বুধবার ● ২৩ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » অপরাধ » রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল ৮মাস ধরে ঝুঁকিপূর্ণবস্থায় : ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল ৮মাস ধরে ঝুঁকিপূর্ণবস্থায় : ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: (৮ ভাদ্র ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৯.০০মি.) পাকিস্তান সরকারের আমলে চন্দ্রঘোনা থেকে তৎকালীন সাব ডিভিশন শহর রাঙামাটিতে স্থানান্তর করা হলে ১৯৭০ সালে ৫০ শয্যা হাসপাতাল গড়ে তোলা হয় বর্তমান সিভিল সার্জন কার্যালয় পুরাতন হাসাপাতাল।
এরপর ১৯৮৪ সালে বর্তমান রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল নির্মানকাজ শুরু করা হলে ১৯৮৭ সালে হাসপাতালের মূল ভববনের নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং বর্তমান স্থানে হাসপাতালটি স্থানান্তর করা হয় । এই হাসপাতালের উদ্ভোধন করেন তৎকালীন মেজর জেনারেল নূর উদ্দিন।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৫০ শয্যা হাসপাতালকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেয়। এঘোষণায় বৃদ্ধি পেয়েছে জনবল ও সরকারী সাহায্য। কিন্তু সম্প্রসারণ করা হয়নি মূল ভবন। তৎকালীন রাঙামাটি সদর হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে নাম হয় রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল।
৫০ শয্যার হাসপাতালের অবকাঠামো দিয়ে চলছে ১০০ শয্যার রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল। তারমধ্যে প্রকটভাবে দেখা দেয় রোগীদের কেবিন সমস্যা। একটি পুরুষ ও একটি মহিলা কেবিন নিয়ে শিশু ওয়ার্ডে ২০ শয্যা, মহিলা ওয়ার্ডে ২০ শয্যা, পুরুষ ওয়ার্ডে মেডিসিন ২০ শয্যা সার্জারী ২০ শয্যা মোট ৮২ শয্যা দিয়ে চলতে থাকে ১শ শয্যার হাসপাতাল। ২০০৬ সালে গাইনী (প্রসূতি) ওয়ার্ডে ৮ শয্যা ও সংক্রমন ওয়ার্ড ১০ শয্যা যুক্ত করে পূর্ণতা পায় ১শ শয্যা হাসপাতালে।
এর মধ্যে ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ইউএনডিপি রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের মূল ভবন, নার্সিং ডরমিটরি(আন্টাগার), ডাক্তার কোয়ার্টার, কর্মচারীদের ২টি কোয়াটারসহ ভবন সমূহ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষনা করে। হাসপাতালের তত্বাবধানে থাকা রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এ বিষয়ে যথাযত পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসেনি ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
২০১৬ সালে রাঙামাটি গণপূর্ত বিভাগ ৫টি স্থাপনা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে তারমধ্যে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল অন্যতম। রাঙামাটি জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ রোগীদের কেবিন সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে ২০১৬ সালের শেষের দিকে কোন ধরনের কারিগরী প্রতিবেদন বা বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়া হাসপাতালের দ্বিতল ভবনের মহিলা ও শিশু ওয়ার্ডের উপর আরেকটি ভবন সম্প্রসারন করার উদ্যোগ নেয়। এ কাজের ঠিকাদার হিসেবে স্থানীয় বি.আলম ট্রেডার্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে জানা যায়।
২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারিত অংশে ছাদ ঢালাই দিলে অতিরিক্ত ভারের কারণে ভবনটির কলাম ও বিম এর বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দেয়। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে দোতলায় বন্ধ করে দেয় শিশু ও মহিলা ওয়ার্ড, নীচতলায় ৬নং কক্ষ ইপিআই শাখা, ৭ নং কক্ষ রোগী কল্যাণ সমিতি, ৮ নং কক্ষ ডেন্টাল সার্জন, ৫নং কক্ষ প্যাথলজি বিভাগ, ৪ নং কক্ষ আইএসসিআই ও পুষ্টি কর্ণার, ৯ নং কক্ষ কনসালটেন্ট নাক, কান, গলা ১০ নং কক্ষে মেডিক্যাল অফিসার , ১১ নং কক্ষ আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ১ নং কক্ষ হাসপাতাল তত্বাবধায়ক এবং ১২ নং কক্ষ কনসালটেন্ট শিশুসহ মোট ১২ টি কক্ষ বন্ধ করে দেয়। শিশু ও মহিলা ওয়ার্ডের রোগীদের স্থানান্থর করা হয় সোয়াইন ফ্লু’র জন্য নির্মিত একতলা ছোট্ট একটি ঘরে, যার মেঝেতে রোগীদের ঠাসাঠাসি করে রাখা হচ্ছে। এতে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা অধিক অসুস্থ হয়ে পরছে। দীর্ঘ ৮মাস ধরে হাসপাতাল ঝুকিপূর্ণ ও রোগীদের মানবিক বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোন ধরনের মাথাব্যাথা নেই।
