মঙ্গলবার ● ২ জানুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » সদ্ধর্ম জাগরণ ও উন্নয়ন
সদ্ধর্ম জাগরণ ও উন্নয়ন
রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা :: (পূর্বে প্রকাশের পর) ১৮৫৭ সালে চট্টগ্রামের রাজা নগরে চাকমা রানী কর্তৃক মহামহোপাধ্যায় ভিক্ষু সারমেধ মহাস্থবিরকে রাজকীয় সম্মানে যেভাবে অভিষেক দিয়ে সংঘরাজ পদে ভুষিত করেছিলেন তার পরবর্তী ঠিক একশত বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে পুরোনো রাঙামাটি রাজমন্দির আঙ্গিনায় চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় চট্টগ্রামের বিশিষ্ট গুণী ভিক্ষু সম্মতিতে অগ্রবংশ স্থবিরকে সংঘরাজ পদে ভুষিত করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্থক জনম মহান এই ব্যক্তি বৌদ্ধধর্ম প্রচার, দীক্ষাদান, শাসননীতি এবং অবিভক্ত সংঘরাজ, নিকাই তারই শ্রেষ্ঠ অবদান। ১৯৫৮ সালে পুরাতন রাজবিহার থেকে ভিক্ষু শ্রামনগণ রাঙামাটি শহরে সর্ব প্রথম পিন্ডচারণ শুরু করেন সুশৃংখলভাবে। ১৯৫৮/৫৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিক্ষু সমিতি গঠন করেন। তার নিরলস ও দুরুহ কর্ম প্রচেষ্ঠায় নির্মিত হল ছাত্রাবাস। অনাথ দুস্থ ছাত্র পড়া লেখায় শিক্ষিত হতে লাগল। তার অচ্যুতানন্দ ও কোন্ডান্য নামে সাত বছরের প্রথম দুই বিজ্ঞ শ্রামন বিভিন্নধর্ম সভায় ধর্মীয় গাথা পাঠ করে মানুষকে মুগ্ধ করে শ্রদ্ধা অশ্রু ফেলে দিত। পূজা পদ্ধতি, গাঁথা, সুত্রপাঠ, শীল আচরণ, শুদ্ধরুপে উচ্চারণ ও শ্রুতিমধুর সুরে বলার আয়ত্বকরন একমাত্র ভিক্ষু অগ্রবংশের মহৎ অবদান। আচরণ দক্ষতা লাভ করে শ্রমন ভিক্ষু সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হতে শুরু করল। কঠিন চীবর দান, অষ্ট পরিষ্কার দান, সংঘদান ইত্যাদি সহ বুদ্ধপূজা, সীবলী পূজা,কল্পতরু যাবতীয় পূণ্যকর্ম একমাত্র তারই অবদান। শিশু কিশোরদের জন্য বাংলায় পুষ্পপুজা, প্রদীপ পুজা, বন্দনা, গাথা বা গীতি কবিতা, উদ্বোধনী সংগীত ইত্যাদি পুস্তিকা ছাপিয়ে বিতরণ করেছিলেন। এছাড়াও চাকমা ভাষায় বুদ্ধ বন্দনা, গুরু বন্দনা, সূত্র এবং শীল পদ্ধতি, উৎসর্গ আর আচরণ বিধি সৃষ্টি করে মানুষকে দিয়েছিলেন অভুতপূর্ব সম্যকজ্ঞান।
উল্লেখযোগ্য ধর্মসভা, ধর্মীয় উৎসব এবং পূণ্যকর্ম মানুষ দেখতে পেল, সম্প্রসারিত হতে লাগল বৌদ্ধ ধর্ম নতুন জাগরণ। ওজা, বৈদ্য, রাউলীদের ধর্মকাম, গাং পূজা, ভুত পুজা, থানমানা, ফি-দশা, ইত্যাদি নিরুপন বা নিবারন নামে মিথ্যাদৃষ্টি বা অকুশল কর্মপরিত্যাগ করে দয়া , মানবতা, এবং সদ্ধর্মকে ধারন করল। ৩৩৪ নং কুক্যাছড়ি মৌজার খ্যাং জাতির নেতা মংবু