রবিবার ● ২৯ এপ্রিল ২০১৮
প্রথম পাতা » জাতীয় » বুদ্ধ পূর্ণিমা : বুদ্ধের শিক্ষা
বুদ্ধ পূর্ণিমা : বুদ্ধের শিক্ষা
উৎপল বড়ুয়া :: বুদ্ধ পূর্ণিমা সমগ্র মানব জাতির জন্য নিয়ে আসে শান্তির মহান বার্তা। সকল প্রকার হিংসা, শোষণ-নির্যাতন, অবিচার- অনাচার, বর্ণ বৈষম্য, বিভেদ,পৈশাচিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করে, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা বা ক্ষান্তি, ত্যাগ দয়াশীলতা, সংযমতা বা চারিত্রিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে পাপে ঘৃনা, পূন্যকাজে অকুতোভয় জীবন রক্ষাই বুদ্ধের শিক্ষা। বুদ্ধের জীবদ্দশায় বহু ধর্ম প্রবক্তা তথা ধর্ম প্রচারকের নাম প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে পরিদৃষ্ট হয়। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রে দেখা যায় প্রাচীন ভারত ষড়দর্শনের প্রভাব ছিল। যা হলঃ সাংখ্য, যোগ ন্যায় বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত এই দর্শনগুলো বেদের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী, বেদকে অভ্রান্ত ও বেদের সিদ্ধান্তকে প্রামাণ্য বলে মেনে নিতেন, তাই তারা নিজেদেরকে আস্তিক বলে প্রকাশ করত। অপরদিকে চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে বেদের কর্তৃত্ব ও প্রামাণ্য কে অস্বীকার করার কারণে তাদেরকে বলা হত নাস্তিক দর্শন। কোন কোন ক্ষেত্রে ঈশ্বরে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী এ নিয়েও আস্তিক বা নাস্তিক নামে আখ্যায়িত করা হত। তার মাঝে আবার সাংখ্য এবং মীমাংসা দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা না হলেও তারা বেদে বিশ্বাসী বলে তাদেরকে আস্তিক দর্শনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ষড়দর্শনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অমিল পরিদৃশ্য মান ঘটে। একই ভাবে নাস্তিক দর্শনের নামে খ্যাত চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের মাঝে বৌদ্ধ দর্শনের সাদৃশ্য কতটুকু তাহা উপলব্ধি করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
মুলতঃ বৌদ্ধ দর্শনের সাথে চার্বাক ও জৈন দর্শনের একটি বিষয়ে মিল আছে আর তা হল এ দুটি দর্শন ঈশ্বর ও বেদের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী নয়। আদর্শগত ভাবে অন্যান্য বিষয়ে তেমন মিল দেখা যায় না। জৈন দর্শনে কতিপয় নীতির সাথে বুদ্ধের প্রবর্তিত নিয়মের সাথে মিল থাকলেও পর মূলগত দর্শনের সাথে মিল নেই বললেই চলে। চার্বাক দর্শন যেখানে অক্রিয়াবাদী, কর্তা, ভোক্তা, সুকৃত ও দুষ্কৃত কর্মের ফল বা বিপাকে কোন অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় অপরদিকে জৈন দর্শনে আত্মনিগ্রহ বা কৃচ্ছতায় বিশ্বাসী