শনিবার ● ১৪ জুলাই ২০১৮
প্রথম পাতা » তথ্যপ্রযুক্তি » বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার সমস্যা ও কিছু প্রস্তাব
বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার সমস্যা ও কিছু প্রস্তাব
এম এস হাবিবুর রহমান:: (৩০ আষাঢ় ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.৫৭মি.) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির কারণে আমাদের জীবনধারায় পরিবর্তন আসছে, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড অধিকতর গতিশীল হচ্ছে৷ এখন দৈনন্দিন জীবনে সফলভাবে চলতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানে দক্ষ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই৷
কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম সহ অন্যান্য যে সব দেশ ৫০ বছর আগেও উন্নয়নের মাপকাঠিতে প্রায় আমাদের কাতারে ছিল, তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আকাশচুম্বী সাফল্য লাভ করেছে৷ অথচ উন্নয়ন ও উৎপাদনবিমুখ পরিকল্পনার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি৷ অতীতে জাপান, জার্মানি থেকে যে পণ্য আমদানি করা হতো এখন সেটি করা হচ্ছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত কিংবা চীন থেকে৷ কথিত আছে, পাকিস্তান সরকার যখন পিএল৪৮০ থেকে গম পেয়েই খুশি হত তখন ভারত সরকার বিদেশিদের কাছে গমের পরিবর্তে বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তা চেয়েছিল৷ যার ফলশ্রুতিতেই আইআইটিগুলোর আবির্ভাব এবং সেগুলো আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতের পতাকাকে বিশ্বের সামনে উঁচু করে তুলেছে৷ স্বাধীনতার সময় যে ভারত ভালো মানের ব্লেড প্রস্তুত করতে পারতো না, এখন তারা চাঁদে রকেট পাঠিয়ে পানির অস্তিত্ব খুঁজে পায়৷
প্রতি বাজেটে আমরা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করি, শিক্ষায় বরাদ্দ সর্বাধিক৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষায় সাধারণত জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার পরামর্শ দেয়া হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বরাদ্দের সংখ্যাটি কোনো অবস্থাতেই ২ দশমিক ৫-এর বেশি হচ্ছে না৷ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, অনেক স্কুল কলেজে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নেই৷ অবশ্য দেশে শিক্ষিত বেকারেরও অভাব নেই৷ আগেই বলেছি, এত বড় জনসংখ্যার দেশে শিক্ষার মত বিশাল খাতকে এগিয়ে নেয়া মোটেই সহজ কাজ নয়৷ শুধু বরাদ্দ নয় তার ফলপ্রসু, অতি উচ্চ উৎপাদনশীল এবং কার্যকর ব্যবহারেই একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব৷ অতি সম্প্রতি শিক্ষাখাতে দেশ এবং জাতি যে সমস্যাগুলোর আবর্তে পড়েছে তার একটি হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস৷ এছাড়া আছে মাত্রাতিরিক্ত হারে কোচিং ব্যবসা, পাঠ্যপুস্তকে ভুল, দক্ষতা অর্জনে ছাত্রদের জন্য প্রণোদনার অভাব ইত্যাদি৷ একসময় আমাদের দেশেই বোর্ডের পরীক্ষায় মেধা তালিকা নামক ছাত্রদের জন্য লোভনীয় একটি বিষয় ছিল৷ হাজার হাজার ছাত্র মেধা তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য পড়ালেখা করতো৷ তার থেকে জনা বিশেকের নাম পত্রিকায় আসতো৷
সেই তালিকায় নাম ওঠানোর ইঁদুর দৌড়ের পিছনে নানারকম অপতৎপরতা থাকায় মেধা তালিকাই উঠিয়ে দেয়া হয়েছে – যা আসলে মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটার শামিল৷ শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ/ব্যয় কবে হবে তা আমাদের পরিসংখ্যান দেখে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই৷ উৎকর্ষ অর্জনের সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী চাবিকাঠি হলো সুস্থ প্রতিযোগিতা৷ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সুস্থ প্রতিযোগিতা উঠে গেছে৷ গান-বাজনার প্রতিযোগিতায় প্রথম হলে আপত্তি নেই, অন্য সকল রকম খেলাধুলা, সেখানেও আপত্তি নেই৷ আপত্তি শুধু পরীক্ষায় প্রথম হওয়াতে, যার নাকি বিশ্বাসযোগ্যতা নেই৷ এক নম্বর কম বেশি, সেতো শিক্ষকের মূল্যায়নে হতেই পারে৷ কিন্তু অন্য সকল মূল্যায়নেই আমাদের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে৷ একজন ছাত্র একবার গণিতে কিংবা পদার্থ বিজ্ঞানে ৯০-৯৫ পেলে তার পরের পরীক্ষায় ফেল করার সম্ভাবনা শূন্য৷ মেধাভিত্তিক কর্মকাণ্ডের নির্ভরযোগ্যতা এমনই৷ পক্ষান্তরে একজন ব্যাটসম্যান এক ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করলেও