রবিবার ● ১০ জুন ২০১৮
প্রথম পাতা » খাগড়াছড়ি » পাহাড়ে দুই মাসে ১৭ খুন : অপহরণ-৩০
পাহাড়ে দুই মাসে ১৭ খুন : অপহরণ-৩০
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: (২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ বিকাল ৫.৪০মি.)পাহাড়ে আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চুক্তি পক্ষের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস-সন্তু লারমা) পার্বত্য চুক্তি বিরোধী আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-প্রসিত),ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস- এমএন লারমা) গ্রুপের চতুরমুখী দ্বন্দ্ব ও কোন্দল তীব্র হয়ে উঠেছে। এই চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের দ্বন্দ্বে ২০১৮ সালের গত এপ্রিল ও মে মাসে খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৭ জন খুন হয়েছে।
এছাড়াও ৩০ জনকে অপহরণের অভিযোগ রয়েছে।
তারপরও সরকার,গোয়েন্দা সংস্থা সমুহ এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা রহস্যজনক। আবার আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করছে বলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের ধারনা।
পার্বত্য চুক্তি করা হয়েছে বিগত ২০ বছর আগে যে কারণ দেখিয়ে পার্বত্য চুক্তি করা হয়েছিল তার মুল স্পিরিটকে পাশ কাটিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের নজর অন্যদিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে৷
বিতর্কিত বিষয় গুলিতে না গিয়ে বিগত ৫৮ বছরের ভিতর কি হয়েছে তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপত করা প্রয়োজন৷ সময় কাল হচ্ছে ১৯৬০- ২০১৮ সাল পর্যন্ত৷ কাপ্তাই বাঁধের ফলে রাঙামাটি সবডিভিশনের ৭০% লোকজন তাদের পূর্বপুরুষের ভিটা মাটি হারায়, এদের ভিতর সাওতাল, চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, বড়ুয়া, হিন্দু,ও মুসলমান ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর লোকজন ছিল৷ কাপ্তাই বাঁধের ফলে যে সব পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তারা কেউ বান্দরবান,খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বিভিন্ন থানায় বসতি গড়েছে৷ সেসময়ে পাহাড়ে গণতন্ত্র যেমন ছিলনা বর্তমানও গণতন্ত্র নেই৷ বর্তমানে পাহাড়ে চলছে ষড়যন্ত্রতন্ত্র।
১৯৬০-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাহাড়ে ছিল শান্তি, পাহাড়ি - বাঙ্গালী উভয়ের ভিতর ছিলনা কোন সম্প্রদায়কতা৷ সত্য বলতে কি পাহাড়ি বা বাঙ্গালী আলাদা জনগোষ্ঠীর লোক এধরনাটা তখন মানুষের মনে ছিলনা৷ উভয় জনগোষ্ঠীর লোকজন ছিল অতি সহজ সরল এবং শান্তি প্রিয়৷ ১৯৭৮ সাল থেকে সরকার পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী ও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বহিরাগত লোকজন এনে বসতি গড়ে তোলেন সরকারী অর্থে, তার পর থেকে শুরু হয় পার্বত্য অঞ্চলে নিত্য নতুন সমস্যা আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ৷
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হচ্ছে দেশের ভুখন্ড রক্ষার কাজে দায়িত্বে নিয়োজিত পদাতিক বাহিনী৷ পার্বত্য অঞ্চল হচ্ছে দেশের মুল ভুখন্ডের অংশ, পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী তারা তাদের নিয়ম মাফিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন৷ কিন্তু সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা গুলি অতি সুকৌশলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষার কথা বলে সরকার এবং স্বশস্ত্র সেনাবাহিনীকে অন্য পথে পরিচালনা করছে।যার মুল উদ্দেশ্য পার্বত্য অঞ্চল থেকে সংখ্যালঘুদের বিতারিত করা। পার্বত্য অঞ্চলে প্রথম দিকে সেনাবাহিনীর ভুমিকা নিরপেক্ষ থাকলেও এখন আর এ বাহিনীটি নিরপেক্ষ নন বলে অভিজ্ঞমহলের ধারনা৷
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস-সন্তু লারমা)’র মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পরই চুক্তিকে বিরোধিতা করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। পার্বত্য চুক্তির পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলে পার্বত্য চুক্তি পক্ষের প্রায় ৪শতজনের অধিক লোকজন পার্বত্য চুক্তি বিরোধীদের হাতে প্রাণ হারায়।
কৌশলে পার্বত্য চুক্তির পক্ষের লোকজন অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করে।
পাহাড়ে শুরু হয় আঞ্চলিক সংগঠন চুক্তি পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত হত্যা ও গুম।