হয়ে আত্মহননের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয় সেখানে বৌদ্ধ দর্শন উভয় দর্শনের মধ্যবর্তী একটি আদর্শ পথের সন্ধান দিলেন,যা বৌদ্ধ দর্শনে মধ্যম পথ নামে খ্যাত। অতিরিক্ত ভোগ, বিলাস তথা স্বৈরতাকে অবদমিত করা, আবার কঠোর আত্মনিগ্রহ বা কৃচ্ছতা গ্রহণ না করে মধ্যবর্তী পথে এগিয়ে আসা যা বুদ্ধের মূল শিক্ষা বা শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার অনুশীলনের শিক্ষা।
বুদ্ধের মূল শিক্ষাই হচ্ছে এই তিনটি স্কন্ধের শিক্ষা- অর্থাৎ শীলস্কন্ধ, সমাধিস্কন্ধ এবং প্রজ্ঞাস্কন্ধ। শীলস্কন্ধে আমরা দেখি বুদ্ধ আমাদের কায়িক বাচনিক ও মানসিক সংযম শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন। তাই আস্টমার্গের তিনটি মারগই শীলস্কন্ধের অন্তর্গত। তিনটি মার্গ সমাধি স্কন্ধ এবং দুইটি মার্গ প্রজ্ঞাস্কন্ধের অন্তর্ভুক্ত। উপলব্ধির সুবিধাতে আমরা এভাবেই সাজাতে পারি, প্রজ্ঞাস্কন্ধ, শীলস্কন্ধ এবং সমাধি, (১) সম্যক দৃষ্টি, (২) সম্যক সংকল্প হচ্ছে (প্রজ্ঞাস্কন্ধের অন্তর্গত) (৩) সম্যক বাক্য (৪) সম্যক কর্ম (৫) সম্যক জীবিকা (শীলস্কন্ধের অন্তর্গত) (৬) সম্যক ব্যায়াম বা সম্যক প্রচেষ্টা (৭) সম্যক স্মৃতি (৮) সম্যক সমাধি (সমাধির অন্তর্গত) ।
প্রজ্ঞাস্কন্ধের আলোচ্য বিষয়ে সম্যক দৃষ্টিই প্রথম। চতুরায সত্য সম্পরকে যথার্থ জ্ঞানই হল সম্যক দৃষ্টি। জীবের সকল দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যা, অবিদ্দার কারণে উদ্ভুত হয় মিথ্যা দৃষ্টি, অবিদ্যার বিনাশ সাধনের মধ্য দিয়ে আমরা যথার্থ সত্য উপলব্ধি করতে পারি।
কেবল সত্য উপলব্ধি করে আমরা দুঃখের বিনাশ সাধন করতে পারিনা। উপলব্ধ সত্যকে দৃঢ় সংকল্পের দ্বারা বাস্তবায়ন বা আত্মস্ত করতে পারলেই দুঃখ মুক্তি সম্ভব। তাই মুক্তিকামী সাধক কে পাপে অনাসক্তি, লোভ, দ্বেষ, মোহ ক্ষয়ের জন্য দৃঢ় হয়ে অগ্রসর হতে হবে। সম্যক দৃষ্টি আর সম্যক সংকল্পে অধিষ্ঠিত মানুষ মাত্রেই অবিনাশী প্রজ্ঞা লাভ করেন এবং অবিদ্যা বিদুরিত করেন।
মিথ্যা, বৃথা, কতু, ভেদ এই চতুষ্টয় বাক্য পরিহার করে সুবাসিত উত্তম বাক্য বলাই সম্যক বাক্য। পরনিন্দা, পরচর্চা ইত্যাদি সর্বত ভাবে বর্জনীয়। সর্বাবস্থায় সত্যবাক্য বলা এবং সংযত, শিষ্ট ও প্রতিপদ বাক্য ভাষণই সম্যক বাক্য। যা শীলের অন্তর্গত।
প্রাণী হত্যা, চুরি, মিথ্যা কামাচার বা ইন্দ্রিয়সেবা থেকে বিরত হয়ে নিস্পাপ কর্ম করাই হল সম্যক কর্ম সম্পাদিত হয়। কায়িক বাচনিক শুদ্ধিতার মাদ্ধমে অন্তরের সুচিতা ও পবিত্রতা সাধিত হয়। এবং সার্বিক শীলের পূর্ণতা সাধনের পথে এগিয়ে যায়।
মিথ্যা জীবিকা পরিহার করে সম্যক জীবিকার মাধ্যমে জীবন যাপন করা। মিথ্যা ভাষণ ও অসদাচরণ পরিহার করে সদুপায়ে জীবিকা নির্বাহ করা কর্তব্য। পঞ্চ অধর্ম বাণিজ্য পরিহার করতে হবে।
