায় ভাড়া ছিল এরপর বর্তমানে সাহনুর এর বাসায় ভাড়া রয়েছে। তার করা মামলায় পুলিশ যে তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছে সেটাও আমার বোধগম্য নয় কারণ তখন তো আমার বোন আমেনা ভেদভেদী ছিলনা।
“আমেনা আমার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পত্তি দখলের মামলা করেছে, আমি কারো সম্পত্তি জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করি নাই সেটা আমি আদালতে প্রমাণ করবো’’ বলেন ফয়েজ আহম্মদ।
তাদের কাগজ-পত্র দেখে জানা যায়, ২০০৩ সালে পিতা আহম্মদ কবির নিজের সম্পূর্ণ ৪২ শতক জমি মেঝপুত্র ফয়েজ আহম্মদ এর নামে দখলসত্ত্ব হস্তান্তর করেন। ফয়েজ আহম্মদ বাদে তার অন্যান্য ওয়ারিশদের কোন অংশীদারিত্ব ছিলনা। সম্পূর্ণ ৪২ শতক জমির একমাত্র মালিক ফয়েজ আহম্মদ। কিন্তু ২০০৭ সালে আহম্মদ কবির আবার জমির কাগজ ফয়েজ আহম্মদ এর কাছ থেকে নিয়ে ৩২ শতক জমি অন্যত্র বিক্রি করার জন্য প্রস্তাব করলে ফয়েজ আহম্মদ ঐ জমি ২ লক্ষ টাকা দিয়ে নিজের আপন পিতার কাছ থেকে ক্রয় করেন।
নিজের মা সালমা বেগমের করা আদালতের মাতৃনির্যাতনের মামলা সম্পর্কে ফয়েজ আহম্মদ সিএইচটি মিডিয়াকে বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ১৭ জুলাই ২০১৭ তারিখে আমার অনুপস্থিতিতে আমার মা, আমার বোন আমেনা এবং আমার ছোট ভাই সালেহ আহম্মদ আমার বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রী রহিমা বেগমকে মারধর করে আসার পর উল্টা মা আমাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। এর আগে পুলিশ তদন্ত করতে গেলে আমার মায়ের ভাড়াটিয়া জ্যোৎনা বড়ুয়া আমার সামনে স্বাক্ষী দিয়ে বলেছেন ফয়েজ আহম্মদ এর মা সালমা বেগম ও ছোট ভাই-বোন সালেহ আহম্মদ ও আমেনা বেগমের নির্যাতন থেকে সেদিন তিনি ফয়েজ আহম্মদ এর স্ত্রী রহিমা বেগমকে রক্ষা করেছেন। তাছাড়া মা সালমা বেগম তার ঘরে থাকেন না তার ঘরে জোৎনা বড়ুয়া ভাড়া থাকেন মা থাকেন মুসলিম পাড়ার বিদেশ কান্তি বড়ুয়ার বাসায়। এই মামলা সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলক বলেন ফয়েজ আহম্মদ। আদালত যাচাই-বাচাই এবং কোন ধরনের তদন্ত ছাড়া আবেগের বসত আমাদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
তিনি আরো বলেন, আমার মা আর বোনের মামলা আমাদের বিরুদ্ধে এটা নতুন নয় এর আগে ২০ জুলাই ২০১৬ তারিখে আমার বোন আমেনা রাঙামাটি কোতয়ালী থানায় অভিযোগ করেছে, ২৩ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে রাঙামাটি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আমার মা সালমা বেগম তার তিন ছেলে আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন এবং ৫ আগষ্ট ২০১৬ তারিখে রাঙামাটি কোতয়ালী থানায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন কিন্তু তদন্ত শেষে সবকটি অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। গত ৫ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে রাঙামাটি পৌরসভা মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীর উপস্থিতিতে বৈঠক হয় এতে আমরা দুই ভাই নূর মোহাম্মদ ও আমি (ফয়েজ) বাবা মাকে পরষ্পরের সাথে সমযোতা করার জোর আবেদন করি অথচ মা বাবাকে অস্বীকার করে সেদিন মা বলেছেন আমি তাদের (আহম্মদ কবির ও ছেলেদের) আশেপাশে নাই।
আমরা ছোটবেলা থেকে আমাদের মাকে পাইনি। মায়ের স্নেহ মমতা কি জিনিস আমরা ভাইরা উপলদ্ধি করতে পারিনাই। বাবার সাথে মা’র সুসম্পর্ক নেই আজ প্রায় ৩০ বছর। বাবা ছিলো সুবলং মা ছিল বাবার ঘর মুসলিম পাড়ায়, আমাদের ও আমাদের বাবাকে মা ঘরে জায়গা দেয় নাই। আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলাম অন্যর ঘরে।
২০১৪ সালে আমার মা বাবাকে এখন থেকে দেখাশোনা করবে কিন্তু স্বামী আহম্মদ কবির যে ঘরে রয়েছেন সে ঘরে থাকবেনা এবং ছেলেদের কাছাকাছি থাকতে চায় বলে আমাদের তিন ভাইকে বলেন যেন আলাদা করে ছোট একটি ঘর দেওয়া হয়, মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী বড় ভাই নূর আহাম্মদ এর কথায় বাবা আহম্মদ করিব দেড় শতক জায়গা মায়ের নামে দিয়ে মা ঘর তোলেন । সে থেকে যত সমস্যার সূত্রপাত।
