মঙ্গলবার ● ৩০ জানুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » যাহা ৫২ তাহা’ই ৫৩ ঘুরে ফিরে সাংবাদিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ : সাংবাদিক নির্মল বড়ুয়া মিলন
যাহা ৫২ তাহা’ই ৫৩ ঘুরে ফিরে সাংবাদিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ : সাংবাদিক নির্মল বড়ুয়া মিলন
ষ্টাফ রিপোর্টার :: (১৭ মাঘ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬.৪২মি.) গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে।ডিজিটাল ডিভাইস বা প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ব্যবহার করে পরিচালিত যেকোনো ধরনের নেতিবাচক কার্যক্রম আইনের আওতায় আনতে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করতে যাচ্ছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, নতুন আইন পাস হলে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারার অপরাধকে আমলযোগ্যে ও জামিন অযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে : ১৭,১৯,২১,২২,২৩,২৪,২৬,২৭,২৮,৩০,৩১,৩২,৩৩ ও ৩৪।
এসব ধারার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
শুরু থেকে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টসহ অনেকে।
কালো আইন বলে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন অনলাইন,প্রিন্ট ও ইলেটনিক্স গণমাধ্যমকর্মীরা।
“সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অন্যায় করবে- কেউ এ তথ্য নিতে পারবে না- এমন ব্যবস্থা গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টার শামিল। এর মাধ্যমে দুর্নীতিকে ইনডেমনিটি দেওয়া হল।”
এপ্রসঙ্গ সমকালের সাংবাদিক রাশেদ মেহেদী ফেইসবুকে লিখেছেন, “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিরোধী ভয়ংকর কালো আইন ৩২ ধারা।
“সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে।”
এই আইনের ফলে যে কোন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে বলে সাংবাদিকদের দাবি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে, পর পর দু’টি ৫৭ ধারার মামলায় আসামী হয়ে ২৮ দিন জেলে থাকা সাংবাদিক নির্মল বড়ুয়া মিলন বলেন, যাহা ৫২ তাহাই ৫৩ ঘুরে ফিরে সাংবাদিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে নতুন ১৪টি ধারায় তা যুক্ত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাংবাদিকদের আরো বেশী বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে।
“৫৭ ধারায় সকল অপরাধকে এক করে ফেলা হয়েছিল। নতুন আইনে সেটা ভেঙে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তথ্য অবকাঠামোতে আঘাত করার জন্য এক ধরনের সাজা এবং সাধারণ মানহানির জন্য অন্য ধরনের সাজার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অভিযোগ যত গুরুতর, সাজা তত বেশি।”
যে কেউ ব্যাংক, বীমার একাউন্ট হ্যাক করে অর্থ চুরি করলে সাজা মাত্র পাঁচ বছর জেল এবং ৫ লাখ টাকা জরিমানা।
গবেষক আর সাংবাদিকরা অনুসন্ধানী সংবাদের জন্য সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত, যেকোনও ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে। যা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ৫৭ (২) ধারার চেয়ে অনেক বেশী ভয়ংকর।
তথ্য প্রযুক্তি আইনে যা ছিল, ডিজিটালে যা হচ্ছে :
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪ ধারায় কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেমের ক্ষতির জন্য সাত থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল এতদিন। আর ৫৬ ধারায় হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধের জন্য সাত থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধের ধরন আরও সুনির্দিষ্ট করে আলাদা সাজা ঠিক করা হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ সাজা সেই ১৪ বছর কারাদণ্ড ও কোটি টাকা জরিমানাই রাখা হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৫ ধারায় কম্পিউটার সোর্স কোড পরিবর্তনের জন্য তিন বছরের জেল বা তিন লাখ টাকা জরিমানার কথা বলা ছিল। নতুন আইনেও তা একইভাবে থাকছে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশের শাস্তি ছিল সাত থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন পাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (খসড়া)
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ক্ষেত্রে ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা; মানহানিকর অপরাধে তিন বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড; ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাত বছর জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করার কথা বলা হয়েছ খসড়ায়।
ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে শব্দ ব্যবহারের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ডে সঙ্গে অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। আর কোনো ধর্মীয় শ্রেণির প্রতি অবমাননার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত কাজের জন্য দুই বছরের জেল ও অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। আর মানহানির ক্ষেত্রে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৯৯, ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারায় সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ ধারায় কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনে সহায়তার জন্য মূল অপরাধের সমান অর্থাৎ সাত থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার কথা বলা ছিল। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নেটওয়ার্ক বা কম্পিউটারে অবৈধ অনুপ্রবেশে সহায়তার শাস্তি ঠিক করা হয়েছে তিন বছরের কারদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬০ ধারায় কম্পিউটার রিসোর্সের মাধ্যমে তথ্য সম্প্রচারে বাধা সৃষ্টির জন্য পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে, যা আইন সংস্কারেও বহাল থাকছে।
আবার প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা বা জনগণের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা সহযোগিতার শাস্তি ঠিক করা হয়েছে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।
নতুন আইনের খসড়ায় ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার বা তাতে মদদের শাস্তি ঠিক করা হয়েছে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। ডিজিটাল মাধ্যমের ক্ষেত্রে এ অপরাধের বিষয়ে আগের কোনো আইনে বলা ছিল না।
এছাড়া সরকারি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল উপায়ে ধারণ, স্থানান্তর বা সংরক্ষণ করা এবং তাতে সহয়তাকে গুপ্তচারবৃত্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে নতুন আইন হওয়া প্রয়োজন। তবে বিতর্ক তৈরি হয় এমন কোনো কিছু বলা, মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা চর্চার জন্য কারাদণ্ড হতে পারে না। তাছাড়া বইয়ে লেখার জন্য একরকম এবং অনলাইনে লেখার জন্য আরেকরকম শাস্তি হতে পারে না বলেও মত দেন তাঁরা। তাঁরা আরও বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় আইনটি করা হচ্ছে, তাতে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমাদের পেনাল কোডে (দণ্ডবিধি) যেসব কাজ অপরাধ বলে গণ্য হয়, ডিজিটাল মাধ্যমেও সেসব ধরনের অপরাধ করা যায়। সাইবার ক্রাইম হত্যা ও ধর্ষণের চেয়েও মারাত্মক। সেটাকে অপরাধ বিবেচনা করে তার শাস্তির ব্যবস্থা এ আইনে প্রস্তাব করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে সাইবার ক্রাইমই সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
আইনের খসড়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর রাখা হলেও অপরাধ বিবেচনায় সর্বনিম্ন সাজাও রাখা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন সাজা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, অনলাইনে একটি অপরাধ হলে তার প্রভাব অনেক বেশি, প্রচারও বেশি। অফলাইনে সেটা কম। অনলাইনের অপরাধ রোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। তাঁর মতে, এখন একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য অ্যাটম বোমা হামলার প্রয়োজন নেই। সাইবার আক্রমণ করে একটি রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে এবং প্রশাসনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়।
নতুন আইনে শাস্তির বিধান সম্পর্কে তথ্যপ্রযুক্তি আইন বিশেষজ্ঞ তানজীব-উল-আলম বলেছেন, আইনটি এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে, মুখের কথার জন্য কাউকে শারীরিক শাস্তির শিকার হতে না হয়। তবে মুখের কথায় কারও মানহানি হলে, কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটালে বা মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করলে মানহানির মামলা বা আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিধান থাকতে পারে।
নতুন ওই আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে সমালোচিত ও বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ পাঁচটি ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে, যা বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের অন্তরায় বলে আইনজ্ঞরা মত দিয়ে আসছিলেন। আইনের ওই ধারাটি জামিনযোগ্য নয়, রাঙামাটিতে যার সর্বশেষ শিকার হন সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম এর প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক নির্মল বড়ুয়া মিলন।