বিষয়টি নিয়ে ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে বিদায়ী রাঙামাটির ৩৩তম জেলা সিভিল সার্জন ও রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের সাবেক তত্বাবধায়ক ডা. স্নেহ কান্তি চাকমার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিএইচটি মিডিয়াকে জানান, হাসপাতালের ছাদে কাজের সম্প্রসারণ অংশের জন্য রাঙামাটি গণপূর্ত বিভাগের মতামত নেয়া হয়েছিল, যার কপি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয়ের নিকট রয়েছে।
কিন্তু এই নির্মাণ কাজে কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে বা সম্ভাব্য বাজেট সম্পর্কে সাবেক এই তত্বাবধায়ক ডা. স্নেহ কান্তি চাকমা কিছুই জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তারিখে ৩৫তম রাঙামাটি জেলা সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের প্রকল্প পরিচালক ডা. শহীদ তালুকদার।
দীর্ঘ ৮ মাস ধরে হাসপাতাল ঝুকিপূর্ণ ও রোগীদের মানবিক বিষয়টি নিয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. শহীদ তালুকদারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি সিএইচটি মিডিয়াকে বলেন, শিশু ও মহিলা ওয়ার্ড এর রোগীদের বিভিন্ন স্থানে রেখে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ কোথায় ? আমি তো দেখিনা, প্রতিদিন সকালে তত্বাবধায়ক কক্ষে বসে হাসপাতালের অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা করি। আমি দায়িত্বভার নেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিব বরাবর কয়েকটি চিঠি পাঠিয়েছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো কোন উদ্যোগ নেয়নি। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বা চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দিয়ে হাসপাতাল ঝুঁকিপূর্ণ কিনা খতিয়ে দেখানোর বিষয়ে তিনি বলেন, বুয়েট বা চুয়েট এর বিশেষজ্ঞদের দেখানো উচিৎ কিন্তু এক্ষেত্রে রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমার উদ্যোগ প্রয়োজন, আমি একা পারবোনা।
ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালের উপরে হাসপাতাল সম্প্রসারনের সম্ভাব্য বাজেট এবং ভবন সম্প্রসারন প্রকল্প ব্যয় বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এবিষয়ে তিনি রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী আবদুস সামাদ ও স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য মুছা মাতব্বর এর সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
দীর্ঘ ৮ মাস ধরে হাসপাতাল ঝুকিপূর্ণ এবং হাসপাতালের সম্প্রসারনে যথাযথ নিয়ম অনুসরন করা হয়েছে কিনা জানতে রাঙামাটি গণপূর্ত বিভাগের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী জহির রায়হানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিএইচটি মিডিয়াকে জানান, রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে দোতলা ভবনের উপর ৩য়তলা নির্মাণের গণপূর্ত বিভাগ থেকে কোন ধরনের কারিগরী প্রতিবেদন জেলা পরিষদের কাছে দেওয়া হয়নি, গণপূর্ত বিভাগ এই ধরনের কারিগরী প্রতিবেদন দিয়ে থাকলে দেখাতে বলুন, তবে মৌখিকভাবে আমরা রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের ছাদে তৃতীয় তলায় বড়জোর টিনশেড ঘর নির্মাণ করার পরামর্শ দিয়েছি, ভবন সম্প্রসারন করা যাবেনা বলে জেলা পরিষদকে জানানো হয়েছিলো। তিনি আরো বলেন, তবে আমাদের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির আহাম্মদকে দিয়ে রাঙামাটি জেলা পরিষদ একটি কমিটি গঠন করেছে।
