শনিবার ● ১০ মার্চ ২০১৮
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » সমস্যায় জর্জড়িত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ : মেয়াদ উত্তীর্ন ভবনে ছাত্রী হোষ্টেল
সমস্যায় জর্জড়িত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ : মেয়াদ উত্তীর্ন ভবনে ছাত্রী হোষ্টেল
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: (২৬ ফাল্গুন ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১২.৩৩মি.) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদিচ্ছার ফসল হিসেবে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন করনারী কেয়ার ইউনিটের জন্য বৈদেশিক সাহায্যে নির্মিত পাঁচ তলা ভবনে অস্থায়ী ভিত্তিতে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস শুরু করা হয়েছিল ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসে। এ পর্যন্ত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম ৪র্থ বর্ষে পা দিয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর মাত্র তিন বছরে সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পরেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। শুরুতে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতারা জোরাতালি দিয়ে কোন রকমভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসলেও বর্তমানে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের অবর্ণনীয় দৈন্যদশা । গত ১০ জানুয়ারী ২০১৫ ইংরেজি তারিখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের উদ্ভোধন করেন। উদ্ভোধনের পরে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এই মেডিকেল কলেজ শুরুতেই স্থানীয় রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ) দ্বিমত পোষন করে আসছিল। তাদের দাবী সবার আগে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এবং এমবিবিএস ডাক্তারের পরিবর্তে পল্লী চিকিৎসকদের জন্য প্যারামেডিকেল কলেজ স্থাপন করে পরবর্তীতে প্যারামেডিকেলকে মেডিকেল কলেজে রুপান্তরিত করা। কারণ এমবিবিএস ডাক্তারগণ উপজেলা পর্যায়ে অবস্থান করে না বলে বিভিন্ন উপজেলার জনসাধারন চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হয়ে আসছেন তাই জেএসএস এর প্যারামেডিকলে স্থাপনে আগ্রহ ছিল বলে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার দাবি। মেডিকেল কলেজটি শুরুতে ৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু হলেও বর্তমান এই প্রতিষ্টানটির ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ২শ জন,শিক্ষকের সংখ্য ৪০ জন, কর্মকর্তা-কর্মচারী অস্থায়ী ভিত্তিতে ১০ জন। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষা কার্যক্রমে পদার্পন করেছে। কিন্তু নেই শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশীপ করার ব্যবস্থা। রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের অর্ধেক অংশ রাঙামাটি জেলা পরিষদের গাফিলতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বর্তমান ৩টি ওয়ার্ডে চলছে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম। সার্জারী, মেডিসিন, গাইনী ওয়ার্ড চালু রয়েছে। এই ওয়ার্ডগুলিতে চিকিৎসারত ডাক্তার, সিনিয়র স্টাফ নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া ও রোগীর স্বজনদের করিডোরে, বারান্দায়, গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এছাড়া মহিলা ও শিশু ওয়ার্ডের রোগীদের মেঝেতে রাখা হয়। সেখানে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা বা ইন্টার্নী ডাক্তারদের জন্য বসার বা বিশ্রাম নেওয়ার কোন কক্ষ দেওয়ার কোন সুযোগ নাই। এছাড়া ওয়ার্ড ৩টিতে এত বেশী রোগীর চাপ তাদের মেঝেতে রাখা হয়। একটি চেয়ার বা টেবিল বসিয়ে ইন্টার্নী ডাক্তারদেও বসার ব্যবস্থা ও ওয়ার্ডগুলিতে নাই। এর মধ্যে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশীপের সময় এসেছে। রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে নেই কোন পরিবেশ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। এ যেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা।
রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভাগ ভিত্তিক শ্রেণীকক্ষ বিন্যাস করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোন উন্মুক্ত স্থান, নেই ল্যাবরেটরী, যা লাইব্রেরী রয়েছে তা অসংকুলান একটা কক্ষে যেখানে ৫০ জন ছাত্রছাত্রী বসে পড়ার কোন সুযোগ নেই। মেডিকেল কলেজে নিরাপত্তার জন্য বসানো ২২টি সিসিটিভি ক্যামেরার মধ্যে মাত্র ৯টি ক্যামেরা সচল রয়েছে, বাকী ১৩টি রয়েছে অকেজো অবস্থায়। শিক্ষকদের অবস্থানের জন্য নেই কোন আবাসিক ভবন। শিক্ষকরা চট্টগ্রাম থেকে গাড়ী নিয়ে রাঙামাটি এসে ক্লাশ নিয়ে আবার চলে যান চট্টগ্রাম।
