শনিবার ● ২ সেপ্টেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » কক্সবাজার » রোহিঙ্গাদের স্বজন হারানো আর্তনাতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে
রোহিঙ্গাদের স্বজন হারানো আর্তনাতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে
বিশেষ প্রতিবেদন, লামা (বান্দরবান) প্রতিনিধি :: (১৮ ভাদ্র ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.৩১মি.) ২ সেপ্টেম্বর শনিবার বাংলাদেশ মিয়ানমার সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পবিত্র ঈদুল আযহা ও কোরবান। কিন্তু প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিমদের সেই ধর্মীয় অধিকার টুকুও নেই। পক্ষন্তরে রাখাইনের উদ্ভুত পরিস্থিতি গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয়া ও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হওয়া হাজার হাজার আশ্রয় প্রার্থী রোহিঙ্গাদের মাঝে স্বজন হারানোর আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে।
বৃস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উখিয়ার কুতুপালং বালুখালী রোহিঙ্গা শিবির ও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা গেছে আশ্রয় নেয়া ও আশ্রয় প্রার্থী রোহিঙ্গাদের করুণ আর্তনাদ। সীমান্তের নানা এলাকায় আশ্রিত ও আশ্রয় প্রার্থী অনেক রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলতে গেলে তাহারা সি এইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিকে জানায় ঈদের আনন্দ ও কোরবানি করার মত পরিবেশ তাদের নেই। তারপরও কেউ কেউ সাথে গরু, ছাগল নিয়ে এসেছে তারা হয়ত কোরবানী করতে পারে। একেত সর্বস্ব হারিয়ে উদ্বাস্ত হয়ে আসা, তার উপর গতকাল সকাল থেকে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হওয়ায় সর্বত্র রোহিঙ্গাদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে দেখা গেছে। অনেকে গায়ের পড়নের এক কাপড়ে কোন রকমে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছে। অনেক পরিবারের থাকা ও খাওয়ার কোন ব্যবস্থা হয়নি এখনো। রান্না করে খাবে সে ব্যবস্থাও অনেকের নেই। আশ্রয় নেয়া ও আশ্রয় প্রার্থীদের অধিকাংশ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ হওয়ায় তারা পড়েছে নানা বিপাকে। পূর্ব থেকে যাদের আত্মীয় স্বজন বা চেনা পরিচিত প্রতিবেশী রয়েছে এধরনের প্রায় রোহিঙ্গারা আসা রোহিঙ্গাদের খোজ খবর নিয়ে সাথে নিয়ে গিয়ে সাময়িক আশ্রয় দিচ্ছে। আবার অনেকের পরিচিত থাকলেও কেউ খবর নিচ্ছে না বলে জানা গেছে।সবচেয়ে বেশী বিপাকে পড়ছে যাহারা ছোট ছোট বাচ্ছা নিয়ে এসেছেন। জীবনের উপর ঝুকি নিয়ে নানান প্রতিকুলতার মধ্যেও তাদের বাঁচার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে।
বালুখালী বি-১ ব্লকে পূর্বের আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মো. ইকবাল (৩৪) সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিকে জানান, বুধবার সন্ধ্যায় রাখাইনের ফকিরাবাজার এলাকা থেকে তার ফুফু জরিনা খাতুন (৫০) ও তার তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে এখানে এসেছে। তাদেরকে আমার ঘরে থাকতে দিয়েছি। দেশে ফুফুত ভাই ও অন্যান্যরা এখনো রয়ে গেছে। জানিনা তাদের কি অবস্থা হয়েছে। বালুখালী শিবিরে প্রবেশ পথে রাখাইনের কুমির খালী থেকে আসা আয়েশা খাতুন (৩২) জানালেন, স্বামী ছৈয়দুল আমিন কোথায় গেছে আদৌ বেঁচে আছে কিনা জানিনা। চার ছেলে মেয়ের মধ্যে ১২ বছরের ছেলে ইব্রাহিমকে আসার সময় খোজে না পাওয়ায় আনা যায়নি। জানেনা ছেলেটি কোথায় কি ভাবে আছে। কুতুপালং অনিবন্ধিত প্রবেশ মুখে আমতলায় মিয়ানমারের রাখাইনের বলি বাজার থেকে আসা দিল মোহাম্মদ (৫০) জানালেন, দেশে আর্মি ও মগদের নির্যাতনের করুন কাহিনী। তিনি জানান তার তিন ছেলে চার মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে ও তিন মেয়ে বিবাহিত। অবিবাহিত কিশোরী নুর বাহার ও দুই পুত্রবধু ও চার নাতিকে নিয়ে হোয়াইক্যং লাম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে ভোরে পৌছে এখানে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেছে। দিল মোহাম্মদের স্ত্রী ফয়েজা খাতুন ও দুই পুত্রবধু ছেলে ও স্বামী হারানোর বেদনায় ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
কুতুপালং নিবন্ধিত শিবিরের সি-ব্লকে নুরুল বশরের ঘরে দেখা গেছে নতুন আশ্রয় নেয়া ৫জনকে। এদের মধ্যে নুরুল বশরের ভাবি ছমুদা খাতুন (৩২) ও চার ছেলে মেয়ে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা তাদের বাপ কোথায় আছে আদৌ তাদের কাছে আসতে পারবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ছমুদা খাতুনও স্বামী, সংসারের সব কিছু হারিয়ে প্রায় নির্বাক হয়ে গেছে। আসলেই এসব সর্বস্ব হারানো রোহিঙ্গাদের মাঝে কোন ধরনের স্বস্তি বা আনন্দ থাকার কথা নয়। এসব রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ নারি ও শিশু। তারা জানেনা তাদের স্বামী, পিতা বা পুত্রও স্বজনরা দেশে আদৌ বেঁচে আছে কিনা। বেঁচে থাকলে হয়ত একদিন দেখা মিলবে। কিন্তু তাদের আশঙ্কা ও উদ্বেগ যদি বেঁচে না থাকে তাহলে তাদের কিভাবে দাফন কাফন হয়েছে বা জানাযা হয়েছে কিনা। কোথায় কবরস্থ করা হয়েছে তাও তারা জানেনা। এত নিকট আত্মীয় স্বজন, পিতা পুত্র বা ছেলে বা ভাইদের কবর পর্যন্ত কি তারা দেখতে পাবে না। কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ নুর প্রতিবেদককে জানালেন এ অবস্থায় যাদের সারাদিন মিলে এক বেলা খাবারও জুটছে না তাদের মাঝে ঈদের আনন্দ বা কোরবানির কোন কিছু অবশিষ্ট থাকে বলে মনে হয় না।