বুধবার ● ২ ডিসেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » ঢাকা বিভাগ » ইস্তানবুল যাত্রীর দ্বিতীয় পত্র- ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
ইস্তানবুল যাত্রীর দ্বিতীয় পত্র- ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
‘ইস্তানবুল যাত্রীর পত্র’ লিখে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ সে যুগে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ইস্তানবুল যাত্রীর প্রথম পত্র যেহেতু প্রিসিপাল সাহেবের করায়াত্ত সেহেতু আমাকে এটি ‘ইস্তানবুল যাত্রীর দ্বিতীয় পত্র’ হিসেবেই লিখতে হল।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর ইস্তানবুল ভ্রমণ করার এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ হয়েছিল। পুত্র সারফুল আলমকে সাথে নিয়ে, না একটু ভুল হল, সারফুল আলম তার পিতা দিদারুল আলমকে সাথে নিয়ে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ২৬ তারিখে সারফুল আমাকে বললো, আব্বু ইস্তানবুল যাবে? কবে? ২৯ তারিখে। আমি আবাক হলাম, আজ ২৬ তারিখ ২৯ তারিখে কিভাবে যাব! ভিসা টিকেট ইত্যাদি কিভাবে হবে। সে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে আস্থার সাথে বলল, তা হয়ে যাবে। হয়ে গেলে যাব, আমি সম্মতি দিলাম।
কিন্তু মনে মনে ভাবতে লাগলাম কিভাবে সম্ভব! ২৭ তারিখ এল পুত্রের বিশেষ কোন তৎপরতা চোখে পড়ল না । জিগ্যেস করতে বলল, ২৮ তারিখেই ভিসা ও টিকেট করে ফেলব। আমি এবার হতবাক হলাম। এ কি করে সম্ভব। পুত্র আমার সাথে কোন লুকুচুরি খেলছে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি প্রায়ই বলি ইন্টারনেট হল আলাউদ্দিনের দৈত্য। যা চাই তা হাজির করে। কিন্তু ইন্টারনেট নামক এই দৈত্য এক দিনে টার্কিশ ভিসা ও টিকেট কি আমাদের দিতে পারবে?
পুত্র আবার আলাউদ্দিন মার্কা চাকরি করে। ইন্টারনেট তথা আধুনিক যুগের দৈত্যের নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ আধুনিক যুগের আলাউদ্দিন। আমি পুত্রের উপর ভরসা রেখে অপেক্ষা করতে থাকি।
২৮ তারিখে সে যথারীতি অফিসে চলে গেল। দিনভর কোন তৎপরতা চোখে পরলো না। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে কিছুক্ষণ ইন্টারনেট নিয়ে কাজ করল, অতঃপর আমাকে বলল, আব্বু, আমার ভিসা হয়ে গেছে, চলো তোমারটা করে ফেলো। বলে আমাকে কম্পিউটারে বসিয়ে দিয়ে একটা ওয়েব সাইটের ঠিকানা দিল। কি করতে হবে বুজিয়ে দিল। আমি কিছুক্ষণ দৈত্য চালাচালি করলাম। দৈত্য বলল তোমার ভিসা রেডি। ৬০ ডলার পেমেন্ট কর, ভিসা নাও। আমার ক্রেডিট কার্ড-তথ্য দিলাম। না; নিল না। তোমার ক্রেডিট কার্ডে এ বছরের ডলার এন্ডরস করিয়েছ? পুত্র জানতে চাইল। না করাই নি । পুত্র তার ক্রেডিট কার্ড দিল। পেমেন্ট হয়ে গেল। সাথে সাথে ভিসা হাজির।
ধন্য ধন্য হে আধুনিক কালের দৈত্য। তোমার তুলনা নাই। আরও ধন্য ধন্য দৈত্য-নিয়ন্ত্রক আমার পুত্র সারফুল আলমকে। অতঃপর টিকেট কেনা। আবার সেই দৈত্যকে হুকুম করা হল সবচেয়ে সাশ্রয়ী টিকেট এনে দাও। আমিরাত ও টার্কিশ এয়ার লাইনের এক কমপ্লেক্স বানিয়ে বাজার দরের চেয়ে ২৫ হাজার টাকা কমে আমাদের টিকেট এনে দিল। আমাদের জন্য দুই আসন বিশিষ্ট একটি সিটে চেক ইনও করে দিল যাতে আমরা বাপ-বেটা একান্তে বসতে পারি। চমৎকার একটি ভ্রমণের আয়োজন হয়ে গেল।
আমরা ২৯ তারিখ রাতে রওয়ানা হয়ে পরদিন ভোরে কামাল আতাতুর্ক বিমান বন্দরে অবতরণ করলাম। দৈত্য আমাদের হোটেলেরও বুকিং করে রেখেছিল। আমরা বেস্ট ওয়েস্টার্ন সিনেটর হোটেলে চেক ইন করলাম। আমাদের চেক ইন টাইম বেলা ১২ টায়। হোটেল কতৃপক্ষ ৯ টায়ই রুম দিয়ে দিল। সেদিনের নাস্তা আমাদের প্রাপ্য নয় কিন্তু হোটেল সেটাও কমপ্লিমেটারি হিসেবে দিয়ে দিল। হোটেলের সৌজন্যে প্রীত হলাম। দুপুর পর্যন্ত ঘুমালাম।