তার পরবর্তী ইনিংসেই শূন্য করতে পারে৷ কিন্তু সেই স্কোরলাইনে আমাদের দারুণ বিশ্বাস৷ আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় উৎকর্ষ অর্জনের যে প্রণোদনা ছিল, তা আমরা তুলে নিয়েছি৷ এখন মেধাহীন জাতিতে পরিণত হওয়ার পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে৷ কোনো ছাত্রকে শুধু ভাল বলতে যে আমাদের আপত্তি তা নয়, এমনকি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও ভালো বলতে আমাদের আপত্তি৷ একসময় এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে স্কুল-কলেজগুলোর র্যাংকিং করা হতো৷ অনুরূপ কোনো খোড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে এখন আমরা তাও তুলে দিয়েছি৷ সুস্থ প্রতিযোগিতা দিয়ে কী অর্জন করা যায় তার চমৎকার উদাহরণ হলো পৃথিবীর পাঁচ শতাংশ মানুষের দেশ যুক্তরাষ্ট্র৷ প্রতিবছর তারা নিয়মিতভাবে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং করে থাকে এবং সেটি প্রতিটি বিষয়ে, প্রাক-স্নাতক, কিংবা স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষায়, গবেষণা সহ আরো অনেকভাবে৷ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৫০টি আসে সেই দেশ থেকে৷ এছাড়া জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, ভারত, পাকিস্তান, ইউরোপীয় দেশগুলো সবাই বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের র্যাংকিং করছে৷ র্যাংকিং নেই শুধু বাংলাদেশে৷ এতে ফলাফলও পরিষ্কার৷ শ্রেষ্ঠ ২০০-৫০০ অথবা হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই৷ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের শিক্ষার মান কোনো দাগ কাটতে পারছে না৷ এটা নিয়ে শিক্ষাঙ্গনের কর্তাব্যক্তিদের দারুণভাবে ভাবতে হবে৷
আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ ছিল, পরীক্ষণের ব্যবস্থা ছিল৷ এখন পরীক্ষণের সুযোগ নাকি সংকুচিত হয়ে এসেছে৷ ল্যাবরেটরির পূর্ণ নম্বর কোনো পরীক্ষণ না করেই যেহেতু পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ব্যবহারিকের নম্বর উঠিয়ে দেয়ার চিন্তা করছে৷ এতেই কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষার দীনহীন অবস্থার কথা যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে৷ নকলের প্রবণতা কমে গেলেও শোনা যাচ্ছে, এটা কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে যাচ্ছে৷ নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার উত্তর যেহেতু ছোট, সেটা ছাত্ররা না শিখেই নানাভাবে শুদ্ধ উত্তর লিখে ফেলতে পারছে৷ একসময় প্রতিটি স্কুলের শ্রেষ্ঠ ছাত্ররা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য রোমাঞ্চ অনুভব করতো, এখন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা পদার্থ বিজ্ঞান কিংবা রসায়ন শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ব্যবসা শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করছে৷ এভাবে দেশের পয়সায় অর্জিত বিদ্যার সঠিক প্রয়োগের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ ৩০-৪০ বছর পূর্বে এরকম প্রবণতা ছিল না৷ এতে বোঝা যায়, বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী হওয়ার মত প্রণোদনা শিক্ষার্থীরা দেখতে পারছে না৷ ভারতের মতো ‘স্বদেশি পণ্য কিনে হও ধন্য’ আন্দোলন শুরু করতে হবে৷ দেশে এত মোবাইল, কিন্তু মোবাইল তৈরির একটি কারখানা পর্যন্ত নেই৷ একই কথা প্রযোজ্য কম্পিউটারের জন্য৷ যদিও আমাদের ব্র্যান্ড দোয়েল ল্যাপটপ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাজার থেকে উধাও হয়েছে৷ বিজ্ঞান বিভাগগুলোতে স্কুল কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যাও কমেছে৷ অথচ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই৷ স্কুল, কলেজের পড়ালেখার মান যে কমেছে তার একটি প্রমাণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বোর্ডের সর্বোচ্চ গ্রেডধারি ছাত্রদের অসহায় পরিণতি৷
প্রশ্নপত্র ফাঁস, পাঠ্যপুস্তকে যত্রতত্র ভুল, বোর্ডের মূল্যায়নে সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়েও ছাত্রদের দক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের নাভিশ্বাস অবস্থা এবং সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে ব্যর্থতা, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেরই কোচিং সেন্টারমুখী গতি, বেআইনি সহায়ক পুস্তকের শক্তিশালী অবস্থান, এগুলো সবই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নেতিবাচক দিক, যার ফলে জনগণ আস্থা রাখতে পারছে না৷ বেশ কয়েক বছর পূর্বে শিক্ষা কমিটি ন্যূনতম সময়ে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল, যেখানে দেশের আগ্রহী জনগোষ্ঠীর মতামতও গ্রহণ করা হয়েছিল৷ তবে এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ নজরে পড়ছে না৷
বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষারল মানের এই ক্রমাবনতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে কিছু কিছু পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করার প্রকল্প গ্রহণ করেছে৷ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যাতে ফাঁস হয়ে না যায় তার জন্য প্রাযুক্তিক সমাধান বের করতে উদ্যোগী হয়েছে৷ উত্তরপত্র মূল্যায়নেও যাতে সমতা বিধান করা যায় সেজন্য মূল্যায়নকারীদেরও মডেল মূল্যায়ন দিয়ে সহায়তা করছে৷ বিগত তিনবছর ধরে স্কুল-কলেজে ভর্তি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একযোগে স্বচ্ছ্বতার সঙ্গে করা হচ্ছে৷ অধিকতর মানসম্পন্ন স্নাতকদের শিক্ষকতা পেশায় আসতে উৎসাহিত করতে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো করার প্রতিশ্রুতি দীর্ঘদিন যাবত ঝুলে আছে৷ শিক্ষায় বরাদ্দ যে কার্যকর হতে পারছে না তার পেছনে রয়েছে দুর্নীতি এবং অঙ্গীকারের অভাব৷ সরকারের উপবৃত্তি প্রকল্পের অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মায়েদের অ্যাকাউন্টে নির্ভুলভাবে যাচ্ছে৷ শিক্ষার নানা প্রকল্পে মোবাইল এবং তথ্যপ্রযুক্তির জোরালো ব্যবহার শুরু করা দরকার৷
বিজ্ঞান শিক্ষা তথা শিক্ষার সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য যেসকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তা হলো:
১. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়সমূহে ছাত্রদের অনাগ্রহ অত্যন্ত শঙ্কার বিষয়৷ একসময় দেশের শ্রেষ্ঠ ছাত্ররা বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে চাইত৷ এখন সম্ভবত এই ক্ষেত্রে চাকুরির অভাব তাদের অন্যান্য বিষয়ের দিকে আকৃষ্ট করছে৷ এমনকি বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসিতে ভালো জিপিএ নিয়ে পাস করার পরও বাণিজ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে৷ দেশকে উন্নত করতে হলে উৎপাদনের বিকল্প নেই, আমাদের উৎপাদনমুখী হতে হবে, কলকারখানা তৈরি করতে হবে, আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে, দেশি পণ্য ব্যবহারের সংস্কৃতি চালু করতে হবে৷ এরফলে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে৷ বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে হলে সমাজে বিজ্ঞানীদের পুরস্কার ও মর্যাদার ব্যবস্থা করতে হবে৷ তবে শুধু সোনালি আস্তরণে লোহার টুকরা পুরস্কার দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা যাবে না৷
২. সাংহাইয়ের জিয়াওটং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি দুইবছর পর পর অনুষ্ঠিত বিশ্বমানের একটি কনফারেন্সে অংশ নেয়া স্বনামধন্য শিক্ষাবিদদের স্লোগান ‘বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে’৷ এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্জনের উপর ভিত্তি করে গণমাধ্যমে বহুল প্রচার নিশ্চিত করে তাদের র্যাংক প্রকাশ করা ও সেই অনুযায়ী পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে৷
৩. যে পাঠ্যপুস্তকের দশ লক্ষ কপি ছাপানো হবে তা তৈরিতে ৩/৫ মাস সময় নয়, ৩/৪ বছর সময় দিতে হবে, যাতে করে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ অভিজ্ঞতাপুষ্ট শিক্ষাবিদ জাতিকে একটি চমৎকার পাঠ্যপুস্তক উপহার দিতে পারেন৷ বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে উন্নতমানের ছবি সংযোজন করে আরও আকর্ষণীয় করতে হবে৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিজ্ঞানসহ অনেক বিষয়ের যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব রয়েছে৷ জরুরি ভিত্তিতে এর সমাধানের জন্য টিভিতে শিক্ষা চ্যানেলের মাধ্যমে সকল শ্রেণি ও সকল বিষয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করা উচিত, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্ররা টিভি কক্ষে বসে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে দেখবে ও পাঠ গ্রহণ করবে৷
