বৃহস্পতিবার ● ৫ অক্টোবর ২০১৭
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » সাবধানে চালাবো গাড়ী, নিরাপদে ফিরবো বাড়ী
সাবধানে চালাবো গাড়ী, নিরাপদে ফিরবো বাড়ী
লায়ন মো. গনি মিয়া বাবুল :: ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ সাবধানে চালাবো গাড়ী, নিরাপদে ফিরবো বাড়ী ’। এ বছরই সরকারিভাবে দিবসটি রাজধানীসহ প্রতিটি জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের দাবিতে সোচ্চার নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবরকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের দাবি উত্থাপন করা হয় এবং প্রতি বছর সংগঠনের তরফ থেকে এই দিনটিকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালন করা হতে থাকে। নিসচার দাবীর প্রেক্ষিতে এই বছর ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রী সভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহন ও অনুমোদন করা হয়। ফলে এ বছর সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি নিসচাসহ বিভিন্ন সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহন করেছে।
উল্লেখ্য যে, নিসচা দিবসটি উপলক্ষে মাসব্যাপি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সেমিনার, আলোচনা , র্যালি, নিরাপদ নামে স্মরণিকা, পোষ্টার ও লিফলেট প্রকাশ ও বিতরণ প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
উল্লেখ্য যে, দেশব্যাপী ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে ১৯৯৩ সালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) নামে একটি সংগঠন। সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠিত নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) তার কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনে ধন্য হয়ে ওঠে। নিরাপদ সড়ক চাই তার প্রতিষ্ঠার এই ২৪ বছরের মধ্যে জনকল্যাণমুখী সংগঠন হিসাবে তার ব্যাপক কর্মতৎপরতায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পেয়ে গেছে যথেষ্ট পরিচিতি। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এখন একটি সফল সামাজিক আন্দোলনের নাম। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। স্ত্রী বিয়োগের শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে নিসচার কার্যক্রম বর্তমানে সর্বস্তরে প্রশংসিত হচ্ছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, এরও আগে ১৯৮৮ সালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন স্বয়ং মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। নিজের জীবনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এবং স্ত্রী বিয়োগের বেদনার বাস্তবতা, তারকা নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে উদ্বুদ্ধ করে, সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত পঙ্গু মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শীর্ষক এক পদযাত্রায় সামিল হন তিনি। সে দিনের সেই পদযাত্রা এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে সাংগঠনিক পর্যায়ে রূপদানের পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন দেশের সাংবাদিক সমাজসহ বিশিষ্টজনেরা। ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শীর্ষক প্রথম পদযাত্রায় বিভিন্ন সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণই তাকে এই আন্দোলনে ব্যাপক উৎসাহ যোগায়। প্রথম পথযাত্রা শেষে জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মুখে বিশাল জনসমাবেশে ইলিয়াস কাঞ্চন চালক- মালিক-যাত্রী তথা জনসাধারণের এবং সরকারের উদ্দেশ্যে ২২ দফা সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করেন।
সড়কের মড়ক থেকে জাতিকে উদ্ধারের জন্য চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ঢাকায় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শীর্ষক পদযাত্রা করেই ক্ষান্ত হলেন না; তিনি তার দাবি নিয়ে ছুটে বেড়াতে থাকলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আয়োজন করতে থাকলেন পথযাত্রার। তুলে ধরতে থাকলেন তার দাবিসমূহ। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন তার নিরাপদ সড়ক চাই দাবিকে সংগঠনে রূপান্তরিত করলেন। ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর এফডিসি থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত পদযাত্রার মধ্যদিয়ে যে আন্দোলনের যাত্রা শুরু সাংগঠনিক রূপ পাবার আগেই সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। শুধু ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ পদযাত্রাই নয়, পদযাত্রার শুরুতে অথবা শেষে সমাবেশে ২২ দফা প্রস্তাব উত্থাপন, সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে নিরাপদ সড়কের দাবিতে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা সবকিছু মিলিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন এবং তার নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন তথা নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠন সামাজিক সংগঠন হিসাবে পেতে থাকে দৃঢ়ভিত্তি।
সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি আন্দোলনের প্রথম দিকেই তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, যোগাযোগমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সবার কাছে স্মারকপত্র প্রদান করা হয়।
এছাড়া প্রতিবছর নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে, মরহুমা জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুবার্ষিকীতে এবং বিভিন্ন সময়ে সেমিনার, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস, জনমত সৃষ্টি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।
জাতীয় পর্যায়ে নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের দাবি উত্থাপনের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের উদ্যোগ নেবার জন্য জাতিসংঘের কাছে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই বিষয়ে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস পালনে নিমিত্তে ২০০৪ সালের ৭ এপ্রিল এক সভার আয়োজন করে এবং সেই সভাতে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৬ সাল থেকে ‘‘২২ হতে ২৯ এপ্রিল’’ নিরাপদ সড়ক সপ্তাহ প্রতিবছর পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ২০১০ থেকে ২০২০ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা শতকরা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনা। জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর এসব সাফল্য সড়ক সন্ত্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর উদ্যোগ এবং কর্মৎপরতাকে আরও উৎসাহ যোগায়। ২২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসাবে পালনের ঘোষণা হলে নিসচার আন্দোলন সার্থক হবে বলে বিজ্ঞমহল মনে করেন। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর পক্ষ থেকে পদযাত্রা, সাংবাদিক সম্মেলন, সেমিনার, আলোচনা সভা, জনসভার মতো কর্মসূচির পাশাপাশি দাবি বাস্তবায়নে স্মারকপত্র পেশ করা হয়েছে যেমনি, তেমনি আবার সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-এর প্রয়োজনীয় অবস্থানে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা রয়েছে। এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের আইনী সহায়তা প্রদান, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের আইনের হাতে সোপর্দ করা ইত্যাদি বিষয়ে সাংগঠনিকভাবে তৎপরতা চালানোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, নিসচার উদ্যোগে এস এস সি পাস বেকার যুবকদের দক্ষ চালক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে “ নিসচা ড্রাইভিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। এই ইনস্টিটিউটে বিনামূল্যে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বেকার যুবক এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দক্ষ চালকে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের শুরু সাংগঠনিক রূপ দেবার পরে কেন্দ্রীয় সংগঠনের পাশাপাশি সারাদেশে গড়ে উঠেছে এর অসংখ্য শাখা সংগঠন। ২৪ বছরে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনায় প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় হলেও এর সামান্যতম অংশই বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত অনুদান থেকে এসেছে। বৃহদাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে আন্দোলনের জন্মদাতা নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনের ব্যক্তিগত অনুদান থেকে।
বর্তমান পর্যায়ে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর কার্যক্রম যেমন সাফল্যের মুখ দেখেছে, তেমনি সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর কার্যক্রম আরও প্রসারিত ও গতিশীল করে তোলার বিষয়টিও হয়ে উঠছে জরুরি। সঙ্গত কারণেই আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টিও হয়ে উঠছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কার্যক্রম পরিচালনায় আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে নিসচা সমাজকল্যাণ অধিদফতর ও এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন পেয়েছে। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে সড়কের সন্ত্রাস থেকে মুক্ত হোক আমাদের স্বদেশ। মুক্ত হোক সারা পৃথিবী। সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ চাই। চাই সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত পৃথিবী।
লেখক : লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল
(কলাম লেখক, সমাজ সেবক ও সংগঠক),
যুগ্ম মহাসচিব নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কেন্দ্রীয় কমিটি,
৭০ কাকরাইল- ঢাকা।