পঞ্চ অধর্ম বাণিজ্য হল- (১) প্রাণী বাণিজ্য, (২) মাংস বাণিজ্য (৩) অস্ত্র বাণিজ্য (৪) মাদক ও নারী বাণিজ্য ও (৫) বিষ বাণিজ্য। তুলাকূট ও কংস কূট ত্যাগ করতে হবে। ওজনে ঠকানোর চেষ্টা কে বলা হয় তুলাকূট, সোনা রূপায় ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করাকে কংস কূট বলে। এগুলো পহার করে যথা ধর্ম বাণিজ্য এবং সকল প্রকার দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ প্রবণতা, স্বার্থপরতা পরিহার করে জীবন যাপন করাই সম্যক জীবিকা যা শীলের অন্তর্গত। সম্যক কর্ম ও সম্যক জীবিকাকে যথাযত পালনের মধ্য দিয়ে শীলের পূর্ণতা সাধিত হয় এবং সম্যক দৃষ্টি উৎপন্ন হয়।
শুধুমাত্র শীলের পূর্ণতায় নির্বাণ প্রত্যক্ষ হয়না। নির্বাণ লাভের জন্য চিত্তের স্থিরতা একান্ত আবশ্যক। চিত্তের শান্ততা আনতে পারে সমাধি। সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা সমাধির অন্তর্গত (ক) অনুতপন্ন অকুশল ধর্ম উৎপন্ন হতে না পারে মতে প্রচেষ্টায় থাকা, (খ)উৎপন্ন অকুশল ধর্ম বিনাশ করতে থাকা (গ) অনুতপন্ন কুশল ধর্ম উৎপন্নের প্রচেষ্টায় করা, (ঘ)উৎপন্ন কুশলের সংরক্ষণ করাই সম্যক প্রচেষ্টা। সেই কারনে একদিকে যেমন অকুশল চিত্ত দূর করা উচিত তেমনি কুশল চিন্তায় মন কে পূর্ণ রাখা উচিত। সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টাকে দৃঢ় করণের জন্য প্রয়োজন সম্যক স্মৃতির । স্বভাবত আমাদের চিত্ত বা মন অত্যন্ত চঞ্চল। রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ,স্পর্শ ইত্যাদি অবলম্বনে চিত্ত নিমজ্জিত হয়ে অসংযত মন বা চিত্তকে দমন করে সুস্থির করার লক্ষে তথাগত বুদ্ধ চারটি নির্দেশ করেছেন অর্থাৎ কায়ে কায়ানুদর্শী হয়ে কায়ানুদর্শন করা, বেদনায় বেদনানুদর্শন করা, চিত্তে চিত্তানুদর্শন করা, ধর্মে ধর্ম্যানুদর্শন করা। এক কথায় বিদর্শন জ্ঞানে স্মৃতিতে রত হয়ে সাধক চিত্তের সমস্ত ক্লেশ ও মলিনতা ত্যাগ করা। এতে চিত্ত যথার্থ ভাবে সুস্থির হয়ে সমাধি অভিমুখে পরিচালিত হয়।
সমাধিভিমুখি চিত্ত ধীরে ধীরে সমাধিস্থ হয়ে চিত্তের কলুষতা প্রহীন করে ক্রমশ প্রথম ধ্যান, দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান ও চতুরথ ধ্যান লাভ করে নির্বাণ অভিমুখী হয় এবং গতি, চ্যুতি, নিমিত্ত ইত্যাদি জ্ঞানের অধিকারী হয়ে সংসারের অনিত্যতা উপলব্ধি করে অর্থাৎ অনিত্য দুঃখ সম্পর্কে সম্যক ভাবে উপলব্ধি করে লোভ, দ্বেষ ও মোহ খয়ের মাধ্যমে জগতের সমস্ত দুঃখের অবসান করেন যার মাধ্যমে তার জন্ম জরা, ব্যাধি মৃত্যুর উপশম ঘটে। তাই বুদ্ধের শিক্ষা হলো জীব জগতের অসংখ্য দুঃখ রাজি থেকে মুক্তির পথে এগিয়ে আসা। এই পথ ছাড়া জীবনের সমস্ত দুঃখের অবসান সম্ভব নয়।
