বৃহস্পতিবার ● ৩০ নভেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » জাতীয় » বাংলাদেশ প্রবেশ করল পরমাণু বিশ্বে : রুপপুরে প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ প্রবেশ করল পরমাণু বিশ্বে : রুপপুরে প্রধানমন্ত্রী
বাপ্পি রায়হান,ঈশ্বরদী প্রতিনিধি :: (১৬ অগ্রহায়ন ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৯.২১মি.) বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষন এবং বাঙ্গালিজাতী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মানী জাতি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম কংক্রিট ঢালাই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।
তিনি বলেন, আজকের দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। মূল অবকাঠামো নির্মান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ প্রবেশ করল পরমাণু বিশ্বে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য অনেক গৌরবের এবং আনন্দের। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা, মহানমুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোন ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তিনি বলেন, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। এই স্বপ্নের শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে তদানিন্তন পাকিস্তান আমলে । জমি অধিগ্রহণসহ বেশ কিছু কাজ তখন সম্পন্ন হয়েছিল কিন্তু পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে কাজ বন্ধ করে দিয়ে প্রকল্পটি পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ পুণরগঠনের পাশাপাশি রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর সে কাজ আর এগোয়নি। এর পর দীর্ঘদিন কোন সরকারই এ নিয়ে আর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেই। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন একটি জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পরমাণু নিরাপত্তাসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি এবং আইন কানুন অনুসরণ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়। ১৯৯৬ সারে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে এসে আমরা জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করি। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পবাস্তবায়নের জন্য আমরা সে সময় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএ ইএ এর সহযোগিতা চাই। তাদের সহায়তায় আমরা একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করেছিলাম। বিষয়টি যেহেতু আমাদের কাছে একবারই নতুন ছিল, সে কারণে জটিল নিয়ম কানুন তৈরী করতেই আমাদের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ২০০১ সালের পর বিএনপি জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা ক্ষমতায় এসেই আমাদের নেওয়া অনেক ভাল ভাল কর্মসুচি বন্ধ করে দেয়। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি তেমনি একটি প্রকল্প যা তারা বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়নি। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আমরা আবার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়া এটি বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঈশ্বরদীর ঐতিহাসিক রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রথম কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পারমাণবিক নিরাপত্তার উপর আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা(আইএ ইএ) এর গাইড লাইন অক্ষরে-অক্ষরে অনুসরণ করছি। পারমাণবিক শক্তির নিরাপদ এবং সুরক্ষিত প্রয়োগ নিশ্চিত করা ও দেশের সর্ব প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে দেশের জাতীয় পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো শক্তিশালী করার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রন আইন প্রনয়ন করেছি। এ আইনের আওতায় নিরাপত্তা বলয় তৈরীতে সেনাবাহিনী,বিজিবি,পুলিশসহ সকল বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নামে একটি স্বাধীন পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠণ করা হয়েছে। এই সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যে আইএ ইএ এবং রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে।
রাশিয়ান ফেডারেশন সরকার,জনগণ ও পুতিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন,১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ পুণরগঠনেও রাশিয়া এবং সে দেশের জনগণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। তাদের অবদানের কথা স্মরণে রেখেছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা আরও বলেন,বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য দারিদ্র দূরীকরণ,সার্বজনীন শিক্ষা,নারীর ক্ষমতায়ন,শিশু ও মাতৃ-স্বাস্থ্যসেবা এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এক সফল এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত অর্থ বছরের রেকর্ড ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। ২০০৫ সালে দেশের প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করত। এখন তা ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। ৫ কোটি দরিদ্র মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০০৫ সালে ছিল ৫৪৩ ডলার। এখন তা বেড়ে ১ হাজার ৬’শ ১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে।তখন রিজার্ভ ছিল ৩ বিলিয়ন ডালার। আর এখন রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আমরা নিজেদের অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর মত বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। ২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তিতে বাংলাদেশকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত –সম্মৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। আমাদের এই লক্ষ্য পুরণে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে বলে আমি আশাবাদি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ও মৃষ্টভাষী কবি ইয়াফেস উসমান কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূঁয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, এই প্রকল্পে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই হবেনা,প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশ উন্নয়নের এক বিশাল শিখরে উন্নীত হলো। তিনি সকল মন্ত্রনালয় ও সকল মানুষের সহযোগিতায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেও স্বীকার করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি কবি ইয়াফেস উসমানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন, ভুমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ এমপি,অধ্যাপক আ.হ.ম.রুহুল আমিন এমপি,আই এই এর পরিচালক মি.তোহিহান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব আনোয়ার হোসেন ও এটোমিক এনার্জির চেয়ারম্যান ড. নঈম চৌধুরী।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন, রাশিয়ান ফেডারেশনের মহাপরিচালক মি.এলেক্সি লিখাচেভ। প্রকল্পের পরিচিতি তুলে ধরেন পিডি ড.শওকত আকবর।
প্রধান মন্ত্রী ১১ টা ৮ মিনিটে হেলিকপ্টার থেকে নেমে প্রথমে মসল্লা দিয়ে কংক্রিট ঢালাই কাজের উদ্বোধন ও পরে ফলক ফিতা টেনে ফলক উন্মাচন করেন। এ অনুষ্ঠানকে সফল করতে আমন্ত্রিত বিদেশী অতিথি ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ্যাড. শামসুল হক টুকু, নাটোর-১ আসনের এমপি এড. আবুল কালাম আজাদ,পাবনা -৫ আসনের এমপি খন্দকার গোলাম ফারুক প্রিন্স,পাবনা-৩ আসনের এমপি মকবুল হোসেন,রাজশাহীর এমপি আয়েন উদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর এপিএস সাইফুজ্জামান শেখর, সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবি নেতা এড.রবিউল আলম বুদু,সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ব্যারিষ্টার সৈয়দ আলী জিরু,কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবকলীগের নেতা রফিকুল ইসলাম লিটনসহ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য পাকশী রেলওয়ে ফুটবল ও নতুন রুপপুর স্কুল মাঠে বিটিভির পক্ষ থেকে প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রচারিত প্রধান মন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষন শুনছেন এলাকার হাজার হাজার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।