পরিতাপের বিষয় হলো মেডিকেল কলেজের ছাত্রীদেরকে রাখা হয়েছে জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার কোয়ার্টারের মেয়াদ উর্ত্তীন্ন পরিত্যাক্ত দুটি ভবনে। এই ভবন দুটি গণপূর্ত বিভাগ ও দাতা সংস্থা ইউএনডিপি গত ৬ বছর আগে মেয়াদ উর্ত্তীন্ন ঘোষনা করেছে। অথচ দেশের ভবিষ্যৎ ডাক্তার সেই মেধাবী ছাত্রীদের হোষ্টেল হিসেবে ব্যবহার করছে এই মেয়াদ উর্ত্তীন্ন ভবন দুটি। তাছাড়া ভবন দুটি ভিতরে অস্বাস্থ্যকর, নেই পর্যাপ্ত আলো, দেয়ালের প্লাষ্টার খসে পরেছে, বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনগুলি অধিকাংশ অকেজো, ফ্যান অধিকাংশ অকেজো, এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহারের জন্য ঢাকা থেকে পাঠানো আসবাবপত্র অধিকাংশ ভাঙ্গাচুরা, ভবনের দরজা জানালা ভাঙ্গা, টয়লেট গুলি ব্যবহারের অনুপযোগী। পরিত্যাক্ত দুই ভবনেই বর্ষাকালে ছাদছুয়ে ভিতরে পানি পরে, রাত্রে নিরাপত্তা বাতিগুলো অকেজো, ভবনের পানির টাঙ্কিগুলো হাল আমলের, শেওলা ধরা এবং স্যাঁতস্যাতে অবস্থা। তারপরও কর্তৃপক্ষের নেই রক্ষনাবেক্ষনের উদ্যোগ। এমন অস্বাস্থ্যকর মেয়াদ উর্ত্তীন্ন ভবনে অবস্থান করে মেডিকেল শিক্ষা গ্রহণ করছে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা, যারা অদুর ভবিষ্যৎ ডাক্তার। এসব মেয়াদ উর্ত্তীন্ন ভবনে শিক্ষার্থীদের রাখায় অভিবাবকরাও শংকিত। জানা গেছে প্রতি একলক্ষ শিক্ষার্থী থেকে তিন হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী বাছাই করে মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা বিভাগে ভর্তি করা হয়। আর এসব বাছাই করা মেধাবীদের রাখা হয়েছে মেয়াদ উর্ত্তীন্ন ভবনে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
এ বিষয়ে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্যান্য মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ন্যায় রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও মেধাবী, দুয়েক পয়েন্ট কম পাওয়াতে তারা রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে পড়তে এসেছে। একটি পরিপূর্ণ মেডিকেল কলেজে যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা থাকার কথা রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে তার ষোল আনার মধ্যে দুই আনাও নাই। সরকার যদি মেডিকেল কলেজের সকল সুবিধা দিতে না পারে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ বন্ধ করে দেয়া উচিৎ আমি মনে করি। শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জন্য নেই খেলার মাঠ, চলাচলের জন্য উন্মুক্ত স্থান নেই বলেন এই শিক্ষক।
এসব বিষয়ে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. টিপু সুলতানের কাছে জানতে চাইলে ছাত্রছাত্রীদের হোষ্টেলের দৈন্যদশা কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, রাঙামাটিতে এমন কোন ভবন নাই যে ভাড়ায় নিয়ে শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যাবস্থা করা যায়, এছাড়া এধরনের পরিবেশ ও নাই। আমাদের শিক্ষার্থীরা এতই ভাল যে, এত সমস্যা নিয়েও তারা লেখা পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পরিত্যাক্ত ভবন শিক্ষার্থীদের হোষ্টেল হিসেবে ব্যবহার এবং এসব রক্ষণাবেক্ষন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কার্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের এসব হোষ্টেল ও অন্যান্য খরচ বাবদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ৫০ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছে কিন্তু আমাকে বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে মাত্র ২ লক্ষ টাকা। এত কম টাকা দিয়ে আমরা কিভাবে রক্ষণাবেক্ষনের খরচ করবো নিজেই প্রশ্ন তোলেন অধ্যক্ষ। তিনি বলেন গনপূর্ত বিভাগ থেকে এসব রক্ষনা বেক্ষনের বিষয়ে জানানো হলে তাদের তহবিল নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে।
এই রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের প্রকল্পটি এখনো চুড়ান্ত অনুমোদন হয়নি বলেও জানান অধ্যক্ষ ডা. টিপু সুলতান।
রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাসের জায়গা ও ২শ শয্যা হাসপাতালের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন ২শ শয্যা হাসপাতালের টাকা বরাদ্ধ গণপূর্ত বিভাগের কাছে এসেছে, কিন্তু তারা এখনো চার তলা হাসপাতালের নকশা চুড়ান্ত করতে পারেনি। সময় ক্ষেপন করা হচ্ছে, সামনে বর্ষাকাল আসছে এই হাসপাতাল নির্মাণ কাজ আরো কয়ে বছরে শেষ হবে বলা মুশকিল, কাজ এখনো শুরুই তো হয়নি। রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাসের জন্য প্রাথমিকভাবে ২২ লক্ষ টাকা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দিলেও জায়গার দাম ৫০ কোটি টাকার উর্ধে হওয়ায় এক কালীন বরাদ্দ পাওয়া গেলে অথবা রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের প্রকল্প চুড়ান্ত অনুমোদন পেলে বিষয়গুলি আরো পরিষ্কার হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোর বিষয়ে অধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে অচিরে নষ্ট ও অকেজো ক্যামেরাগুলোর স্থানে নতুন ক্যামেরা বসানো হবে বলে তিনি জানান। তবে আগামী ২০১৯ সালে ভর্তি হওয়া মেডিকেল শিক্ষার্থীদের রাখার বিষয়ে তিনি নিজেও চিন্তিত বলে জানান ডা. টিপু সুলতান।