বুধবার ● ১৮ জুলাই ২০১৮
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ১০ লক্ষাধীক টাকার তহবিল তছরুপের অভিযোগ
শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ১০ লক্ষাধীক টাকার তহবিল তছরুপের অভিযোগ
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :: (৩ শ্রাবণ ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৯.০২মি.) ঝিনাইদহের ঐতিহ্যবাহী শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে গত ১ বছরে ১০ লক্ষাধীক টাকার তহবিল তছরুপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এসব অভিযোগ উঠেছে বে-সরকারী এই বিদ্যালয়টির খোদ প্রধান শিক্ষিকা দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন রেজুলেশনে টাকা উত্তোলনের স্বাক্ষর বিহীন নোটশীট, অনিয়ম আর জাল-জালিয়াতির ৩৫ পৃষ্ঠার বেশ হিসাব-নথি ফাঁস হয়ে গেছে। এসব নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। অনিয়মের প্রতিবাদে শিক্ষকরা ক্লাস বর্জনও করেছে, এরপর বিদ্যালয়ের সেসব অনিয়মের লিখিত ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে শিক্ষা অফিসার, জেলা প্রশাসক, শিক্ষা বোর্ড সহ দুদকেও। ম্যানেজিং কমিটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন তার স্বাক্ষর ছাড়ায় রেজুলেশন, চেক সহ সমস্ত তহবিল- হিসাবে নানা জালিয়াতি করেছে প্রধান শিক্ষিকা। আর বিদ্যালয়টির বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত কমিটি গঠন সহ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসের কথা জানিয়েছে। এদিকে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষিকার দাবী রেজুলেশান আর ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই স্কুল পরিচালনা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের আনীত অভিযোগ মিথ্যা। শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ফজলুর রহমানের লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, রেজুলেশান ও নোটশীটে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির সহি-স্বাক্ষর ছাড়াই কখনো টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কমিটির অনুমোদন ছাড়া অর্থ ব্যয় আবার কখনো সাধারণ তহবিল ব্যতিত বিদ্যালয়ের নামে কৌশলে নতুন একাউন্ট করে চেকে একক স্বাক্ষরেই চলছে টাকা উত্তোলন। কখনো বা বিল-ভাউচার জালিয়াতি, ফর্মফিলাপ-রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, নীতিমালার বাইরে হ্যান্ডক্যাশ উত্তোলন, নির্ধারিত নোটবই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা, বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা তুলে আত্মসাৎ, ৫০ শতাংশ হারে বেতন উত্তোলন এমন হাজারো অভিযোগ উঠেছে ঝিনাইদহের ঐতিহ্যবাহী শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহার সহ শিক্ষক-কর্মচারীর অনেকের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণেরও অভিযোগ উঠেছে প্রধান শিক্ষিকা দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে। বিদ্যালয়ের বেতন-সেশন হঠাৎ দ্বিগুন বৃদ্ধি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রধান শিক্ষিকা ছুটিতে থাকা কালে নিয়ম অনুযায়ী সহকারী প্রধান শিক্ষকের উপর দায়িত্ব দেয়ার নিয়ম থাকলেও জুনিয়র শিক্ষকদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয় যা চাকুরী বিধি লঙ্ঘন বলে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে। গত ১১ মাসে ৪জন শিক্ষক কে অন্যায় ভাবে শোকজ নোটিশ দেয়া হয়েছে, এছাড়া তার অনুগত না থাকলেই তার বিরুদ্ধে শোকজের হুমকি দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তার মতের বাইরে কোন শিক্ষক-কর্মচারীকে মানবিক কারণেও ছুটি মঞ্জুর করেন না বলে জানানো হয়েছে। সহকারী প্রধান শিক্ষক সহ কয়েক শিক্ষকের নিয়োগ ফাইল, মূল সনদ গায়েব করে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। এমন কি গত ১১জুনে শৈলকুপা উপজেলার মাসিক আইন-শৃংখলা মিটিংএ প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল প্রধান শিক্ষিকার অনিয়ম দুর্ণীতির প্রসঙ্গ ! এই মিটিং এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন উপজেলা চেয়ারম্যান শিকদার মোশাররফ হোসেন সোনাও। প্রধান শিক্ষিকা দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের জেএসসি,এসএসসি ও নবম-দশম শ্রেণীর ফর্ম পূরনের ২০হাজার, ১লাখ৩৭ হাজার, ১৮হাজার৪শ২০ ও ৮হাজার৮শ টাকা জমা হয়নি। বিদ্যালয়ের নামে সোনালী ব্যাংকে(একাউন্ট নং-২৪২১৬০১০২১২৯৯) নতুন একাউন্টে প্রধান শিক্ষিকার একক স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা যাবে, সেখানে রাখা হয়েছে ৬৩ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে পরীক্ষার খাতা-বই বিক্রি, জরিমানা আদায়, প্রাইভেট পড়ানো বাবদ শিক্ষকদের কাছ থেকে মোট ৮ হাজার ৮শ, ১৫ হাজার ৭৫০, ১৫ হাজার ৫শত ও ২৬ হাজার টাকা জমা হয়নি। ড্রাম ক্রয় বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০ টাকা আদায় হলেও ভাউচারে আবারো১৫হাজার টাকা, বিদেশ সফরের পর ব্যক্তিগত আপ্যায়ন বাবদ ১০হাজার টাকা খরচ দেখালেও ভাউচারের মাধ্যমে আবারো১০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে জেসেসি ও এসএসসি ফিস বাবদ২৭ হাজার৮শ ৫০, ৬ষ্ঠ শ্রেণীর রেজি: বাবদ ১০হাজার টাকা জমা দেয়া হয়নি। বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষকিা ১শত পার্সেন্ট বেতন ভাতা পাওয়ার পরেও নন এমপিওদের মতো ৫০ শতাংশ হারে প্রতিমাসে ১৪ হাজার ৫শ করে অবৈধ ভাবে ৫৮ হাজার টাকা ও প্রতিমাসে হ্যান্ডক্যাশে ৫ হাজার করে ৫৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৮ সালে শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রাইভেট বাবদ ১৫ হাজার, ভুয়া ভাউচারে সাউন্ডসিস্টেম বাবদ ৫ হাজার, এসএসসি বিজয়ীদের উপহার বাবদ ছাত্রীদের কাছ থেকে ২০হাজার টাকা আয় হলেও ভুয়া ভাউচারে আবারো ২১হাজার ৭শত ২৫, বেঞ্চ ক্রয় বাবদ ভুয়া ও কাটাকাটির ভাউচাওে ১০হাজার , এসএসসি উন্মুক্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১শ টাকা হারে চাদা ২৪হাজার ৫শ, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জরিমানা বাবদ ৬০ হাজার টাকা ও ছাত্রী ভর্তি বাবদ ৩লাখ টাকার বেশী জমা করা হয়নি হিসাবের খাতায়। এসএসসির প্রশংসা পত্র বাবদ ২৫০ টাকা হারে ৪৩ হাজার ২৫০ টাকা আয় হলেও তা হিসাবে জমা করা হয়নি। এভাবে ১০ লক্ষ ২০ হাজার টাকার উপরে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগে বিস্তারিত বিবরনে জানানো হয়েছে। ফর্মফিলাপের জন্য বোর্ড নির্ধারিত ১৫৭৫ টাকার বাইরে ১৯৪০ টাকা হারে কখনো ৩হাজার থেকে ৪হাজার৫শ টাকা পর্যন্ত করে আদায় করা হয়েছে বলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। বাধ্যতামূলক ভাবে বিভিন্ন কোম্পানীর গাইড বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সেখান থেকে আসা লভ্যাংশ সব টাকা আত্মসাত করা হয়েছে এমনটি অভিযোগে জানানো হয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগন বিদ্যালয় পরিদর্শন ও নীরিক্ষা করে গেছেন। সেখানেও তেল খরচের ভাউচার বিল দেখিয়ে রেজুলেশনের মাধ্যমে টাকা সমন্বয় করা হয়েছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে তিনি