পাহাড়ে আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চুক্তি পক্ষের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস-সন্তু লারমা) পার্বত্য চুক্তি বিরোধী আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-প্রসিত),ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস- এমএন লারমা) গ্রুপের চতুরমুখী দ্বন্দ্ব ও কোন্দল তীব্র হয়ে উঠেছে। এই চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের দ্বন্দ্বে ২০১৮ সালের গত এপ্রিল ও মে মাসে খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৭ জন খুন হয়।
এছাড়াও ৩০ জনকে অপহরণের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগও রয়েছে। এসব ঘটনায় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের আসামি করে কয়েকটি মামলা হলেও বেশিরভাগ পরিবার আতঙ্কে ও ভয়ে মামলাও করেনি।
বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন মূল ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামের আরেকটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইউপিডিএফ এর এই দুটি অংশ যখন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, তখন এ বছরের ৩ জানুয়ারি ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমাকে খাগড়াছড়ি সদরের স্লুইস গেইট এলাকায় হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনায় মিঠুন চাকমার আত্মীয় অনি বিকাশ চাকমা ৮ জানুয়ারি জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান তাতিন্দ্র লাল চাকমা ও সুধাসিন্ধু খীসাসহ শীর্ষ ৫ জনের নামে মামলা করলে ইউপিডিএফ মূল অংশের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয় জেএসএস (এমএন লারমা) অংশের। এই তিন সংগঠনের আধিপত্য ও বিরোধে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি উপজেলার রাঙাপানিছড়া এলাকায় দিলীপ কুমার চাকমা, ২১ ফেব্রুয়ারি জেলার দীঘিনালা উপজেলার জামতলীতে সাইন চাকমা প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন।
গত ২২ এপ্রিল পানছড়ির মরাটিলা এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে মাটিরাঙা ও গুইমারা উপজেলার ইউপিডিএফ সংগঠক সুনীল বিকাশ চাকমা ওরফে কাতাং ত্রিপুরা নিহত হন। এ সময় সুমন ত্রিপুরা নামের আরেকজন গুলিবিদ্ধ হন।
এছাড়া, দুদিন নিখোঁজ থাকার পর গত ১৮ এপ্রিল মাটিরাঙা উপজেলার ভাঙ্গামুড়া এলাকা থেকে নতুন কুমার ত্রিপুরা নামের সাবেক এক ইউপিডিএফ কর্মীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি সদরের আপার পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে সূর্য বিকাশ চাকমা নামের একজন নিহত হন। তিনি বিগত ইউপি নির্বাচনে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। গত ১৫ এপ্রিল দীঘিনালা ও বাঘাইছড়ি সীমান্তবর্তী জোড়া ব্রিজ এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে তপন চাকমা ও বিজয় চাকমা নামের দুই ইউপিডিএফ কর্মী খুন হন। খুন হওয়া এই ৭ জনই ইউপিডিএফের নেতাকর্মী বলে দাবি করেছেন সংগঠনের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক মাইকেল চাকমা।
এসব ঘটনায় সূর্য বিকাশ চাকমার স্ত্রী রিপনা চাকমা, নতুন কুমার ত্রিপুরার মেয়ে জয়িতা ত্রিপুরা সংশ্লিষ্ট খাগড়াছড়ি সদর থানায় ১৯ এপ্রিল ও মাটিরাঙা থানায় ১৮ এপ্রিল অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও আসামিদের নাম, ঠিকানা ও কোনও সংখ্যা উল্লেখ করেননি। অন্যদিকে, সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা কাতাং হত্যায় পানছড়ি থানায় এবং তপন চাকমা ও বিজয় চাকমা হত্যায় দিঘীনালা থানায় কোনও মামলা হয়নি।
সূত্রগুলো আরও জানায়, গত চার মাসে কমপক্ষে ২০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে সমঝোতা করে ছাড়া পেলেও বেশিরভাগ অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের কপালে কী ঘটেছে এখনও জানা যায়নি। পাহাড়ে যানবাহন তল্লাশিসহ বিভিন্নভাবে অপারেশন চালালেও এখন পর্যন্ত কাউকে উদ্ধার করতে পারেনি নিরাপত্তা বাহিনী। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে এসব খুন, অপহরণ ও গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার পরিজন ।
খাগড়াছড়ি জেলা ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা ঘটনার জন্য জেএসএস (সংস্কারপন্থী) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপকে দায়ী করে বলেন, ‘জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ে বাধা দিতে এবং নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থের জন্য ইউপিডিএফ নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। হত্যা, অপহরণ ও গুম করে ইউপিডিএফের আন্দোলন দমানো যাবে না।’
