সোমবার ● ১৩ নভেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » কৃষি » সম্ভাবনার দুয়ারে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর মিশ্র ফলজ চাষ প্রকল্প
সম্ভাবনার দুয়ারে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর মিশ্র ফলজ চাষ প্রকল্প
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: (২৯ কার্তিক ১৪২৪ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় রাত ৮.৪৯মি.) পার্বত্য অঞ্চলের মৌসুমৗ ফলের গুনগত মান ও বাম্পার উৎপাদনে সুনাম রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাপী। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশের কারণে যেকোন ফসলই ফলে নিঃসন্দেহে। এখানকার আম, লিচু, কমলা, মাল্টা, কাঠাল, আনারসসহ সব ধরনের ফল অত্যন্ত সুমিষ্ট এবং ফলন হয় বেশী। অন্যদিকে পার্বত্য অঞ্চলের মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতার কারণে কম বিনিয়োগ করে অধিক লাভ করা সম্ভব। পার্বত্য অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক কৃষকদের আর্থ কর্মসংস্থান, কমলা ও মিশ্র ফলের বাগান সৃজনের মাধ্যমে ১২৫০ পরিবারকে স্বাবলম্বী করা এবং পাহাড়ে প্রচলিত জুম চাষের বিকল্প হিসাবে পাহাড়ী ভূমিতে স্থায়ী ফল বাগান করার লক্ষ্যে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান,আবহাওয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ২০০০ সালে উদ্যোগ নেয় কমলা ও মিশ্র ফসল চাষ প্রকল্প।পরে দ্বিতীয় ধাপে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলার এ পর্যন্ত ৮২০ পরিবার প্রান্তিক কৃষক এ প্রকল্পের আওতায় কমলা, মাল্টা, আম,লিচু ইত্যাদি মিশ্র ফসল চাষ করছেন।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ১৬০ পরিবার ৪৮০ একর জমিতে, বান্দরবানে ৫৪৫ পরিবার ১৬৩৫ একর জমিতে এবং রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় ১৪৫ পরিবার ৩৪৫ একর জমিতে মোট ৮২০ পরিবার ২৪৬৫একর জমিতে মিশ্র ফসল চাষ হচ্ছে। এরমধ্যে মিশ্র ফসল চাষীরা এর মধ্যে লাভের মুখও দেখা শুরু করেছেন। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর এই প্রকল্পের আওতায় থাকা মিশ্র ফলজ বাগান মালিকরা শুধুমাত্র নিজেদের পতিত ভূমি ব্যবহার করছেন। বাগানের ফলজ চারা, সার এবং আধুনিক উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ও প্রক্ষিণের ব্যবস্থা করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। বিনিময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড উৎপাদিত ফলনের কোন অংশ না নিয়ে এই অঞ্চলের কৃষকদের উন্নয়ন ও বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যমাত্রার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।
রাঙামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নে সরেজমিনে কমলা ও মিশ্র ফলজ চাষ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, রাঙামাটি জেলায় পাহাড়ী টিলায় বিশাল বিশাল কমলা বাগান আর গাছে মৌসুমের শেষেও ঝুলছে সুমিষ্ট কমলা। মিশ্রফসল চাষের মাধ্যমে আর্থ কর্মসংস্থান উন্নয়নের পথ সুগম হওয়ায় বাগান মালিকরাও অত্যন্ত খুশি। যেন স্বপ্ন হাতে পেয়েছেন বাস্তবতায়। বাগান মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড মিশ্র ফসল চাষ প্রকল্পের বাগান থেকে উৎপাদিত ফলনের শতভাগই উপকারভোগীরা পাচ্ছেন। মিশ্র ফলজ বাগান মালিক নিরব চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর সুবাদে তিন একর জায়গায় আমি চার বছর ধরে এ মিশ্র ফলজ বাগান করছি, উন্নয়ন বোর্ড আমাদের চারা দিয়েছে আর প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আগামীতে এ বাগান কিভাবে টিকিয়ে রাখবো বাগানে ভাইরাস বা ছত্রাক জাতীয় রোগ কিভাবে প্রতিরোধ করবো, এবছরও কমলা সঠিকভাবে বিক্রি করতে পারি নাই, কারণ কমলা ধরার আগে আগে ঝরে যায়। এসকল সমস্যা সমাধানে যদি কতৃপক্ষ বা যে কোন সংস্থা পরামর্শ দিলে বাগান টিকে থাকবে।