তবে সরকার ইতোমধ্যে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল ১শত শয্যা থেকে ২৫০ শয্যা উন্নীত করে ৭ তলা ভবন নির্মাণ করার জন্য গণপূর্ত বিভাগকে প্রথম কিস্তি হিসেবে ২০ কোটি টাকা প্রদানের তথ্যটি নিশ্চিত করেন রাঙামাটি গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জহির রায়হান ।
অপরদিকে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের জরাজীর্ণ মূল ভবনটির দোতলার উপরে তৃতীয় তলা নির্মাণ করাটা নির্মাণ কাজের নিয়ম বহির্ভুত কাজ। যে কোন সময় ভবনের উপরের অংশে ছাদ ঢালায়ের পর আড়াই থেকে তিন ফুট কলামের রড বর্ধিত রাখার নিয়ম থাকলেও রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের ছাদটি জলছাদ দিয়ে সম্পন্ন করা হয়, রডের কোন বর্ধিত অংশ রাখা ছিলনা। কিন্তু রাঙামাটি জেলা পরিষদ প্রকৌশল বিভাগ ছাদ ভেঙ্গে রড বের করে কলাম ও বিম নির্মাণ করেছে । যার কারণে ভবনের কলাম ও বিম ফেটে গেছে। রাঙামাটি জেলা পরিষদ ও হাসপাতার কর্তৃপক্ষ আস্তর করে সে ফাটল ধরা অংশ ঢেকে দিয়েছে। বর্তমানে ভবনের ছাদে ইট, বালি, রড, খোয়া ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাখার ফলে ছাদ ভারী হওয়ায় ধ্বসে পরার আশংকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধ্বসে পরার আতংক নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসতে হচ্ছে রোগীদের। দুর্ভাগ্যবশত ধ্বসে গেলে প্রাণহানীর আশংকা শতভাগ।
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের সম্পসারণ কাজ গণপূর্ত বিভাগকে পাশ কাটিয়ে করা হয়েছে বলে গণপূর্ত বিভাগের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়।
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল সরকারের কোটি টাকার সম্পদ, কাদের সিদ্ধান্তহীনতায় হুমকির মুখে পড়েছে ? স্থানীয় জনসাধারনের জানার কৌতহল। ক্ষমতার দাপটে কি সব অধরাই থেকে যাবে ? এমনই প্রশ্ন ভোক্তভোগীদের মনে।
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএইচটি মিডিয়াকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগিরা সীমাহীন দুর্ভোগে রয়েছে। তাছাড়া চিকিৎসকরা পড়েছে ঝামেলায়, একবার নীচে আর কখনো ওপরে এরকম দৌড়ঝাপ করতে গিয়ে সময় নষ্ট হচ্ছে বেশী। তাছাড়া যে কোন সময়ে হাসপাতাল ঝুকিপূর্ণ ভবণ ধ্বসে পড়ার ভয় কর্মচারীদের মনে। এতে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে স্বীকার করেন এই চিকিৎসক।
দীর্ঘ ৮ মাস ধরে হাসপাতাল ঝুকিপূর্ণ এবং হাসপাতাল সম্প্রসারনে যথাযথ নিয়ম অনুসরন করা হয়েছে কিনা এবং রোগীদের দুর্ভোগের বিষয়টি লাঘবে বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেযা হয়েছে কিনা জানতে সিএইচটি মিডিয়ার পক্ষ থেকে রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা মুঠোফোন-০১৮৪৩০৩১৯৮৯,নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী আবদুস সামাদ মুঠোফোন ০১৭৫১৮৮৮৯৯০ ও জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য মুছা মাতব্বর মুঠোফোন ০১৮১৫৯৫৭৭৮৭ কল দিয়ে যোগাযোগ করার একাধিকবার চেষ্টা করা পর কেউ ফোন রিসিভ না করায় সরাসরি বিষয়টি জানতে গত ২২ আগষ্ট মঙ্গলবার রাঙামাটি জেলা জেলা পরিষদ কার্যালয়ে দুপুর সাড়ে ১২টায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা এবং নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী আবদুস সামাদ ঢাকায় অবস্থান করছেন আর জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য মুছা মাতব্বর অফিসে আসেননি বলে কর্মচারীরা জানান।
ফলে বিষয়টি নিয়ে রাঙামাটি জেলা পরিষদের কোন মতামত পাওয়া যায়নি।
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের চারপাশ ঘুরে দেখা গেছে, অস্থায়ীভাবে তৈরী সিড়ি সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং মুল ভবনে সিড়ি বেয়ে উপরে ৩য় তলায় যাওয়ার রাস্তাটি হাসপাতালের পুরান আসবাবপত্র রেখে যাতায়তের রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।