হত্যাকারীদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে কেন মামলা হচ্ছে না-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিহত নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা ভয়ে ও আতঙ্কে নাম প্রকাশ করে মামলা করতে পারছে না। তাছাড়া এসব হত্যাকান্ডর পেছনে শক্তিশালী কোনও সংস্থার ভূমিকাও থাকতে পারে। নানা বিষয় চিন্তাভাবনা করে মামলা করতে হয়। যেসব ঘটনায় মামলা হয়নি, মামলা করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দিন দিন প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব হত্যাকান্ড, অপহরণ, গুম চললেও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন।’
জেএসএসের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপের সদস্য সচিব জলইয়া চাকমা বলেন, তাদের কোনও নেতাকর্মী হত্যাকান্ডে জড়িত নয়। শুধু শুধু জেএসএস, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নেতাকর্মীদের দোষারোপ করা হচ্ছে উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত হলেই বলা যাবে কারা এসব ঘটনার জন্য দায়ী।
খাগড়াছড়ি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম এর প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আঞ্চলিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব ও বিরোধ এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।’ হত্যাকান্ডের ফলে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘দুর্গম ও নির্জন এলাকায় হত্যাকান্ড গুলো ঘটছে। পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার ও ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের সদস্যদের হাতে হস্তান্তর করছে। পরিবারের সদস্যদের থানায় এসে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হলেও কয়েকজন করেছে, কয়েকজন এখন পর্যন্ত থানায় আসেনি, মামলাও করেনি। আমরা পরিবারের সদস্যদের জন্য আরও অপেক্ষা করবো, তারা না এলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার প্রকৃত বর্ণনা কেউ দিতে পারেন না। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হচ্ছে। ফলে মামলার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত ও আদালতে সোপর্দ করতে একটু সময় লাগলেও প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
গত ৩ মে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সংস্কারপন্থী পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপের নেতা এডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
বৃহস্পতিবার ৩ মে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নানিয়াচর উপজেলা সদরে নানিয়াচর উপজেলা পরিষদের সরকারি বাস ভবণ থেকে বের হয়ে কার্যলয়ে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। এসময় নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এর গাড়ি চালক রূপম চাকমা গুলিবিদ্ধ হয়। নিজের বাসভবন থেকে বেরিয়ে কার্যালয়ে যাওয়ার পথে শক্তিমান চাকমাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়।এডভোকেট শক্তিমান চাকমা’র মৃত্য নিশ্চিত করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
এডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যার রক্তের দাগ না শুকাতেই আবারও এডভোকেট শক্তিমান চাকমা’র দাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বেতছড়ি নামক স্থানে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রিটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফের-গণতান্ত্রিক) আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা (৫২), সংস্কারপন্থী পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস-এমএন লারমা) যুব সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য তনয় চাকমা(৩১), মহালছড়ি যুব সমিতির সভাপতি সুজন চাকমা(৩০),সেতু লাল চাকমা (৩৬) এবং মাইক্রোবাসের চালক মো. সজিব (৩৫) দুর্বৃত্তদের গুলিতে মোট ৬ জন নিহত এবং ৭ জন আহত হন।
শুক্রবার ৪ মে বেলা ১২ টার দিকে গাড়িটি নানিয়ারচর উপজেলার আর্মি পাড়া নামক স্থানে বেতছড়িতে পৌঁছালে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা গাড়িটি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া গুলি মাইক্রোবাসের চালকের গায়ে প্রথমে লাগলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
