সোমবার ● ২৮ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » ‘অপবাদ’ সামাজিক সুস্থতাকে বিনষ্ট করে এবং ন্যায়বিচার ধ্বংস করে
‘অপবাদ’ সামাজিক সুস্থতাকে বিনষ্ট করে এবং ন্যায়বিচার ধ্বংস করে
নজরুল ইসলাম তোফা :: পাখি যখন জীবিত থাকে, পিঁপড়েকে তখন খায়, আর পাখি যখন মরে যায়, তখন পিঁপড়ে পাখিকে খায়। সময় আর পরিস্হিতি যেকোনো সময় বদলাতে পারে, জীবনে কখনো কাউকে দুঃখী আর অপমানিত করবেন না, আজ হয়তো আপনি শক্তিশালী, কিন্তু মনে রাখতে হবে, সময় আপনার চেয়ে অনেক শক্তিশালী। এক বৃক্ষ থেকে লক্ষ লক্ষ দিয়াশলাই কাঠি তৈরী হয়। আবার লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ জালানোর জন্য সামান্য একটি দিয়াশলাই কাঠিই যথেষ্ট। তাই গুরুত্বের সহিত বলতে হয়, অন্যকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে অহেতুক ছোট করা মোটেও ঠিক নয়। সামন্য অপবাদে অন্যের ক্ষতিকারক দিক বৃহৎ হবে পারে, পক্ষান্তরে আপনার যে ক্ষতি হবে না তার গ্যারান্টি কোথাই। একটু আলোচনায় যাওয়া উচিৎ বলে মনে করি। যে ব্যক্তি অন্যকে অপবাদ দেয় সে অন্যের ক্ষতি করার পাশাপাশি নিজেরও ক্ষতি করে থাকেন। নিজের আত্মাকে পাপের মাধ্যমে কলুষিত করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, অপবাদ কি? কোন ব্যক্তির দোষ বা ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও তাকে হয়তো দোষী সাব্যস্ত করাটাকেই অপবাদ বলা হয়ে থাকে। অবশ্যই জানা মতে বলা যায়, কাউকে অপবাদ দেয়া কবিরা বা মারাত্মক গোনাহ হিসেবে গণ্য। পবিত্র কোরআনে কাউকে অপবাদ দেয়া থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশ রয়েছে, আবার তাকে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে বলেও উল্লেখ করা আছে। ‘একজন নিরপরাধকে অপবাদ দেয়া পাপ, সেতো বড় বড় পাহাড়গুলোর চেয়েও বেশি ভারী’ বলেছেন, ইমাম জাফর সাদেক (আ.) তাই অপবাদ বা কুৎসা রটনা হলো সবচেয়ে বড় ধরনের মিথ্যাচার। এটা যদি ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে করা হয় তাহলে তা গীবত হিসেবেও বিবেচিত হবে। অর্থাৎ অপবাদ দেয়ার জন্য একজন মানুষ প্রকৃত পক্ষে দুই ধরনের পাপ কাজে জড়িয়ে পড়েন।
‘অপবাদ’ সামাজিক সুস্থতাকে বিনষ্ট করে এবং ন্যায়বিচার ধ্বংস করে। সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য হিসেবে মানুষ কোন কারণ ছাড়াই অপবাদ দাঁড় করিয়ে অপরাধী সাজানোর প্ররনতা রয়েছ। হয়তো সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য না করার জন্য একজন মানুষের কোনই ক্ষতি হয় না। তবুও বলা চলে এই প্রবনতা মানুষের সহজাত সৃষ্টিকারী এক ঘৃন্য কৌশল। অপবাদ দেয়ার জন্য, কিছু নিকৃষ্ট মানুষ দিনে দিনে নিজে নিজেরই মান সম্মান ও ব্যক্তিত্বকে ক্ষতিগ্রস্তের দিকে পৌঁছায় তা সহজেই তিনি টের পান না। সমাজে অপবাদ দেয়ার রীতি যখন বিভিন্ন আড্ডায়, অফিস-আদালতে, কোর্ট-কাচারিতে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তথা রাজনিতীর ময়দানে শুরু হয়। তখন তা সাদরে অনেরা মেনেও নেয় এবং অপবাদকে বিশ্বাস করে তখন মিথ্যাটাও সত্যের বেশ ধারণ করে সামনে চলে আসে। ফলে সমাজে অনাস্থা,অবিশ্বাস এবং বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যে কেউ কারো বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে এবং যাকে তাকে অপবাদ দেয়ার সাহসও পায়।
ফলে সমাজে বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতার পরিবর্তে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার স্থান দখল করে নেয়। কে কখন অপবাদের শিকার হয় তা নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অপবাদের মারাত্বক কুপ্রভাব রয়েছে। ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন, যখনই কোন ব্যক্তি কোন মুমিনকে অপবাদ দেয় তখন তার ঈমান নষ্ট হয়ে যায় যেমনিভাবে লবন পানিতে গলে যায়।
যে অপবাদ দেয় তার ঈমান নষ্ট হবার কারণ হলো ঈমান সততা ও সত্যবাদিতার সঙ্গে পথ চলে এবং অপবাদের অর্থ হলো অন্যের বিষয়ে মিথ্যা বলা। সুতরাং যে ব্যক্তি অন্যের বিষয়ে মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে সত্যের পথে থাকতে পারে না। এভাবেই অপবাদ দানকারী ব্যক্তির ঈমান আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যায়। হৃদয়ে ঈমানের আলোর আর কোন অস্তিত্ব থাকে না এবং তার চূড়ান্ত স্থান হলো দোজখ বা নরক। আর ইহজগতে অপবাদ কারিকে ভালো মানুষ খুব সহজেই চিনে ফেলে। তাদের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার কবর খনন তিনি নিজ হস্তেই করেন। কারণ, অপবাকারীকে ভালো মানুষ কাছে ভিড়ার কোন প্রকার সুযোগ দেন না।
এ সম্পর্কে নবীজি মোঃ (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মুমিন নারী বা পুরুষকে অপবাদ দেবে তাকে পরকালে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। অপবাদ দুই ধরনের। এক ধরনের অপবাদ হলো, ব্যক্তিটি দোষী নয় এটা জেনেও তাকে কোন কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা বা নিজে অন্যায় করে তা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সে ব্যাপারে কুৎসা রটনা করা।
আরেক ধরনের অপবাদ হলো, অজ্ঞতা ও সন্দেহের বশে কাউকে কোন দোষের জন্য দায়ী করা। অন্যের বিষয়ে খারাপ দৃষ্টিভঙ্গী পোষণের প্রবণতা থেকেই এ ধরনের অপবাদের সূত্রপাত। অজ্ঞতা ও সন্দেহের বশে অপবাদ দেয়ার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি ঘটে। এ কারণেই পবিত্র কোরআনের সূরা হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক বিষয়ে সন্দেহ বা ধারণা করা থেকে বিরত থাক কারণ কোন কোন ধারণা বা সন্দেহ গোনাহ।’ কাজেই সন্দেহের বশে কারো বিরুদ্ধে কোন দোষ চাপিয়ে দেয়া অপরাধ।
সূরা ইসরাঈলের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই বা বুঝার ক্ষমতা নেই, সেটার পেছনে যেও না। ধারণা বা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অহেতুক বানোয়াট কথা উপস্হাপন করে অপুরণীয় ক্ষতি বয়ে আনতে পারো না। মনো বিজ্ঞানীদের মতে বললে বলা যায়, অনেকেই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে হত্যা করেছে। এমন অপবাদকে গবেষনায় পর্যালোচনা করে পাওয়া গেছে, হত্যাকারীর যে বিষয়ে সন্দেহ তা মোটেও সত্য নয়।
এখন আমরা দেখবো কোন অপবাদের কথা শোনার পর আমাদের করণীয় সম্পর্কে। সূরা হুজরাতের ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন খরব আনে তাহলে তা পরীক্ষা করে দেখবে,যাতে অজ্ঞতাবশত: তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও। অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ হলো, আমরা যখন কারো ব্যাপারে কোন কথা বা অপবাদ শুনব তখন নিজ দায়িত্ব হলো প্রথমে তা পরীক্ষা করে এর সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া। কোন বিষয়ে তাৎক্ষণিক এবং প্রমাণ ও তদন্তবিহীন মূল্যায়ন নিষিদ্ধ।
ইসলাম অপবাদকে হারাম ঘোষণা করেছে এবং মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছে যাতে একে অপরের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ না করা হয়। অকাট্য প্রমাণ ছাড়া কাউকে কোন কিছুর জন্য দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। পাশাপাশি এদিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে যে, কেউ যাতে অপবাদ দিতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তবে মানুষের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাখ্যার মাধ্যমে সন্দেহ সৃষ্টির আশংকা দূর করতে হবে। এ কারণেই ইসলামে পাপাচারীদের সঙ্গ ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। কারণ পাপাচারীদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে মানুষের মনে মুমিনদের বিষয়েও সন্দেহের জন্ম হতে পারে এবং পরিণতিতে অপবাদ দিতে পারে।
নজরুল ইসলাম তোফার শেষকথা, যদি অপবাদ বিষয়টিকে সর্বদাই গুরুত্বের আসনে বসাতেই চাই, তাহলে অপবাদ দিতে দিতে দিনে পর দিন অন্যের ক্ষতির পাশাপাশি নিজের ক্ষতিটাও মেনে নিতে হবে। আধ্যাত্বিক দিক থেকেও অপুরণীয় ক্ষতি হয় বলে গবেষকদের ধারনা। সুতরাং এ ধরনের বড় পাপ কাজ থেকে বিরত থেকে বরং বিতর্কহীন, অবাধ ও সুষ্ঠু জীবনে আশায় আত্ত্ব উন্নয়নের পথে থাকা বাঞ্ছনীয়।