মঙ্গলবার ● ১ মে ২০১৮
প্রথম পাতা » খাগড়াছড়ি » পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনের রাজনীতি : এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়িতে ৭ খুন
পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনের রাজনীতি : এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়িতে ৭ খুন
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি :: (১৮ বৈশাখ ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩.৪০মি.) পাহাড়ে আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস- এমএন লারমা) গ্রুপের ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব ও কোন্দল তীব্র হয়ে উঠেছে। এই তিনটি আঞ্চলিক সংগঠনের দ্বন্দ্বে গত ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে ৭ জন খুন হয়েছে। এছাড়াও ১০ জনকে অপহরণের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগও রয়েছে। এসব ঘটনায় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের আসামি করে কয়েকটি মামলা হলেও বেশিরভাগ পরিবার আতঙ্কে ও ভয়ে মামলাও করেনি।
খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়, খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতাল, খাগড়াছড়ি জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন মূল ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামের আরেকটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইউপিডিএফ এর এই দুটি অংশ যখন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, তখন এ বছরের ৩ জানুয়ারি ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমাকে খাগড়াছড়ি সদরের স্লুইস গেইট এলাকায় হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনায় মিঠুন চাকমার আত্মীয় অনি বিকাশ চাকমা ৮ জানুয়ারি জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান তাতিন্দ্র লাল চাকমা ও সুধাসিন্ধু খীসাসহ শীর্ষ ৫ জনের নামে মামলা করলে ইউপিডিএফ মূল অংশের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয় জেএসএস (এমএন লারমা) অংশের। এই তিন সংগঠনের আধিপত্য ও বিরোধে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি উপজেলার রাঙাপানিছড়া এলাকায় দিলীপ কুমার চাকমা, ২১ ফেব্রুয়ারি জেলার দীঘিনালা উপজেলার জামতলীতে সাইন চাকমা প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন।
সবশেষ, গত ২২ এপ্রিল পানছড়ির মরাটিলা এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে মাটিরাঙা ও গুইমারা উপজেলার ইউপিডিএফ সংগঠক সুনীল বিকাশ চাকমা ওরফে কাতাং ত্রিপুরা নিহত হন। এ সময় সুমন ত্রিপুরা নামের আরেকজন গুলিবিদ্ধ হন।
এছাড়া, দুদিন নিখোঁজ থাকার পর গত ১৮ এপ্রিল মাটিরাঙা উপজেলার ভাঙ্গামুড়া এলাকা থেকে নতুন কুমার ত্রিপুরা নামের সাবেক এক ইউপিডিএফ কর্মীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি সদরের আপার পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে সূর্য বিকাশ চাকমা নামের একজন নিহত হন। তিনি বিগত ইউপি নির্বাচনে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। গত ১৫ এপ্রিল দীঘিনালা ও বাঘাইছড়ি সীমান্তবর্তী জোড়া ব্রিজ এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে তপন চাকমা ও বিজয় চাকমা নামের দুই ইউপিডিএফ কর্মী খুন হন। খুন হওয়া এই ৭ জনই ইউপিডিএফের নেতাকর্মী বলে দাবি করেছেন সংগঠনের জেলা সংগঠক মাইকেল চাকমা।
এসব ঘটনায় সূর্য বিকাশ চাকমার স্ত্রী রিপনা চাকমা, নতুন কুমার ত্রিপুরার মেয়ে জয়িতা ত্রিপুরা সংশ্লিষ্ট খাগড়াছড়ি সদর থানায় ১৯ এপ্রিল ও মাটিরাঙা থানায় ১৮ এপ্রিল অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও আসামিদের নাম, ঠিকানা ও কোনও সংখ্যা উল্লেখ করেননি। অন্যদিকে, সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা কাতাং হত্যায় পানছড়ি থানায় এবং তপন চাকমা ও বিজয় চাকমা হত্যায় দিঘীনালা থানায় কোনও মামলা হয়নি।
সূত্রগুলো আরও জানায়, গত চার মাসে কমপক্ষে ২০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে সমঝোতা করে ছাড়া পেলেও বেশিরভাগ অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের কপালে কী ঘটেছে এখনও জানা যায়নি। বিভিন্নভাবে অপারেশন চালালেও এখন পর্যন্ত কাউকে উদ্ধার করতে পারেনি নিরাপত্তা বাহিনী। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে এসব খুন, অপহরণ ও গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার।
খাগড়াছড়ি জেলা ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা ঘটনার জন্য জেএসএস (সংস্কারপন্থী) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপকে দায়ী করে বলেন, ‘জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ে বাধা দিতে এবং নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থের জন্য ইউপিডিএফ নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। হত্যা, অপহরণ ও গুম করে ইউপিডিএফের আন্দোলন দমানো যাবে না।’
হত্যাকারীদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে কেন মামলা হচ্ছে না-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিহত নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা ভয়ে ও আতঙ্কে নাম প্রকাশ করে মামলা করতে পারছে না। তাছাড়া, এসব হত্যাকান্ডর পেছনে শক্তিশালী কোনও সংস্থার ভূমিকাও থাকতে পারে। নানা বিষয় চিন্তাভাবনা করে মামলা করতে হয়। যেসব ঘটনায় মামলা হয়নি, মামলা করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দিন দিন প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব হত্যাকান্ড, অপহরণ, গুম চললেও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন।’
জেএসএসের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপের সদস্য সচিব জলইয়া চাকমা বলেন, তাদের কোনও নেতাকর্মী হত্যাকান্ডে জড়িত নয়। শুধু শুধু জেএসএস, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নেতাকর্মীদের দোষারোপ করা হচ্ছে উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত হলেই বলা যাবে কারা এসব ঘটনার জন্য দায়ী।
খাগড়াছড়ি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম এর প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আঞ্চলিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব ও বিরোধ এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।’ হত্যাকান্ডের ফলে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘দুর্গম ও নির্জন এলাকায় হত্যাকান্ড গুলো ঘটছে। পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার ও ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের সদস্যদের হাতে হস্তান্তর করছে। পরিবারের সদস্যদের থানায় এসে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হলেও কয়েকজন করেছে, কয়েকজন এখন পর্যন্ত থানায় আসেনি, মামলাও করেনি। আমরা পরিবারের সদস্যদের জন্য আরও অপেক্ষা করবো, তারা না এলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার প্রকৃত বর্ণনা কেউ দিতে পারেন না। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হচ্ছে। ফলে মামলার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত ও আদালতে সোপর্দ করতে একটু সময় লাগলেও প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। ছবি প্রোফাইল অনলাইন ডেস্ক