বিশ্বের সর্বত্র আজ অস্থিরতা, অনুদারতা, মানুষ মানুষের প্রতি অবিচার অত্যাচার অহরহ চলছে। ধর্মের নামে চলছে অধর্মের জয় জয় কার। জাতিতে জাতিতে রয়েছে হিংসা বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতা। এই অবস্থায় বুদ্ধের শিক্ষার অনুশীলন মানব জাতির একান্ত কর্তব্য। মৈত্র, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা ছাড়া বিশ্ব শান্তি কখনো সম্ভব নয়। এই মৈত্র, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার অনুশীলন মানেই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন। সকল মানব জাতি এই মার্গ সমূহের অনুশীলন করতে পারেন। চতুরার্য সত্যও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন করে জীবনকে সুস্থির ও মূল্যায়ন করে দুর্লভ মানবত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। তাই বুদ্ধের শিক্ষা সম্যক জ্ঞান লাভের শিক্ষা, সম্যক অনুশীলনের শিক্ষা। আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার মত বুদ্ধ ব্যাবহারিক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। চলমান জীবনে শীল বা চারিত্রিক দৃঢ়তা, সমাধি বা চিত্তের সংযম, প্রজ্ঞা বা অবিদ্যা অজ্ঞানতা পরিহারের মাধ্যমে আলোর উন্মচনে জীবনের পূর্ণতা, সত্যের বিকাশ, যথার্থ জ্ঞানের উদ্ভাবনই বুদ্ধের শিক্ষা। তাই কারো কারো মতে বুদ্ধ পরম দার্শনিক, ন্যায়বাদি, মুক্তিকামী। কেউ বা বলেন মুক্তির পথ প্রদর্শক। মোট কথায় বুদ্ধের শিক্ষা হলো অন্ধকার অপসারিত করে আলোর পথে এগিয়ে আসা, জ্ঞানের আলো উপলব্ধি করে অজ্ঞতা ও অবিদ্যা বিনাশ করে প্রজ্ঞালোকে আলোকিত হওয়া। তাই বুদ্ধ বলেছেন- “অত্তদীপ বিহারণ”। আত্মদ্বীপ করে জ্বলো,
কবিগুর তাহা ছন্দে বলেছেন-
আপনারে দ্বীপ করে জ্বালো,
অন্ধকারে দিতে হবে আলো।
তাই অশান্ত বিশ্বে শান্তির বার্তা বরণের জন্য বুদ্ধের শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের জীবনের চলার পথে তথা সকল ক্ষেত্রে বুদ্ধের বাণী বা শিক্ষাই এনে দিতে পারে মুক্তির সর্বোত্তম পন্থা। জীবন ও জীবন বোধ উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন বুদ্ধের শিক্ষার মূল্যায়ন। তাই ত্রি-স্মৃতি বিজরিত শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমাতে আমাদের ঐকান্তিক কামনা বুদ্ধের শিক্ষার যথার্থ মূল্যায়ন ও প্রতিপালনে মানুষের অন্তরে সৎ জ্ঞানের উদয় হোক, মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত হোক, সাম্য- মৈত্রী- অহিংসার বাণীতে বিশ্ব শান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। সর্বোপরি মানুষের মধ্যে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্ব মানবতাবোধের উন্মেষ ঘটুক।
“জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক”।
লেখক : উৎপল বড়ুয়া এম বি এ (মার্কেটিং),সাধারণ সম্পাদক, সিলেট বৌদ্ধ সমিতি,সিলেট।