প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই এমন অনিয়ম হচ্ছে বলে জানান ম্যানেজিং কমিটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি কাজী আশরাফুল আজম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, হাজারো ত্রুটি নিয়ে রেজুলেশান, নোটশিট, চেক সহ অন্যান্য কাগজপত্র আনা হতো, তার অজান্তে একক স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে বলে জানান। তিনি আরো বলেন, এখন স্কুল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাড়িয়েছে এই শিক্ষিকা আসার পরে, তার মতো একজন মানুষ এখনে থাকলে স্কুলটির ভরাডুবি হবে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শৈলকুপা উপজেলা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপিঠে বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১১শত, আর শিক্ষক কর্মচারীর সংখ্যা ৪২জন। অর্থ কেলেংকারী, তহবিল তসরুপ সহ অনিয়মের লিখিত অভিযোগে বিদ্যালয়ের রেজুলেশান, নোটশীট, ব্যাংক,একুইটেন্স খাতা ও অফিসের তথ্যসূত্রের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে ছাত্রী ভর্তি, ফর্ম ফিলাপ, অনুষ্ঠান, জরিমানা সহ বিভিন্ন খাতের নামে ১০লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও। শৈলকুপা শহরে ফুটপাতে কলার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন আব্দুর রশিদ, তিনি জানান তার মেয়ের ফর্মফিলাপের জন্য ৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে প্রধান শিক্ষকের কাছে, জোর অনুরোধ করার পরেও তা শোনা হয়নি, তিনি আরো বলেন তার মেয়ে বিভিন্ন খেলাধুলায় ভাল ছিল, এসব দিকে তাকিয়েও কোন টাকা কম নেয়া বা বোর্ড নির্ধারিত টাকা নেয়া হয়নি। সাতগাছি গ্রামের নজরুল ইসলামের মেয়ে ডলি খাতুন জানান, ফর্মফিলাপের ১৮শ টাকার স্থলে কোচিং এর ১হাজার টাকা সহ ৩৮শত টাকা নেয়া হয়েছে, অথচ কোন ধরনের কোচিং করানো হয়নি। বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা যোগদানের পর চিরায়িত প্রথা ভেঙ্গে পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের তহবিল সংক্রান্ত যৌথ একাউন্টের বাইরে নতুন করে প্রধান শিক্ষিকার একক স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা যাবে মর্মে খোলা একাউন্ট নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা ও শিক্ষানুরাগীদের মাঝে। শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক শামসুল ইসলাম বলেন, তার সময়ে একক স্বাক্ষরের কোন একাউন্ট ছিলনা এবং বিদ্যালয়ের সহ প্রধান শিক্ষক সহ সবার সাথে আলোচনা ও রেজুলেশান সাপেক্ষে হিসাব পরিচালনা করা হতো । তিনি বলেন বিদ্যালয়টির সুনাম যাতে ক্ষুন্ন না হয় সেদিকে সবার নজর দেয়া দরকার। আর সোনালী ব্যাংক শৈলকুপা শাখার ম্যানেজার বসির উদ্দিন জানান, ব্যাংকের হিসাব নিয়ম অনুযায়ী রেজুলেশান ও অন্যান্য নিয়ম মানা হয়েছে তবে রেজুলেশনেই উল্লেখ আছে একক স্বাক্ষরে টাকা উঠানো যাবে। যেখানে সন্দেহ হয়েছে সেখানে হলুদ কালি দিয়ে বোল্ড করা হয়েছে। এদিকে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষিকা দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের দাবী রেজুলেশান আর ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই স্কুল পরিচালনা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন। এসব বিষয়ে শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. উসমান গনি জানিয়েছেন তদন্ত কমিটি গঠন সহ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে । তিনি সব কিছু খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে ১টি মিটিংও করেছেন।