শনিবার ● ১৪ জুলাই ২০১৮
প্রথম পাতা » গাজিপুর » সিসার গন্ধে সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হয় গাজীপুরে স্কুল শিক্ষার্থীদের
সিসার গন্ধে সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হয় গাজীপুরে স্কুল শিক্ষার্থীদের
গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি :: (৩০ আষাঢ় ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.২৮মি.) গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পূর্বখন্ড গ্রামের ঘনবসতি পূর্ণ এলাকায় একটি ব্যাটারি তৈরির কারখানা। পুরাতন ব্যাটারির সিসা গলিয়ে ব্যাটারি তৈরির কারখানার নির্গত বিষাক্ত লেড অক্সাইড গ্যাসে অসুস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থী, মরছে গবাদিপশু, নষ্ট হচ্ছে সবজি, ফল, গাছপালাসহ কৃষকের ধান ক্ষেত।
কারখানার একশ ফুটের মধ্যে কেওয়া পূর্বখন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পুরাতন ব্যাটারি ও সিসা পোড়ানোর সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুরু হয় নাক মুখ জ্বালা। বিষাক্ত ধোঁয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের মুহূর্তের মধ্যে কাশি, চোখ জ্বালা, বমি, মাথা ঘুরানো ও পেট ব্যথা শুরু হলে এতে অনেকটা বাধ্য হয়ে তাদের ছুটি দিতে হয়। এমন কর্মকান্ডে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
যখন সিসা পোড়ানো হয় নিঃশ্বাস চেপে আসে তাদের। বাতাসে ভাসে সিসার ঝাঁঝালো গন্ধ। হাঁচি কাঁশিতে দম বন্ধ হয়ে জ্ঞানও হারিয়েছে বেশ কয়েক শিশু শিক্ষার্থীরা। বাধ্য হয়ে মাস্ক পড়তে বলে শিক্ষকরা। দেখলে মনে হবে শুভ্র সাদা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালের দৃশ্য। বাধ্য হয়ে মাস্ক পড়তে বলে শিক্ষকরা।
বিদ্যালয়ে আসতেই অনিহা শিক্ষার্থীদের। এরকম পরিবেশের মধ্যে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষকরাও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চলে যেতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে লিখিত অভিযোগ করে জেলা প্রসাশকের দারস্ত হয়েছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী অভিভাবকরা।
১২ জুলাই বৃহস্পতিবার সরেজমিনে কেওয়া পূর্বখন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৪৫১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে দম বন্ধ পরিবেশে শ্রেণিকক্ষের দরজা জানালা বন্ধ করে পাঠদান করছে শিক্ষকরা। ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীরা মুখে মাস্ক পড়ে রয়েছে। পাঁচশ ফিট দূরত্বে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে ব্যাটারি রিসাইক্লিং করে তা থেকে নতুন ব্যাটারি উৎপাদন করছে গেলি ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি সিসা তৈরির কারখানা। আর এখানে ব্যবহৃত সিসা ও অন্যান্য কেমিক্যাল পোড়ানোয় চরম প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। স্কুলের শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ কারখানার আশপাশের মানুষসহ জীববৈচিত্র্য রয়েছে চরম হুমকিতে। পরিবেশ অধিদপ্তর কয়েকবার কারখানাটিকে জরিমানা করলেও থেমে নেই সিসা গলিয়ে ব্যাটারি উৎপাদন।
এসব বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক ইয়াসমিন আক্তার ২৮ জুন বৃহস্পতিবার গাজীপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর একটি আবেদন করেছেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার বলেন, কারখানা থেকে নির্গত সিসা যুক্ত ধোঁয়া এসে স্কুলের মাঠ অন্ধকার করে দেয়। চিমনি ছাড়াও কারখানার ভেতর থেকে উচ্চ ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত বাতাস স্কুল আঙিনায় এলে অনেক শিক্ষার্থী বমি করে অসুস্থ হয়ে যায়। এখানে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকায় শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝে মুখে মাস্ক লাগিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা আমার স্কুলের সকল শিক্ষক এক যোগে অন্যত্র চলে যেতে চাচ্ছে। গত বছরও পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছিলাম। কোনো কাজ হয়নি।
সহকারী শিক্ষিক সেলিনা রেজা বলেন, চেষ্টা করছি স্কুল বদলানোর। এখানে পড়ানো খুবই কষ্টকর। এক সময় এ স্কুলে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা সবাই চলে যেতে বাধ্য হবে।
গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক সালেহ ফয়সালের মতে, পুরাতন ব্যাটারি পোড়ানোর ফলে যে ধোঁয়া নির্গত হয় তাতে নানা ক্ষতিকর দিক রয়েছে। বিশেষ করে শিশুরা দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি এ রোগের প্রকোপে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যেতে পারে যে কোনো শিশু।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রায় ১৫ বিঘা জমি মাসিক ভাড়ায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে ওই ব্যাটারি কারখানা নির্মাণ করেন। কারখানা শুরুর সময় পোশাক কারখানা করা হবে বলে স্থানীয়দের বলা হয়। পরে সীমানা প্রাচীর তুলে ভেতরে সিসা গলিয়ে ব্যাটারি তৈরির কারখানা করা হয়। অনেক অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এছাড়া কৃষকের ধান গাছ লালচে আকার ধারণ করে, আশপাশের কয়েক কৃষকের গরু ঘাস খেয়ে মারাও গেছে।
কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক শিপনের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুরের সহকারী পরিচালক আবদুস সালাম জানান, আমাদের পর্যবেক্ষনে কারখানাটির কোনো বৈধ অনুমোদন নেই। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে চালাচ্ছে এ ব্যাটারি কারখানা। এই কারখানাকে আমরা জরিমানাও করেছিলাম। বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। সেখান থেকে নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ডঃ দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতেই তদন্ত করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব। পরিবেশের ক্ষতি করলে কোনো প্রতিষ্ঠানকেই ছাড় দেয়া হবে না।