বৃহস্পতিবার ● ১২ জুলাই ২০১৮
প্রথম পাতা » ঢাকা » আগে শহীদকোটা পরে মুক্তিযোদ্ধা
আগে শহীদকোটা পরে মুক্তিযোদ্ধা
সিরাজী এম আর মোস্তাক, ঢাকা :: দেশ ও জাতির মুক্তির লড়াইয়ে যারা প্রাণ হারান, তারা শহীদ। লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার স্থপতি বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী দেশে ফিরে প্রথম ভাষণেই মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো ৩০ লাখ শহীদ ও লাখো সম্ভ্রমহারা মা-বোনের সংখ্যা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন। ভাষণটি অনলাইন দ্রষ্টব্য- https://www.youtube.com/watch?v=__CHdKMmQfo| (এ প্রসঙ্গে আরো অসংখ্য উদ্ধৃতি ও প্রমাণ বিদ্যমান)। বঙ্গবন্ধু শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। তিনি শহীদের সংখ্যা ভাষণেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। লাখ লাখ শহীদ থেকে ০৭ (সাত) জনকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি তথা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রদান করেছেন। একইসাথে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা থেকে ৬৬৯ জনকে তিন স্তরে (বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক) খেতাব প্রদান করেছেন। প্রদত্ত খেতাব অনুসারে, মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে শহীদের সংখ্যা অনেক কম। শহীদগণ মুক্তিযোদ্ধাদের অংশ মাত্র। কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই শহীদ নন। যুদ্ধে আহত, নিহত, গাজী, বন্দী, শরণার্থী ও সহায়তাকারী সবাই মুক্তিযোদ্ধা। অর্থাৎ শহীদগণ সবাই মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাগণ সবাই শহীদ নন। অতএব, ভুক্তভোগী ও কোটা বিবেচনায় শহীদের অসহায় স্বজনগণ অগ্রাধিকার পাবার কথা। তাদের বঞ্চিত করে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান-সন্ততি কোটা পাবার কথা নয়।
বঙ্গবন্ধুর সকল ভাষণ, কর্মকান্ড, শাসনপ্রণালী, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের খেতাবপ্রদান প্রভূতি বিশ্লেষণে সুস্পষ্ট হয়, তিনি প্রকৃতই বাঙ্গালি জাতির জনক। তিনি সারাজীবন বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে সর্বাত্মক সংগ্রাম করেছেন। তিনি শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরও সম্মান করেছেন। তিনি কখনো মুক্তিযোদ্ধা-শহীদ ভেদাভেদ করেননি। তিনি যদি তালিকা প্রণয়ন বা কোটা চালু করতেন, অবশ্যই ঘোষিত ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা মা-বোনের তালিকা করতেন এবং তাদের অসহায় সন্তানদের কোটা দিতেন। তখন অগণিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা সম্ভব ছিলনা। তাই তিনি কোনো তালিকাই করেননি। তাঁর সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বা কোটা ছিলনা। যদি কেউ দাবি করেন তিনি ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়েছেন, তা ইতিহাসের নিকৃষ্ট মিথ্যাচারিতা। কারণ, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন বা ভাতা প্রদানের চেয়ে শহীদ স্বজনদের অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
২৭ জুন, ২০১৮ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেন, ১৯৭২ সালে প্রচলিত ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু হয়েছে। বক্তব্যটি অনলাইন দ্রষ্টব্য-https://www.youtube.com/watch?v=cq5QU7YjpmQ| এর মাধ্যমে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের ঘোষণা দেন। তাঁর এ দাবি আদৌ সঠিক কিনা বা এতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি মুক্তিযোদ্ধা-শহীদ বৈষম্যের অপবাদ বর্তায় কিনা, তা জাতি বিবেচনা করবে।
বঙ্গবন্ধু যদি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও গেজেট প্রকাশ করতেনই, তবে সে সংখ্যা মাত্র ২লাখ কেন? তাঁর সকল বক্তব্য, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের খেতাব প্রদান এবং তাঁর মহান আদর্শ ও নীতিতে কোথাও ২লাখ মুক্তিযোদ্ধার অস্তিত্ব নেই। তাহলে কিভাবে তা চালু হয়েছে? কারা করেছে? এতে লাখো শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৩০ লাখ বীর শহীদের সংখ্যাটি মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। আর প্রচলিত ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটার ফলে দেশে বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। ১৭কোটি নাগরিকের মধ্যে মাত্র ২লাখ পরিবার শতকরা ৩০ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকোটা ভোগ করছে। আশ্চর্য্যরে বিষয় হল- প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী, ৩০ লাখ শহীদ ও লাখ লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন কারো নাম নেই। যেন শুধু ২লাখ তালিকাভুক্ত যোদ্ধাই দেশ স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধুসহ তালিকাবঞ্চিত বীর ও শহীদগণ মুক্তিযোদ্ধা নন। তাদের সকল প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম বৃথা। তাই তাদের স্বজনরা বঞ্চিত। এটি পৃথিবীতে সবচেয়ে অবাস্তবের একটি।
মাননীয় প্রথানমন্ত্রী এ সত্য অনুধাবন করেই ১২ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। অনলাইন দ্রষ্টব্য-https://www.bbc.com/bengali/news-37218470| এতে তিনি স্বার্থান্বেষী মহলের বাধার সম্মুখীন হন। তারা কোটা বাতিলের ঘোষণায় দেশজুড়ে শুরু করে আন্দোলন। এ আন্দোলনের মুখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা থেকে পিছপা হন। শহীদ স্বজনদের বঞ্চিত করে হলেও ২লাখ মুক্তিযোদ্ধাকোটা বহালের ঘোষণা দেন।
এরপরও মাননীয় প্রথানমন্ত্রীর কাছে জাতির প্রত্যাশা- তিনি বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সন্তান হিসেবে অবশ্যই তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের স্বীকৃতি, সংখ্যা ও কোটা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের সমাধান করবেন। প্রচলিত ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীদের কারণে লাখো শহীদের স্বজন ও আপামর জনতা যে বঞ্চণার শিকার হয়েছেন, তা নিরসন করবেন। বঞ্চিতদের সকল দাবি পূরণ করবেন। বিশেষভাবে চাকুরিতে প্রবেশে বয়স ৪৫ বা ৪০ করবেন। আর কোটা-বৈষম্য নয়, আগে শহীদকোটা তারপর মুক্তিযোদ্ধা- এ চিরন্তন সত্য প্রতিষ্ঠা করবেন। দেশের সকল নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ প্রজন্ম ঘোষণা করবেন।
[email protected]