এঘটনায় দীর্ঘ ৬ দিন পর ২ টি মামলা হয় । মামলায় ১১৮ জনের নাম উল্লেখ করে দুটি পৃথক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। বুধবার (৯ মে) দুপুরে নানিয়ারচর থানায় গত ৩ মে শক্তিমান চাকমা হত্যার ঘটনায় তার সহকারী রূপম চাকমা ও ৪ মে তপন জ্যোতি চাকমা হত্যার ঘটনায় তার আত্মীয় অচিন চাকমা বাদী হয়ে দুটি অভিযোগ দায়ের করেন। রাঙামাটি পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, হত্যাকান্ডের ৭ দিনের মাথায় শক্তিমান চাকমার হত্যা ঘটনায় নিহত শক্তিমানের সহকারী আহত রূপম চাকমা বাদী হয়ে ৪৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা সহ অপর ৪ জন হত্যাকান্ডের ঘটনায় তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার আত্মীয় অচিন চাকমা বাদী হয়ে ৭২ জনের নাম উল্লেখ করে নানিয়ারচর থানায় দুটি পৃথক অভিযোগ দায়ের করেন। জিআর মামলা নং: ১১৩/২০১৮ ও জিআর মামলা নং: ১১৪/২০১৮। এ মামলায় সুঅতিশ চাকমা প্রকাশ তন্টুমনি, পিতা মৃত অনিল চন্দ্র চাকমা,সাং: নলবুনিয়া, থানা: বাঘাইছড়ি, জেলা: রাঙামাটি পার্বত্য জেলাকে রাঙামাটি শহরের কল্যাণপুর থেকে এবং নানিয়াচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এর সচিব কিরণজ্যোতি চাকমা, পিতা মৃত গুনসিন্দু চাকমা, থানা : কোতয়ালী, জেলা: রাঙামাটি পার্বত্য জেলাকে নানিয়ারচর থেকে পুলিশ আটক করে। উভয়ে কয়েক দাফা পুলিশ রিমান্ডের পর বর্তমানে রাঙামাটি জেলহাজতে আটক রয়েছে।
সর্বশেষ, রাঙামাটি জেলার সাজেকে প্রতিপক্ষের গুলিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ এর তিন কর্মী সুগোরচোগা চাকমা ওরফে স্মুতি, ঝগড়াবিলের অটল চাকমা ও সুনিল চাকমা নিহত হয় ও কানন চাকমা নামে আরো একজন আহত হয়। এবিষয়ে ইউপিডিএফ প্রচার বিভাগের প্রধান নিরন চাকমা বলেন, আমাদের একদল কর্মী করল্যাছড়িতে একটি বাড়ি এক সাথে অবস্থান করছিল। এই খবর শুনে রাত ২টার দিকে জেএসএস (সংস্কারপন্থী) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর একদল সশস্ত্র ক্যাডার গ্রামটিতে অবস্থান নেয়। পরে ২৮ মে ভোর ৫টার দিকে ইউপিডিএফ এর কর্মীদের উপর গুলি করে তিন জনকে হত্যা করে।
বাঘাইছড়ির সাজেক থানার অফিসার ইনচার্জ নুরুল আনোয়ারও ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনা স্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে। তবে এ ঘটনার সাথে নিজেদের জড়ির থাকার কথা অস্বীকার করেছে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের মুখপাত্র মিটন চাকমা।
অপর দিকে ইউপিডিএফ এর রাঙামাটি জেলা ইউনিটের সংগঠক সচল চাকমা সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ঐদিন সোমবার সংস্কারবাদী জেএসএস-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক ইউপিডিএফ ও গণতন্ত্রিক যুব ফোরামের ৩ সদস্যকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তিনি অভিযোগ করে বলেন, রবিবার (২৭ মে) রাতে একটি মাইক্রোবাসযোগে সংস্কারবাদী জেএসএস-এর ১০-১২ জনের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল গঙ্গারাম করল্যাছড়ি এলাকায় যায়। সোমবার (২৮ মে) সকাল ৭টার দিকে ওঁৎ পেতে থাকা ওই সন্ত্রাসী দলটি সেখানে একটি বাড়িতে অবসস্থানরত ইউপিডিএফ সদস্যদের ওপর অতর্কিতে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ঘটনাসস্থলেই স্মৃতি চাকমা (৫০), অতল চাকমা (৩০) ও সঞ্জীব চাকমা (৩০) নিহত হন। নিহতদের মধ্যে সঞ্জীব চাকমা গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সদস্য। বিবৃতিতে সংস্কারবাদী জেএসএস-এর একটি বিপথগামী অংশকে উদ্দেশ্য করে সচল চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসের উপস্থিতি প্রমাণ করতে পরিকল্পিতভাবে সংস্কারবাদী পেলে-সুদর্শন-অংশুমান চক্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি পেলে-সুদর্শন-অংশুমান চক্রকে সংগ্রামী জনতার কাতারে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
এসবে কায়েমী শাসকশ্রেণি ও সেনাবাহিনীর একটি অংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ও ইন্ধন রয়েছে বলে উল্লেখিত সংগঠন সমুহের অভিযোগ ।
এসব ঘটনার পর থেকে পাহাড়ে সববাসরত সাধারন মানুষ আতঙ্কে রয়েছে, ঘটনার জন্য দায়ী সন্ত্রাসী যে হোক সেনাবাহিনীসহ স্থানীয় আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসন আপরাধিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন শান্তিপ্রিয় স্থানীয় জনগণ।