কৃষক অমর শান্তি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আমাকে মাল্টা, লিচু, কমলা, বড়ই চারা দিয়েছে। এবছর আড়াই হাজার টাকার মাল্টা ৬ হাজার টাকার আম, ৩০ হাজার টাকা লিচু বিক্রি করেছি। উন্নয়ন বোর্ড এর সহযোগিতায় মিশ্র ফসল চাষ করতে পেরে আমি অত্যন্ত খুশি। কিন্তু অভাবের কারণে আমরা পরিপক্ষ ফল বিক্রি করতে পারিনা।
মিশ্র ফসল চাষ প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এ প্রকল্পটি ২০০০ সালে এ প্রকল্প শুরু করে ২০০৭ সালে প্রথম পর্যায় শেষ হয়। ২০০৮ সালে আমরা আবার প্রকল্পটি শুরু করি। আমরা কৃষকদের চারা, সার, কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এবার অর্থকরী ফসল হিসেবে তেজপাতা ও কপি চারা দেবো। এপর্যন্ত ৮২০ পরিবারকে আমরা এ প্রকল্পের আওতায় এনেছি, বছর আমরা ৮০ পরিবারকে এ প্রকল্পের আওতায় আনবো। কমলা ঝরে যাচ্ছে বিষয়টা আমরা বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় তুলে ধরবো এবং পরামর্শ নিয়ে কৃষকদের মাঝে ঐ পরামর্শ সম্প্রসার করবো। অসচেতন কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করনের মাধ্যমে আমরা মিশ্র ফসল চাষে আগ্রহী করার চেষ্টা করছি, যাতে তারা স্বাবলম্বী হয়। আজকে যারা আমি গরীব বলছে আগামীতে মিশ্র ফল চাষ করে তারা আমি স্বাবলম্বী বলতে পারবে।
মিশ্র ফল চাষ প্রকল্পের সম্ভাবনা বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর ভাইস চেয়ারম্যান (যুগ্ম সচিব) তরুন কান্তি ঘোষ বলেন, আপনারা জানেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা বাংলাদেশের এক দশমাংশ এলাকা । কিন্তু এখানে চাষযোগ্য জমি খুবই কম। আমরা এখানখার কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং ফলের আমদানি নির্ভরতা কমানো। আপনার জানেন যে, বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম ফল আমদানীকারক দেশ, ফল আমদানি করতে আমাদের লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য আমদানি নির্ভরতা কমাব এবং দেশীয় ফল রপ্তানি করবো।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ও মন্ত্রণালয়ের যে অনলাইন তাতে বাগান মালিকদের ফল বেচা কেনার সুযোগ রয়েছে।
পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের এ মিশ্র ফল চাষ প্রকল্প অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ী একটি প্রকল্প। মাত্র চার বছরে ফল উৎপাদন হয় আর এখান আবহাওয়াও ফল উৎপাদনের অনুকুলে। রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় এ বছর কমলা ঝরে গেলেও বান্দরবানের থানছি বলিপাড়া এলাকায় কমলার বাম্পার ফলন হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এ সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতে পারলে পার্বত্য অঞ্চলের কৃষকদের মাধ্যমে আমদানি খরচ কমিয়ে তাদের হাত ধরে উপার্জন হবে ফল রপ্তানির লক্ষ ডলার। এমনটাই স্বপ্ন দেখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর মিশ্র ফলজ চাষ প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা।