বৃহস্পতিবার ● ৩ মে ২০১৮
প্রথম পাতা » জয়পুরহাট » ঝুঁকিতে শিল-পাটা তৈরির ৩ শতাধিক শ্রমিক
ঝুঁকিতে শিল-পাটা তৈরির ৩ শতাধিক শ্রমিক
আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি :: (২০ বৈশাখ ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.২১মি.) দিনের শুরুতেই জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার চক্রপাড়া গ্রাম মুখরিত হয় ঠুকঠুক শব্দে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-বৃদ্ধ সবাই হাতুরি আর ছেনি নিয়ে একসঙ্গে পাথর কেটে তৈরি করেন শিল-পাটা। পাথরের উপর হাতুরি আর ছেনি ঠোকার শব্দে কান পাতা দায় হলেও ওরা নিঃশব্দে তৈরি করেই চলেন একের পর এক শিল-পাটা। এটি চক্রপাড়া গ্রামের নিত্যদিনের দৃশ্য। কিন্তু আগে এ পেশা যে এ কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ তা জানতেন না কোনো শ্রমিকই।
৬ বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত থাকা শ্রমিক হাফিজুল ৫ বছর আগে যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর একইভাবে মারা যান গ্রামের ইছাহাক, ইসমাইল, শাহীন, লুৎফর, আমিনুর ও শাহজাহান। এদের মৃত্যুতে টনক নড়ে সবার, বোঝা যায় পাথরের কণা শরীরে ঢুকেই তাদের এই দশা। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান একই পরিবারের ৩ শ্রমিক। সর্বশেষ এবারের ঈদুল ফিতরের দিন মৃত্যু হয় আব্দুল মজিদ নামে আরও এক শ্রমিকের। এ নিয়ে ওই এলাকার অন্তত ১৫ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
শুধু তাই নয় এরই মধ্যে ফুসফুসের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে জাহাঙ্গীর, বেলাল হোসেন ও জাইদুলসহ প্রায় ৩০ জনেরও বেশি শ্রমিক অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছেন।
তারপরও গ্রামের ৩ শতাধিক শ্রমিক এখন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শিল-পাটা তৈরির কাজ করছেন।
যারা অসুস্থ হয়েছেন কিংবা মারা গেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা দিন কাটাচ্ছেন অর্ধাহারে-অনাহারে। অসহায় এই পরিবারগুলোর খোঁজখবরও কেউ নেয়না।
এমনকি ওই এলাকার কতজন একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রশাসনের কাছে তার হিসাব নেই। এ ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন।
সরেজমিনে চক্রপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের পাকা সড়কের ২ পাশের বাড়ির উঠানে, বারান্দায় শিল-পাটা তৈরির কাজ করছে অন্তত ২ শতাধিক শ্রমিক। এদের ২/১ জনের নাকে-মুখে কাপড় বাঁধা থাকলেও অধিকাংশ শ্রমিক পাথরের ধূলিকণা প্রতিরোধে মুখে বা নাকে কোনো কাপড় বাঁধা নেই।
১ থেকে ২ ফুট দুরুত্বে বসে সবাই পাথর কাটছেন বেশ মনোযোগ দিয়ে। খটখট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পাথরের কণা তাদের নাকে মুখে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কোনো আগন্তুক গেলে যেখানে এক মুহূর্তও থাকা দায় সেখানে দিনের পর দিন কাজ করে চলেছেন শিল-পাটার এসব শ্রমিক।
এ কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে সাইদুর রহমান নামে এক যুবক জানা, ৮ বছর ধরে শিল-পাটা তৈরির কাজ করছেন তিনি। পাথরের ধূলা-বালু নাকে-মুখে গিয়ে বর্তমানে তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলেও ভয়ে ডাক্তারের কাছে যাননি তিনি।
এ বিষয়ে আনোয়ার নামে আরেক শ্রমিক জানান, এ গ্রামের অনেক যুবক অর্থ উপার্জনের জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই শিল-পাটার কাজ করে ক্রমাগত যক্ষা ও ব্রঙ্কাইটিজ রোগে আক্রান্তÍ হয়ে পড়েছেন।
শ্রমিকদের অভিযোগ, ঝুঁকি জেনেও পেটের দায়ে তারা এ পেশা ছাড়তে পারছেন না।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ মজুরি খেটে যেখানে দিনে সর্বোচ্চ রোজগার হয় ১শ’ থেকে দেড়শ’ টাকা, সেখানে দিনে শিল-পাটা তৈরির কাজ করে রোজগার হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪শ’ টাকা। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে শ্রমিকদের ধরে রাখতে মহাজনরা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অগ্রীম পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন।
১টি পাটা এবং ১টি শিল কাটলেই শ্রমিকরা মজুরি পান ৩৫ টাকা। দিনে কেউ কেউ ১০ থেকে ১৫ সেট পর্যন্ত শিল-পাটা তৈরির রেকর্ড করেছেন বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন।
শ্রমিকরা আরও জানান, শুধু মুখে মাস্ক ব্যবহার করলে এর থেকে পরিত্রান পাওয়ার সুযোগ নেই। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে পাথরের ধুলা শরীরে ঢুকছে। মাত্র ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যেই তারা অসুস্থ্য হয়ে মারা যাচ্ছেন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও শুধু টাকার জন্য তারা এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ পেশায় ঝুঁকির কথা স্বীকার করে শিল-পাটার মহাজন মাসুদ রানা জানান, ভারত থেকে ট্রেনে করে বগুড়ার সান্তাহার থেকে পাথর এনে গ্রামের শ্রমিকদের দিয়ে শিল-পাটা তৈরির পর সেগুলো চাহিদা অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। এ ব্যবসায় লাভ বেশি হওয়ায আগে ২ জন গ্রামে মহাজনি করলেও এখন প্রায় ৩০/৪০ জন মহাজন এ ব্যবসা করছেন।
তবে শ্রমিক সংকটের কারণে অনেক সময় চাহিদা অনুযায়ী মাল সরবরাহে সমস্যায় পড়তে হয় বলে তিনি জানান।
একই এলাকার আরেক মহাজন বেলাল হোসেন বলেন, শ্রমিকরা লোভে পড়ে এ কাজ করছেন। তিনি নিজেও এ শিল্প বন্ধের পক্ষে। কিন্তু এ গ্রামের মহাজনরা ব্যবসা বন্ধ করে দিলেও তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে এই একই কাজ করবেন। তারা অন্য কাজ করবেন না কারণ সেখানে এখানকার মতো এতো বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া যায়না।
একই গ্রামের গৃহবধূ পরভীন বলেন, মজুরি বেশি পেয়ে এ গ্রামের শিশুরাও শিল-পাটা শ্রমিকের কাজ করে মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে। কেউ স্কুলেও যায় না। ফলে কিছুদিন পরই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অবিলম্বে এ গ্রামে শিল-পাটা তৈরির কাজ বন্ধের দাবি জানান।
আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, পাথরের ধূলিকণা নাক ও মুখ দিয়ে শরীরে ঢুকে ফুসফুসের স্বাভাবিক কাজকে ব্যাহত করে। পরে ধীরে ধীরে তা যক্ষার রূপ নেয় এবং এক সময় মৃত্যু অবধারিত হয়।
এ থেকে উত্তরণে তিনি শ্রমিকদের মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লোভস পড়ার পরামর্শ দেন।
তবে তিনি আরও জানান, খালি গায়ে বা উন্মুক্ত সাধারণ পদ্ধতিতে একাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একমাত্র মেশিনের সাহায্যে একাজ করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।