মাষ্টার প্রবজ্যা গ্রহণ করলেন। ১১৯ নং ভাজ্যাতলী মৌজার হেডম্যান মুরুং সর্দার হৃদয় রঞ্জন রোয়াজা দল নিয়ে এলেন রাজগুরু অগ্রবংশের পদতীর্থে। কিছু সংখ্যক তিপুরা জাতি, খ্রীষ্টান ধর্মের অনুসারী আর শীব ধর্মের পূজারীএলেন বৌদ্ধ ধর্শ দীক্ষা নিতে। উদ্ভব হল দশশীলধারীসাধুমা নামে ভিক্ষুনী। অবশ্য মগ জাতির সাধুমা বহু আগে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে।তারা তাদেও মগ ক্যাং পাশে অবস্থান করতেন।আমার দেখা মতে,ভৈরব তালুকদারের পত্নী, কালাবী মা, কদম্ব মা, বান্দরী মা, রুক্ষীনী মা, রজনী বালা, বুড়ি মা সহ আরো কয়েকজন পূণ্যবতী ব্রক্ষচারিণী সাধুমা সেবা সাধন করে জীবণ ধন্য করেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত পুস্তক, সমবায় বুদ্ধপাসনা, পরিণাম (নাটক), শ্রামণ্য কর্তব্য, চাকমা কদান্দী মঙ্গলসূত্রসহ ৬টি রাজ বিহারে এবং পরবর্তীতে বিদর্শন ভাবনা ও বুদ্ধ সামন্তিকা-১ম খন্ড প্রকাশ করেন। তার প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য বৌদ্ধ সমিতির উদ্যোগে সর্বপ্রথম স্মারক “শুভবানী” গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। এছাড়া বিভিন্ন সংকলনে বহু লেখা এবং বোধী ভারতী, নালন্দা, পারমী, কৃষ্টি, পার্বত্য বাণীসহ বহু সংকলনে নিয়মিত লেখক। তিনি বাংলা, পালি, সংষ্কৃতি, বার্মা ও ইংরেজি ভাষা জানতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্র মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটি আগমন করেন। বিশাল জনসমুদ্র এই জনসভায় রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির পবিত্র ত্রিপিটক পাঠ করেন। সদ্ধর্মের জন্য তিনি গিয়েছিলেন মাইলের পর মাইল উচু নিচু পথ হেটে। তখনকার সময়ে গাড়ী ছিলনা, ইঞ্জিন চালিত বোট ছিল শুধুমাত্র কর্ণফুলী নদীতে ছোট নৌকায় বসে গিয়েছিলেন রাত দিন। চেঙ্গী, মাইনী, ঠেগা, কাচালং, ঠেগা, ভুষনছড়া, কাটলী,পাবলাখালী, রামগড়, দীঘিনালা, পানছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, নান্যাচর, মহালছড়ি, বালুখালী, মগবান, সুবলং ইত্যাদি উজান বেয়ে। কাউখালী, রস্যাবিল, বন্দুকভাঙ্গা, ইত্যাদি বহু গ্রামে।
এছাড়াও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ্য মর্যাদায় বক্তব্য রাখতেন। চট্টগ্রামে তারঅনেক ত্রিপিটকধারী পন্ডিত ও শীলবান সতীর্থ ভিক্ষু রয়েছেন। তিনি মাইনী উপত্যকা দিঘিনালায় ১৯৬২ সালে শ্রমণ রথীন্দ্রকে কর্মবাক্য পাঠ করে উপসম্পদা দিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ভিক্ষু সাধনানন্দ (বনভান্তে)।(“আলোকিত তঞ্চঙ্গ্যা ভিক্ষু” গ্রন্থ থেকে চলবে)