রবিবার ● ১৫ জুলাই ২০১৮
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে সুন্দরবন ঘেষে আশ্রয়ণ প্রকল্প: হুমকিতে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য
আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে সুন্দরবন ঘেষে আশ্রয়ণ প্রকল্প: হুমকিতে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য
বাগেরহাট অফিস :: (৩১ আষাঢ় ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.৩৮মি.) সুন্দরবনের জমি দখল করে চলছে বিশেষ আশ্রায়ণ প্রকল্প-২ নির্মাণের কাজ। আর এ প্রকল্পের সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। সুন্দরবনকে ঘিরে দখল প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকলে হুমকির মুখে পড়তে পারে বিশ্বের একক বৃহত্তর এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এছাড়া বনের চার পাশে এ ধরণের জনবসতিপূর্ণ আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবন নতুন করে গভীর সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা বন বিশেষজ্ঞদের। তবে, বন বিভাগের পক্ষ থেকে এ প্রকল্পের বিরোধীতা করা হলেও তা আমলে নিচ্ছেনা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে প্রকল্পটির কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হলেও তা উপেক্ষা করে পূর্ব বনের সোনাতলা এলাকার ৫ একর জমিতে মাটি ভরাটের কাজ অব্যাহত রেখেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। অপরদিকে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উপজেলার সাউথখালী ও রায়েন্দা ইউনিয়নের শতাধিক ছিন্নমূল পরিবারের আশ্রয় মিলবে, এমন সুযোগকে পুঁজি করে ইতোমধ্যে স্থানীয় একটি স্বার্থন্বেষী মহল অর্থ বাণিজ্য শুরু করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন সাউথখালী ইউনিয়নের ১০ নং সোনাতলা মৌজার আওতাধীন ৫৩২২ নং মূল ও ৮০, ৮১, ৮২ ও ৮৩ নং বাটা দাগের ৫ একর সম্পত্তিতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বিশেষ আশ্রায়ণ প্রকল্প-২ নির্মাণের জন্য চলতি বছরের মার্চে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করে প্রশাসন। যা সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে মাত্র ৫’শ ফুট দূরে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট নষ্ট অথবা পরিবর্তন হবে এমন কোন কাজ করা যাবেনা। এছাড়া ২০১৩ সালে শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের দাসের ভারানি এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ নামের একই ধরণের একটি প্রকল্পের কাজ বাতিল করা হয়। ২০০৫ সালে সুন্দরবনের বনজ সম্পদ রক্ষা তথা জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে সোনাতলা-১, ২, ৩ আদর্শ গ্রাম প্রকল্প স্থগিত করা হয়। এছাড়া ২০০৪ সালে ভোলা নদীর চরে বাগেরহাট জেলা প্রশাসন আদর্শ গ্রাম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) উচ্চ আদালতে একটি রিট করলে সেই কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। সুন্দরবন ঘেষে ভোলা নদীর চরে নতুন করে বসতি ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ইতোমধ্যে বন বিভাগ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসনকে আলাদা চিঠি দিয়ে প্রকল্প বাতিলের অনুরোধ জানিয়েছেন।
বন বিভাগের মতে, জেগে ওঠা চরের জমিতে এ ধরণের বসতি স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়া ছিন্নমূল মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে সম্পূর্ণ ভাবে বনের উপর নির্ভরশীল হবে। এতে বনজ সম্পদসহ জীববৈচিত্র ধ্বংসের আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি বনের বাঘ লোকালয়ের গ্রাম গুলোতে ঢুকে প্রাণহানি ঘটাতে পারে।বন সংলগ্ন সোনাতলা এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়ের বয়াতী ও জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তারা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে বন বিভাগের ওই জমি ইজারা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে মৎস্য ঘের তৈরি করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কোন ধরণের নোটিশ না দিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের ওই ঘেরে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। এ বিষয় দীপ্ত বাংলা হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান ও শরণখোলা উপজেলার বাসিন্দা মো. রেজাউল করিম খান রেজা বলেন, সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষার জন্য তিনি জনস্বার্থে চলতি বছরের মার্চে হাইকোর্টে ৩০৮৮/২০১৮ নং একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। আদালত ভূমি সচিব, বন ও পরিবেশ সচিব, মহা পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রধান বন সংরক্ষক, পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও), বিভাগীয় কমিশনার, খুলনা, জেলা প্রশাসক, বাগেরহাট ও শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ওই প্রকল্পের কাজ স্থগিতসহ সুন্দরবন ঘেষে যে সকল অবৈধ জন বসতি গড়ে উঠেছে তা উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। কিন্তু, সংশ্লিষ্টরা তা উপেক্ষা করে প্রকল্পটির কাজ অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া ওই এলাকাটিতে প্রশাসনের তেমন কোন নজরদারি নেই। সেক্ষেত্রে দস্যুতা, বনজ সম্পদ লুট, বন্যপ্রাণি পাচারসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ড বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে বন সংলগ্ন এলাকায়। প্রকল্পটি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা বন সংলগ্ন সাউথখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মোজাম্মেল হোসেন বলেন, অসহায়, দুঃস্থ, ভূমিহীন ও ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়ের জন্য ওই প্রকল্পটি তৈরি করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাঁধা না দিয়ে সকলের সার্বিক সহযোগিতা করা উচিৎ। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রত্যয়ন নেয়া হয়েছে। সেখানে জমির মালিক যে বন কর্তৃপক্ষ তা উল্লেখ নেই। সে অনুযায়ী ওই এলাকায় প্রকল্পটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিংকন বিশ্বাস বলেন, ভূমি আইন অনুযায়ী নদী ভরাট হওয়া সম্পত্তির মালিক জেলা প্রশাসক। এছাড়া সাধারণ জন বসতিতে বনের উপর প্রভাব পড়ার কথা নয়। তবে, তিনি আদালতের কোন নির্দেশনা পাননি। এ বিষয় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ভোলা নদীর জেগে ওঠা চর সুন্দরবনের অংশ। এখানে বন্দোবস্ত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। বন ঘেষে এভাবে বসতি গড়ে ওঠার প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে হুমকির মুখে পড়বে ঐতিহ্যবাহী এ ম্যানগ্রোভ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর পরিচালক মো. আবুল কালাম শামসুদ্দিন জানান, নির্মাণাধীন প্রকল্পের সম্পত্তি সুন্দরবনের কিনা তা তিনি জানেন না। এছাড়া প্রকল্প তৈরির দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের। তবে, প্রকল্পটির প্রয়োজনীয় ফাইলপত্র না দেখে তার কিছুই বলা সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।