বিকেলে দৈত্যের পিছু পিছু এদিক ও দিক কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম। ডিনার করে আমি ঘুমাতে গেলাম।
পরদিন আমরা হপ অন হপ অপ বাসে বসে পুরো ইস্তানবুল শহরের আদ্যপান্ত দেখলাম। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে বসফোরাস নদী। এপারে এশিয়া ওপারে ইউরোপ। অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য শহরটির। দু দুটি মহাদেশ জুড়ে অবস্থান করছে। বসফোরাস নদী কৃষ্ণ সাগর ও মারমারা সাগরকে সংযুক্ত করেছে। মহাসাগর গামী জাহাজ এই নদী দিয়ে চলাচল করতে পারে। এজন্যই এ শহরটি এত গুরুত্বপূর্ণ।
৫০০ বছর ধরে অটোমান সম্রাজ্জের রাজধানীর মর্যাদা ভোগ করেছে শহরটি। এর আগে হাজার বছর ধরে রোমান ও গ্রিকদের রাজধানী ছিল শহরটি। ১৪৫৩ সালে ২১ বছর বয়সী সুলতান মেহমেদ সম্রাট কনসটানটাইনকে পরাজিত করে তখনকার এই নামের শহরটি দখল করে নেয়। তখন থেকে ১৯২২ পর্যন্ত ইস্তানবুল নাম নিয়ে মুসলমানদের শৌর্য বীর্যের লীলা ভূমি হয়ে টিকে ছিল। ১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্ক রাজধানী আঙ্কারায় নিয়ে যান।
বসফোরাস নদীর ওপর দিয়ে বিশাল জুলন্ত সেতু যা বহু বছর বিশ্বের এক নম্বর সেতু হিসেবে খ্যাত ছিল। আমাদের বাস এই সেতু দিয়ে নদীর এপার অপার করে এশিয়া-ইউরোপ ভ্রমণ করিয়ে আনল । ফিরতি পথে ‘সুলতান আহমেট স্কোয়ার’ নামক টুরিস্ট স্পট এ নেমে কিছুক্ষণ ঘোড়া ফেরা করে লাঞ্চ কাম ডিনার সেরে হোটেলে এসে ঘুম দিলাম।
পরদিন সকাল সকাল আমরা ইস্তানবুলের মুল টুরিস্ট কেন্দ্র ‘সুলতান আহমেট স্কোয়ার’এ চলে গেলাম। পৃথিবীতে ট্রাম সার্ভিস বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। আমরা ইস্তানবুলের ট্রাম সার্ভিস দেখা এবং’ সুলতান আহমেট স্কোয়ার’এ যাওয়ার জন্য ট্রাম সার্ভিসই ব্যাবহার করলাম। ট্রাম সার্ভিস আমাদের মুগ্ধ করে ফেলল । আধুনিক মেট্রো রেলের আদলে ইস্তানবুলের ট্রাম সার্ভিস সত্যই এক চমৎকার জনপ্রিয় বাহন।
প্রথমে দেখতে গেলাম হাগিয়া সফিয়া। খ্রিস্টীয় ৬ শতকে বাইজেনটাইন সম্রাট এটি নির্মাণ করেন। পৃথিবীর ব্রিহতম গির্জা হিসেবে এটি খ্যাতি লাভ করে। ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান মেহমেদ ২ খ্রিস্টানদের পরাজিত করে এটি দখলে নেন। এবং মসজিদে রূপান্তরিত করেন। এর মুল কাঠামো ঠিক রেখে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। বর্তমানে এটি মিউজিউম। এর চমৎকার নির্মাণ শৈলী ও বিশালত্ব আজও লক্ষ লক্ষ পর্যটককে টানে। নিচে এর দুটি ছবি দেয়া হল।
অতঃপর আমরা গেলাম তোপকপি রাজপ্রাসাদ দেখতে। অটোমান সুলতানেরা তাঁদের ৬২৪ বছর শাসন আমলের ৪০০ বছর এই প্রাসাদেই বসবাস করেছেন। বর্তমানে এটি মিউজিউম। নবিজীর তরবারি জুলফিকারসহ আরও নানান ব্যাবহার্জ দ্রব্য ও সাহাবাদের কিছু তৈজসপত্র দিয়ে সাজানো আছে। সুলতানদের পোশাক ব্যাবহার করে ছবি তোলারও চমৎকার সুযোগ আছে। আমরা বাপ বেটায় সুলতান সেজে বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম।
ব্লু মস্ক মুসলিম ঐতিহ্যের চমৎকার আর একটি নিদর্শন। সেটাও ঘুরে ফিরে দেখলাম। বসফোরাস নদিতে নৌবিহারের আরামপ্রদ বেবস্থা আছে। আমরা সড়ক পথে একবার এশিয়া-ইউরোপ ঘুরে এসেছি, এবার নদীপথেও এশিয়া-ইউরোপ ভ্রমণ করে এলাম। ইস্তানবুল অনেক বড় শহর। অনেক বছর এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে খ্যাত ছিল। চিনের বেজিং শহরটিই ছিল এক নম্বর।
লেখক: বীর প্রতীক কর্নেল (অবঃ) মোহাম্মেদ দিদারুল আলম