বৃহস্পতিবার ● ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » চাকমা সার্কেলে ভিক্ষু অগ্রবংশের আবির্ভাব
চাকমা সার্কেলে ভিক্ষু অগ্রবংশের আবির্ভাব
রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা :: (পূর্বে প্রকাশের পর) পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা সার্কেল ১৯৫৭ ইং এর পর বৌদ্ধধর্ম অভুতপূর্ব জাগরণ, পরিশুদ্ধতা একইভাবে আয়ত্বকরন এবং প্রসার লাভ ভিক্ষু অগ্রবংশ মহাস্থবিরের কঠিন ত্যাগ, সহিঞ্চুতায় সম্প্রসারিত হয়ে ওঠে। বাধার পর বাধা অতিক্রম করে জাতিকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মুক্তি মন্ত্রেও জ্ঞানের আলো ঢেলে দিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্মের সুধাসিঞ্চন। কারণ তৎসময়ে পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষিত ও বিনয়ধারী ভিক্ষু অভাব ছিল। অগ্রবংশ মহাস্থবিরের চিন্তা চেতনা অপরিসীম তত্ত্বজ্ঞান ও ধারন এবং ধর্ম সমাজ প্রবৃদ্ধিকরণ বিষয়ে প্রবীন গুনী সমাজ তাঁকে ঠিক একশত বছর আগে মহা প্রজ্ঞাবান সারমেধ মহাস্থবিরের সাথে তুলনা করেছিলেন। অগ্রবংশের জন্ম হয় ১৯১৩ ইং সনে। জন্মের পর ফুলের মত সুন্দর বলে ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা। পিতা রুদ্রসিং কার্বারী ছিলেন মহাজন নামে খ্যাত এবং হাল চাষের জন্য অনেক মহিষ ছিল। মাতা ইচ্ছাবতী তঞ্চঙ্গ্যা। জন্মস্থান রাইংখ্যং নদীর ১২২ নং কুতবদিয়া মৌজা, বিলাইছড়ি, রাঙামাটি। ফুলনাথ মাতৃজঠর থেকে ভুমিষ্ঠ হওয়ার সময় প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে, তার নাভির বর্ধিত অংশ বাম স্কন্ধে শোভিত ছিল। এই লক্ষণের নিমিত্ত ছিল ভবিষ্যতে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হবেন এমন পূর্বাবাস মুখেমুখে।তার নাসিকার ডান পাশে এবং বক্ষের ডান পাশে জন্মলগ্ন থেকে দৃষ্টাদৃষ্ট ছিল বিদ্বান যশস্বী ও কবিত্বের চিহ্ন বড় লাল তিল। সুশ্রী মুখমন্ডল, ফর্সা এবং অতি বিমোহিত কণ্ঠস্বর। ফুলনাথের বয়স যখন বার চৌদ্দ ওসময় যাত্রা গাণের পঞ্চম অংক নাটকে তিনি বিবেকের গাণ গেয়ে খুবই যশস্বী প্রাপ্ত হন। একারণে তার সংসারের প্রতি অনাসক্তভাব উৎপন্ন হয় এবং রাইংখ্যং নদীর তীরবর্তী ১২০ নং ছাক্রাছড়ি মৌজার বগলতলী বৌদ্ধ বিহারে শ্রীমৎ তিস্স মহাস্থবিরের নিকট প্রবজ্যা গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে উপসম্মদাগ্রহণ করে নাম করণ হয় ভিক্ষু অগ্রবংশ। বলাবাহুল্য এই বৌদ্ধবিহার স্থাপিত হয় ১৯৩১ সালে এবং এই বিহারে কঠিন চীবর দান হয়েছিল ১৯৪১ সালে। সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের এটাই সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান। ইহাও সত্য যে, ভিক্ষু অগ্রবংশ স্থবির রাঙামাটি চাকমা রাজবিহারে অবস্থানের পর ১৯৫৮ সালে প্রথম কঠিন চীবর দান করে এলাকার মানুষকে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে রাঙ্গুনিয়া ধাতুচৈত্য বিহারে পন্ডিত ধর্ম্মানন্দ মহাস্থবিরের নিকট পালি শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর আন্দার মানিক শ্মশান বিহারের সাধক প্রবর ও বিদর্শনাচার্য শ্রীমৎ আনন্দমিত্র মহাস্থবির (পরবর্তীতে নিখিল ভারত বৌদ্ধ সোসাইটি এর সভাপতি, দিল্লি) নিকট অভিধর্ম বিষয়ে বুৎপত্তি লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে রেঙ্গুন গমন করেন এবং রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৪-১৯৫৬ ইং সালে তথাগতের আড়াই হাজার বর্ষপুর্তি বা বুদ্ধ জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে ব্রক্ষদেশে বিশ্ব বৌদ্ধ সম্মেলন, ষষ্ঠ সংগীতিতে রাষ্ট্রীয় পূর্ণ মর্যাদায় আমন্ত্রিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র তিনিই অংশ গ্রহণ করেন। (The chatta sansayana souvenir Album, Union Buddha sasana Council, Yesu Rangoon-17 may 1954 CE) অতঃপর ষষ্ঠ সংগীতি কারক বা অগ্রমহাপন্ডিত ভুষিত হওয়া এমন সৌভাগ্যবান হলেন ভিক্ষু অগ্রবংশ। তার মহাযাত্রা, সাফল্যতার সংবাদ দেশে বিদেশে সংবাদপত্রে ছাপা হয়। সে সময়কালে এই অঞ্চলে যেমনি শিক্ষিত ভিক্ষু ছিলনা তেমনি ভিক্ষুও ছিল অতি কম। ফলে লুরী/লাউরী বা লুথাক নামে পরিচিত পুরোহীতগণ প্রভুত্ব খাটিয়ে শাস্ত্র বিগর্হিত অনাচারে ঢেকে রেখে বহুলোক খৃষ্টান ও সনাতন ধর্মে দীক্ষিত হয়। অতঃপর চাকমা রাজা মেজর ত্রিদিব রায় সমাজের বর্ষীয়ান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করেন। প্রবীন নেতা শ্রী কামিনী মোহন দেওয়ান ভূতপূর্ব এম এল এ রায় বাহাদুর বিরুপাক্ষ রায়, বিরাজ মোহন দেওয়ান, অবসর প্রাপ্ত ম্যাজিষ্ট্র্যাট বলভদ্র তালুকদার, সবিমল দেওয়ান, হেডম্যান কমিটির সভাপতি শশাংক কুমার দেওয়ান, কৃষ্ণ মোহন খীসা, ১নং ধামাইছড়া মৌজার নিরঞ্জন কার্বারী, দুরছড়ি দ্রোন কার্বারী, বন্দুক ভাঙ্গা মৌজার ধর্ম মোহন কার্বারী, বন্দুকভাঙ্গা মৌজার সেলশছড়ি গোকুল কার্বারী, লংগদু তিনটিলা মৌজার হেডম্যান হংসধ্বস চাকমা, রাঙামাটি তুষ্টমনি চাকমা ও চিত্রগুপ্ত চাকমাসহ বিশিষ্ট সমাজ হিতৈষীদের সুপরামর্শ করেন। অতপর চাকমা রাজা রেঙ্গুন গমন করেন এবং ভিক্ষু অগ্রবংশ স্থবিরকে ফাং (আমন্ত্রণ) জানান। ১৯৫৭ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ৫ জানুয়ারী ১৯৫৮ সালে মহা আড়ম্বও ও রাজকীয় সম্মানে রাজগুরু পদে অভিষিক্ত করেন। সুসজ্জিত হস্তির পৃষ্ঠে আরোহন পূর্বক তাকে সমস্ত রাঙামাটি প্রদক্ষিণ করানো হয়। তখন জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শতশত নরনারীর সাধুবাদ ধ্বনিতে মূখরিত হয়। ব্যান্ডদল, কীর্তনপার্টি, ঢুলিদের ঢাকা ঢক্কা, কাঁসর বাজনা আর রাস্তার দু ধাওে পুষ্প ছিটিয়ে দেয়ার দৃশ্য খুবই আকর্ষনীয়। লাল বাহাদুর ও ফুল কমারী নামের দুটি হাতি।একটির পিঠে ভিক্ষু অগ্রবংশ স্থবির আর অপরটির পিঠে রাজা ত্রিদিব রায় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এইচ.পি. চৌধুরী সিএসপি। (“আলোকিত তঞ্চঙ্গ্যা ভিক্ষু” গ্রন্থ থেকে চলবে)