৪. শ্রেয়তর কাজের উপযোগী মস্তিষ্ককে যাতে করে তথ্যের সংরক্ষণাগার হিসাবে ব্যবহার করা না হয় তার জন্য পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সারা বছর ধরে গবেষণা করতে হবে৷ আমাদের ছাত্রদের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে হবে৷ এমন সকল প্রশ্ন করতে হবে যার উত্তর মুখস্ত করে দেওয়া সম্ভব না হয় এবং যা ছাত্রদের জিজ্ঞাসু হতে বাধ্য করে৷ প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্যও ভাল সম্মানী রাখা দরকার৷
৫. বর্তমানে প্রচলিত উত্তাপহীন, শিক্ষায় আগ্রহী করতে ব্যর্থ জিপিএ সিস্টেমের উন্নয়ন সাধন করতে হবে, যেন আমরা একই সাথে অধিকতর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মেধাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি৷ আন্তর্জাতিক গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের কঠিন আসর থেকে আমাদের ছাত্ররা যে নিয়মিতভাবে পদক আনতে পারছে তা থেকে প্রতীয়মান যে আমাদের ছাত্ররা সফলতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম৷ সুতরাং অধিক সংখ্যক ধাপের জিপিএ সিস্টেম ও চ্যালেঞ্জিং প্রশ্নপত্র দিয়ে আমাদের তরুণদের মেধা শানিত করে তুলতে হবে৷
৬. ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তির মাত্রারিক্ত প্রবণতার কারণে সারা দেশে ভাল স্কুল-কলেজ গড়ে উঠছে না৷ ছেলেমেয়েদের দূর-দূরান্তরে ভর্তি করার ফলে তাদের ও অভিভাবকদের যেমন যাতায়াতে ভোগান্তি হচ্ছে, তেমনি সমাজের অন্যান্য শ্রেণির নাগরিকরা যানজটের শিকার হচ্ছে৷ এই অবস্থায় উন্নত দেশসমূহের, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের মতো স্কুল-কলেজে ভর্তি, এলাকা অনুযায়ী হওয়া উচিত৷ এর ফলে সারা দেশে স্কুল-কলেজগুলোর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে৷ তাছাড়া তৈরি হবে উৎকর্ষ অর্জনের সুস্থ প্রতিযোগিতা৷
৭. স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হতে হলে যথাযথ নৈতিকতাসহ শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে যেন শিক্ষকরা কমিটির সদস্যদের উপদেশ থেকে উপকৃত হয়৷ স্কুলের ফলাফল যদি খুব খারাপ হয় তাহলে ব্যবস্থাপনা কমিটি পরিবর্তন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে৷ কোনো একক ব্যক্তিকে দুইটির অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে রাখাও যুক্তিযুক্ত নয়৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় এলাকার উচ্চ শিক্ষিত ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ নাগরিকদের যুক্ত করতে হবে৷
৮. ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারসহ সর্ববিষয়ে বিজয়ীদের নিয়ে অলিম্পিয়াড ধরনের পরীক্ষা উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে আয়োজন করা উচিত৷ বিজয়ী ছাত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও আকর্ষণীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা করা উচিত৷
৯. এর পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্যতর করে গড়ে তোলা উচিত৷ স্কুল-কলেজের ভৌত অবকাঠামো বিনির্মাণেও তৎপর হওয়া উচিত৷ ছাত্রদের সর্বদা জ্ঞানার্জনে আকৃষ্ট করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে অত্যন্ত উদ্দীপনামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত৷ যেমন প্রতিবছরই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিটি স্কুল-কলেজকে র্যাংক দেওয়া এবং গণমাধ্যমে তার বহুল প্রচার নিশ্চিত করা উচিত, যেন শুধু ছাত্র-শিক্ষকেরাই নয়, অভিভাবক ও এলাকার জনগণও স্কুল-কলেজের ফলাফলের বিষয়ে অধিকতর আগ্রহী হয়ে ওঠে৷
একসময় উন্নয়নের মাপকাঠিতে সমকাতারে দাঁড়িয়ে থাকা কোরিয়া, মালয়েশিয়া শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অনেক উন্নত হয়েছে৷ আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, দেশের মানুষের কায়িক পরিশ্রমে আমরা এমনকি মধ্যম আয়ের দেশও হতে পারবো না৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথটিই আমাদের উন্নয়নের পথ৷ মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে একমাত্র মানবসম্পদ উন্নয়নেই আমাদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে৷ তাই শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে৷ আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার সুকঠিন দায়িত্ব যারা নিয়েছেন দেশের উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব তারা অনুধাবন করবেন এবং শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তারা আমাদের দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবেন, এটাই কামনা৷
তথ্যসুত্র: বিভিন্ন অনলাইন ।