হতাশ ফয়েজ আহম্মদ বলেন, বাবাও মা’র হাতে নির্যাতিত আমরা নিজের চোখে দেখে আসছি। সে সুযোগ নিয়ে এলাকার কিছু কুচক্রি মহলের ইন্দনে আমাদের বিরুদ্ধে মা’কে ব্যবহার করে আমাদের পরিবারে শান্তি বিনষ্ট তথা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে আমার বোন আমেনা ও তার স্বামী মাহবুব আলম। মা’কে মারধর করার মত এতবড় জঘন্য ঘটনা যদি করলে আশপাশের লোকজন কিছুটা হলেও জানতো অথচ মা নিরপেক্ষ কাউকে স্বাক্ষী না রেখে আমাদের ছোটভাই সালেহ আহম্মদ ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তারকে স্বাক্ষী রেখেছেন সে বিষয়টিও একটা বড় ধরনের চক্রান্ত বলেন ফয়েজ আহম্মদ। আদালতে মামলা দায়ের হওয়ার পরপর কোন তদন্ত না করে ছেলেদের দুই বউ জারিয়া বেগম ও রহিমা বেগম নামে সমন জারি এবং দুই ছেলে নুর আহাম্মদ ও ফয়েজ আহম্মদ এর নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়াটাও আবেগের সিদ্ধান্ত বলেন তিনি।
মা না-কি অভিযোগ করেছেন আমরা তার ভরনপোষন করিনা-কথাটিও মিথ্যা। আমরা মাকে বারবার বলি বাবা মৃত্যুশয্যায় নড়াচড়া করতে পারেননা, যে কোন দিন যে কোন সময়ে বাবা মারা যেতে পারেন, যেখানে খায় সেখানে মলত্যাগ করেন তাই এই বয়সে মা’কে বাবার বড় প্রয়োজন। আমাদেরও অর্থনৈতিক অবস্থা এত ভাল নয় কাজের মেয়ে রাখতে পারিনা তাই আমার স্ত্রী রহিমা বাবার পায়খানা প্রস্রাব ধোয়ামুছাসহ বাবার সমস্ত দেখাশোনা করে। অথচ বাবার স্ত্রীর কাজ ছেলের বউ করতেছে বলেন ফয়েজ আহম্মদ। মা তো আমাদের সাথে না থেকে অন্য কোথাও থাকে। আমরা চাই মা আমাদের সাথে থাক। অন্যদের ইন্দনে মা নিজের আপন জনদের দূরে ঠেলে দিচ্ছেন বলেন ফয়েজ আহম্মদ। ফয়েজ আহম্মদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সর্বশেষ বলেন সকল ঘটনার মূল ষড়যন্ত্রকারী আমার বোন আমেনা বেগম এবং তার স্বামী মাহবুব আলম।
এসব বিষয় নিয়ে ফয়েজ আহম্মদ এর মা সালমা বেগম বলেন, আমি কোন মিথ্যা বানোয়াট মামলা করিনাই। ঘটনা সত্য, আমার ছেলেদের এবং ছেলেদের বউদের মাতৃত্বের অপরাধ রয়েছে। মা হয়ে কেন ছেলে এবং ছেলের বৌদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিব। তাদের সংসারে অশান্তির জন্য তিনি বড় ছেলের স্ত্রী জারিয়া বেগমকে দায়ী করেন।
অন্যদিকে বোন আমেনা বেগম বলেন, আমার ভাইয়ে যদি পৈতিক ভিটায় বাড়ি নির্মান করে বসবাস করিতে পারে, আমি কেন আমার স্বামী - সন্তান নিয়ে বাপের ভিটায় থাকতে পারিবনা ? আমাকে এবং আমার ছেলে- মেয়েকে বেধড়ক ভাবে পিটিয়েছে আমার ২ ভাই ও তাদের স্ত্রীরা। রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র জনপ্রতিনিধি হিসাবে উভয়ের সাথে বৈঠক করে ঘরের জন্য ৪শতক জায়গা আমাকে দিতে রায় দিয়েছিলেন। সেই রায় পর্যন্ত তারা মানেনি। ভাই বলে কয়েকবার ক্ষমা করেছি। এবার আইনের আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বড় ছেলে নুর আহাম্মদের সাথে জেলখানায় দেখা করে জানতে চাইলে সে জানায় মা নিজে (সালমা বেগম) বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছে, আমি না-কি তাকে (মাকে) মেরেছি, মা যদি আমাকে জেলখানায় রাখতে চায়, তাহলে আমি (নুর আহাম্মদ) জেলখানায় থাকব। নুর আহাম্মদ আরো বলেন, আমি মায়ের গায়ে হাত দিয়েছি এই কথাটি আমার (সালমা বেগম) কোরানশরীফ শপথ করে বলুক, তাহলে আদালত যা শাস্তি দিবেন, আমি মাথা পেতে নিব। মা যখন তার নিজের ছেলেকে জেলখাটিয়ে সন্তুষ্ট আমিও মায়ের দোয়াতে ভালই আছি, প্রতিবেদক রাঙামাটি জেলগেইটে দেখা করতে গেলে কথা গুলো বলেছে আহমদ কবির ও সালমা বেগমের বড় ছেলে নুর আহাম্মদ।
উল্লেখ্য যে, মা সালমা বেগম দায়ের করা মামলায় বড় ছেলে নুর আহাম্মদ পুলিশের হাতে আটক হয়ে ২ সাপ্তাহ ধরে রাঙামাটি জেলা কারাগারে আছে।
তারপরও কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। এবিষয়টি স্থানীয় সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।